ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সর্বজনীন পেনশন নীতিমালার খসড়া এ মাসেই

প্রকাশিত: ০৯:২০, ১১ জুলাই ২০১৯

সর্বজনীন পেনশন নীতিমালার খসড়া এ মাসেই

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ উন্নত বিশ্বের মতো সরকারী চাকরিজীবীদের পাশাপাশি দেশের সাধারণ মানুষকে পেনশনের আওতায় আনতে নীতিমালার খসড়া প্রস্তুত করতে কাজ শুরু করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর এ উদ্যোগ ‘যুগোপযোগী’ উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ হচ্ছে, ‘নীতিমালা চূড়ান্ত করার আগেই বেসরকারী খাত-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।’ জানা গেছে, সর্বজনীন পেনশন নীতিমালার খসড়া রূপরেখা তৈরির জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আজিজুল আলমের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি কমিটি কাজ করছে। চলতি মাসেই কমিটি এ সংক্রান্ত খসড়া নীতিমালা অর্থ সচিবের কাছে জমা দেবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত সচিব আজিজুল আলম বলেন, পেনশন কাঠামো তৈরিতে প্রয়োজনীয় বিষয়ের খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আইনী বিষয়গুলো পর্যালোচনার পাশাপাশি এ বিষয়ে অন্যান্য অভিজ্ঞতা একত্রিত করে নীতিমালা তৈরিতে এ সংক্রান্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। চলতি মাসেই নীতিমালার খসড়া তৈরি করে অর্থ সচিবের কাছে জমা দেয়া হবে। তিনি আরও বলেন, এ সংক্রান্ত নীতিমালার খসড়াটি প্রস্তুত হলেই সরকার বেসরকারী খাত-সংশ্লিষ্ট ও অন্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বসে নীতিমালা চূড়ান্ত করবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, এ সংক্রান্ত নীতিমালা চূড়ান্ত হলে প্রথমে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এর আওতায় আনা হবে। তারপর পর্যায়ক্রমে বেসরকারী খাতের চাকরিজীবী ও সাধারণ মানুষকে এ পেনশনের আওতায় আনা হবে। এতে বেসরকারী খাতের চাকরিজীবীদের সর্বজনীন পেনশনের আওতায় আনতে সময় লাগবে অন্তত তিন বছর। জানা গেছে, দেশের ছয় কোটি কর্মজীবীর পাঁচ কোটি ৮০ লাখই কাজ করেন বেসরকারী খাতে। চাকরি জীবন শেষে তাদের অর্থসঙ্কটে পড়তে হয়। এসব কর্মজীবীকে শেষ বয়সে সুবিধা দিতে চলতি বাজেটে দেয়া হয়েছে সবার জন্য পেনশন বা সর্বজনীন পেনশনের প্রতিশ্রুতি। সে আলোকে দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন তৈরি করছে অর্থ বিভাগ। চলতি বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়, সরকারী পেনশনাররা দেশের পুরো জনগণের একটি ভগ্নাংশ মাত্র। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতসহ দেশের সব জনগণের জন্য একটি সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা পর্যায়ক্রমে চালুর লক্ষ্যে একটি ‘ইউনিভার্সাল পেনশন অথরিটি’ শীঘ্রই গঠন করা হবে। গত অর্থবছরের বাজেটেও একই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। কিন্তু সেটা এখনও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। অর্থ বিভাগ সূত্র বলছে, সবার জন্য পেনশন কাঠামোটি প্রস্তুত করা বেশ সময় ও ব্যয়-সাপেক্ষ বিষয়। অনেক চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে এ বিষয়ে কাজ করছে অর্থ বিভাগ। এখন শুধু সরকারী চাকরিজীবীরাই মাসিক পেনশন সুবিধা পান। নতুন ব্যবস্থায় এর বাইরে বেসরকারী খাতে নিয়োজিত চাকরিজীবীদের পেনশনের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে। সূত্র জানায়, সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি ২০০৪ সালে সীমিত আকারে চালু করেছিল ভারত সরকার। কলকাতা ও আসাম ছাড়া বাকি সব রাজ্যে এ ব্যবস্থা বর্তমানে চালু রয়েছে। নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কা এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র আরও জানায়, এর আগেও এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার ওপর একটি প্রস্তাব দিয়েছিল। ওই প্রস্তাব অনুযায়ী সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় পেনশন তহবিল হবে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে। অর্থাৎ চাকরিজীবী ও নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে এ তহবিলে অর্থ দেবে। এর পরিমাণ হতে পারে চাকরিজীবীর মূল বেতনের শতকরা ১০ ভাগ। নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষও সমপরিমাণ অর্থ দেবে। সরকারী ও বেসরকারী খাতে একই নিয়মে তহবিল গঠন করা হবে। পেনশনের এ তহবিল ব্যবস্থাপনার জন্য একটি রেগুলেটরি অথরিটি থাকবে। এ অথরিটির মাধ্যমে পেনশন কার্যক্রম পরিচালিত হবে। প্রস্তাবিত পেনশন স্কিমের আওতায় সরকারী চাকরিজীবীদের বয়স হবে ৬০ বছর। বেসরকারী খাতের জন্য ৬৫ বছর। নির্ধারিত সময়ে চাকরি শেষে অর্ধেক পেনশনের টাকা এককালীন তোলা যাবে। বাকি টাকা তহবিলে থাকবে। সে অর্থ পরে প্রতি মাসে ধাপে ধাপে উঠানো যাবে। তহবিল পরিচালনার জন্য আলাদা রেগুলেটরি অথরিটি গঠন করা হবে। তারা লাভজনক খাতে তহবিলের অর্থ বিনিয়োগ করবেন। বিনিয়োগ সুরক্ষাও দেয়া হবে। এ থেকে যে মুনাফা আসবে, তার অংশ মাসে মাসে পাবেন সুবিধাভোগীরা। পেনশনভোগীদের স্মার্টকার্ড দেয়া হবে। প্রস্তাবিত পেনশন স্কিমে ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের সুবিধা থাকবে। সূত্র আরও জানায়, সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতির আওতায় বেসরকারী পর্যায়ে প্রাথমিকভাবে বড় বড় কর্পোরেট হাউস, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে কর্মরত চাকরিজীবীদের আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্য খাতের প্রতিষ্ঠানকেও আনা হবে। তবে এ ক্ষেত্রে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জের বিষয়ে অর্থ বিভাগের উর্ধতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, সবার আগে পেনশন তহবিল গঠন করতে হবে। এ তহবিলকে লাভজনক জায়গায় বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে সেক্ষেত্রে বিনিয়োগের বাজার নেই। এছাড়া এ তহবিল দেখাশোনার জন্য অভিজ্ঞ লোকবল লাগবে। সেটারও অভাব রয়েছে। তিনি আরও বলেন, এ তহবিল পরিচালনার জন্য যে রেগুলেটরি অথরিটি থাকবে সেখানে একজনকে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। সরকারের প্রথা অনুযায়ী, একজন সচিব অবসর গ্রহণের পর তাকে একটা পজিশন দিতে হয়। তাই তাকে এ অথরিটির চেয়ারম্যান করে দেয়া হলো। কিন্তু তিনি কর্মজীবনে এ ধরনের কোন কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। এমনভাবে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা পরিচালনা হতে পারে না। ‘ধরা যাক, আইন অনুযায়ী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ডে পাঁচ লাখ টাকা জমা থাকার কথা। ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মী হার্ট এ্যাটাকে মারা গেলেন। সরকারী অথরিটি ওই প্রতিষ্ঠানে প্রভিডেন্ট ফান্ডের জন্য গেল। কিন্তু প্রতিষ্ঠান বলল, তারা লসে ছিল। কর্মীদের বেতনও দিতে পারিনি। প্রভিডেন্ট ফান্ড কোথায় পাব? তখন কী হবে?’ তিনি বলেন, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা বাস্তবায়নে সার্বিকভাবে কাঠামোগত সংস্কার দরকার, যা সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ। প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ যেসব দেশে এ ধরনের ব্যবস্থা চালু হয়েছে, সেখানে কমপক্ষে ছয়-সাত বছর সময় লেগেছে। কাজটি কঠিন হলেও অসম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, একদিকে বেসরকারী খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে শ্রমিক অধিকারের জন্য অনেক শর্ত দেয়া আছে, তার সঙ্গে যদি পেনশনটা দেয়া হয় তাহেল এর প্রভাব ব্যবসায় কতটুকু পড়বে- সেটা বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। তিনি আরও বলেন, যদি একতরফাভাবে কোন স্কিম চালু করে দিয়ে এবং তা বাধ্যতামূলক করে দেয়া হয়, তাহলে যে উদ্দেশ্যে এটা করা হচ্ছে সেটা অর্জিত নাও হতে পারে। যদি এটা ব্যবসায়ীদের স্বার্থের পরিপন্থী হয়, তাহলে সেটা ব্যবসায়ীরা সহজে গ্রহণ করবেন না। তাই নীতিমালা তৈরির আগেই বেসরকারী খাত-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে এ বিষয়ে বৈঠক করার আহ্বান জানান তিনি।
×