ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জ্যাস্টিন গোমেজ

যেন মহামারী

প্রকাশিত: ১১:৪৪, ১১ জুলাই ২০১৯

যেন মহামারী

মাদক এক সর্বনাশা ছোবলের নাম। এটি এমন এক সামাজিক সমস্যা যা শুধু অপরাধের জন্ম দেয় এবং বিকাশ সাধন করে তাই নয়, এর বিষবাষ্প ছড়িয়ে যায় সমাজের প্রতিটি কোণায় কোণায়। আর এই মরণ নেশার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে আমাদের সামাজিক কাঠামোয়, আর্থসামাজিক উন্নয়নে, ভারসাম্যে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে। এক কথায় জীবনের সর্বত্র। বাংলাদেশেও এই বৈশ্বিক সমস্যার বাইরে নয়। বাংলাদেশে মাদক উৎপাদন হয় না ঠিকই, তবে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এদেশ মাদকদ্রব্য অপব্যবহারের মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। পাশাপাশি দ্রুত নগরায়ণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ইন্টারনেটের ব্যাপক ব্যবহার আর জনসচেতনতার অভাবে মাদক সমস্যা দিন দিন মহামারী আকার ধারণ করছে। আন্তর্জাতিক মাদক উৎপাদনকৃত এলাকা গোল্ডেন ক্রিসেন্ট (পাকিস্তান, আফগানিস্থান ও ইরাক) বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। পাশাপাশি গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল (মায়ানমার, লাউস, এবং থাইল্যান্ড) বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থান করায় বাংলাদেশ সবসময়ই মাদকের ঝুঁকির মধ্যে অবস্থান করে থাকে। বর্তমান বাংলাদেশে সাধারণত ইয়াবা, হিরোইন, গাঞ্জা, ইনজেকশনকৃত মাদক, ফেনসিডিল, এ্যালকোহল, ট্যাবলেট, সলিউশন এবং অন্যান্য নেশা জাতীয় দ্রব্যাদি পাওয়া যায়। বিশেষত যেসব কারণে একজন মাদকসেবী মাদক গ্রহণ করে থাকেন তার মধ্যে অন্যতম হলো, পিয়ার গ্রুপের প্রেসার। অর্থাৎ ছেলে-মেয়ের সহযোগী তথা বন্ধু যদি নেশাগ্রস্ত হয় তাহলে ওই কিশোর/কিশোরীর মাদকে আসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। মাদকাসক্ত যে নিজেই মাদকের ক্ষতিগ্রস্ততার শিকার হয় বিষয়টি এমন নয়, মাদকসেবীর সঙ্গে সঙ্গে পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী তথা সামগ্রিক সমাজব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। জৈবিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, শরীরবৃত্তীয় ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত ইস্যুতে মাদকের অপব্যবহার সমাজের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। আর এইদিক দিয়ে বলা যায় কেউই মাদকের ভয়ানক করাল গ্রাসের বাইরে নয় যখন পরিবারের কোন সদস্য মাদকাসক্ত হয়। মরণব্যধি মাদক যখন বাড়ির পাশে কিংবা বাড়িতে সেবন করা হয় তখন ওই পরিবারের সবাই মাদকের নেতিবাচক প্রভাবে কোন না কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। পাশাপাশি এটাও স্বীকার করতে হয় আজ, মাদকসেবীরা মাদকের আসক্তি থেকে সহজেই বেরিয়ে আসতে পারে না। কার্যত এসব ক্ষেত্রে বাবা-মাকে বেশি ভুগতে হয়। সন্তানকে মাদকের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত রাখতে যে কোন ধরনের অভিযোগ, অনুযোগ ও কষ্টকে সহ্য করে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয়। এমনও দেখা গেছে, পরিবারের একজন মাদকসেবীর কারণে পুরো পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। পারিবারিক কলহ ও সাংসারিক অশান্তি সৃষ্টিতে পরিবারের একজন মাদকসেবীই যথেষ্ট। কারণ, সন্তানের মাদক গ্রহণের কারণে বাবা-মা একে অপরকে দোষারোপ করে থাকেন। এর ফলে অনেক পরিবারেই বিবাহ বিচ্ছেদের মতো জঘন্য ঘটনা পরিলক্ষিত হচ্ছে। মাদকাসক্তি ও মাদকসেবী যে পারিবারিক অশান্তি সৃষ্টি করেছে বিষয়টি এমন নয়, মাদকের ভয়াবহতা মানসিক স্বাস্থ্য ও শারীরিক স্বাস্থ্য, প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিকরণ, আর্থসামাজিক অবস্থার অবনমন, রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি এবং অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি হিসেবে কাজ করে থাকে। মাদকের নেশায় আসক্ত হবার পেছনে যেসব কারণ কাজ করে তার মধ্যে রয়েছে বন্ধু বান্ধবের কুপ্রভাব, কৌতূহল, মানসিক সমস্যা, পারিবারিক অশান্তি, পরিবারে মাদকের ব্যবহার, সহজলভ্যতা, বেকারত্ব, হতাশা এবং সচেতনতার অভাব। তাই মাদকাসক্তি প্রতিরোধে সর্বপ্রথম পদক্ষেপটি নিতে হবে পরিবার থেকেই। তাই পরিবারের বড়দের ভূমিকা হওয়া উচিত নিজেকে পরিবারের ছোটদের জন্য রোল মডেল হিসেবে ভাবা। এমন কোন অভ্যাস নিজের ভেতর তৈরি হতে না দেয়া, যা সন্তান বা ছোট ভাই বোনের মধ্যে খারাপ প্রভাব ফেলে। স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করুন, ধূমপান থেকে দূরে থাকুন আর মাদককে ঘৃণা করুন। পিতা-মাতারা সন্তানের বন্ধু হোন। তার সঙ্গে কথা বলুন, সে সারাদিন কি করছে, কাদের সঙ্গে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে খবর নিন। ভাল বন্ধু নির্বাচনে সাহায্য করুন, যে কোন সমস্যায় পাশে থাকুন; পরিবারের যে কোন সদস্যের মধ্যে আচরণগত পরিবর্তন দেখলে সতর্ক হোন; যদি পরিবারে বা আপনজন কারও মাদকাসক্তির কথা জানতে পারেন তবে শান্ত থেকে তার পাশে দাঁড়ান। চিকিৎসা এবং কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করুন। মাদকাসক্তির চিকিৎসা অনেক সময়সাপেক্ষ এবং ওষুধের পাশাপাশি এখানে মানসিক বিষয়টিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সঙ্কটময় সময়ে ধৈর্য ধারণ করুন আর আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। নটর ডেম কলেজ, ঢাকা থেকে
×