ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্বৃত্ত ও ধর্মান্ধদের রাজত্ব ॥ ১১ জুলাই, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৮:৫৬, ১১ জুলাই ২০১৯

 দুর্বৃত্ত ও ধর্মান্ধদের রাজত্ব ॥ ১১ জুলাই, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ১১ জুলাই দিনটি ছিল রবিবার। এই দিন কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের অফিস ভবনে মুক্তিবাহিনীর সেক্টর কমান্ডারদের প্রথম সম্মেলন (১১-১৭ জুলাই) শুরু হয়। সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। অধিবেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের নানা ধরনের সমস্যা ও সমন্বিত ভবিষ্যত কর্মপন্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। লেঃ শামসুল আরেফিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা দল পাইকগাছা থানার কপিলমুনির রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণ করে। বিকেল সাড়ে ৬ টায় মুক্তিবাহিনীর ২ জন গেরিলা চাঁদপুর পাওয়ার স্টেশনের সামনে পাহারারত ২জন পাকসেনা ও ২ জন পাক পুলিশের ওপর গ্রেনেড ছোড়ে। এতে সবাই নিহত হয়। হেমায়েত বাহিনী কালকিনি থানার চলবল গ্রামে অপারেশন ঘাঁটি সরিয়ে নেয়ার পর টুঙ্গিপাড়া শেখ বাড়িতে দেড়শ’ পাঞ্জাবি সৈন্যের বিরুদ্ধে এক সফল আক্রমণ পরিচালনা করে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক সহকারী ড. হেনরি কিসিঞ্জার গোপনে চীন সফর শেষে পাকিস্তান প্রত্যাবর্তন করেন এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে একান্ত বৈঠকে মিলিত হন। লন্ডনের দ্য সানডে টাইমস ’দুর্বৃত্ত ও ধর্মান্ধদের রাজত্ব’ শিরোনামে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, খুলনা থেকে ছয় মাইল উত্তরে অবস্থিত এলাকাটি পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় নদীবন্দর, পুরো এলাকাজুড়ে ছনের ছাউনি দেয়া মাটির ঘর। লোটাপাহাড়পুর যশোর থেকে খুলনাগামী মহাসড়কের পাশে অবস্থিত। রাস্তাটি সেনা সদস্যদের চলাচলের কারণে ব্যস্ত। সৈন্যরা চকচকে আমেরিকান ট্রাকে বসে আছে, হাতে চীনা অটোমেটিক রাইফেল। হঠাৎ হঠাৎ ৩০৩ এনফিল্ড রইফেল হাতে বেসামরিক মানুষও দেখা যাচ্ছে। আমি সদর রাস্তা বাদ দিয়ে পাশের একটি ছোট রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। ফসলী জমির ফাঁকে ফাঁকে জলাশয়গুলো দেখে মনে হচ্ছিল যেন সবুজ-রূপালি রঙে ছককাটা দাবার বোর্ড। ...পূর্ব বাংলার অনেক গ্রাম আমি দেখেছি, যেগুলোকে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বা যেগুলোতে অল্প কিছু মানুষ বসবাস করছে। এই প্রথম আমি একটা গ্রাম দেখলাম যেটাকে আপাতদৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত মনে হচ্ছে না; কিন্তু গ্রামটা পরিত্যক্ত-জনমানবশূন্য। লোটাপাহাড়পুর আমার কাছে উদ্বাস্তুদের সম্মন্ধে একটি পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরে। এখানে কেউই ভাবছে না যে শরণার্থীরা ফিরে আসতে পারে। ... সামরিক কর্তৃপক্ষ অবশ্য ‘অভ্যর্থনা-কেন্দ্র’ ও ‘ট্রানজিট ক্যাম্প’ খুলেছে। আমি তাদের প্রস্তুতি দেখার জন্য গাড়ি চালিয়ে ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি বেনাপোলে গেলাম। সেখানে খুলনা এলাকার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লেঃ কর্নেল শামস-উজ-জামান আমাকে তার সদর দফতরে অভ্যর্থনা জানালেন। ২৫-২৯ মার্চে খুলনা শহরের নিরাপত্তার জন্য সামরিক অভিযান শুরু হয়। কর্নেল শামস জানান যে দুষ্কৃতকারী ও বিদ্রোহীদের হাত থেকে মাত্র গত মাসে তারা পুরো জেলাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে। সামরিক কর্তৃপক্ষের হিসেব মতে পূর্ব পাকিস্তানে এখন প্রায় ৫,০০০ রাজাকার রয়েছে, যাদের মধ্যে ৩০০ জনই খুলনা অঞ্চলের। তাদের প্রতিদিন তিন টাকা করে মাইনে দেয়া হচ্ছে, যেটা সরকারী রেটের ২৫ শতাংশ। তাদের সাত দিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় যেটার মূল উদ্দেশ্য পুলিশি লি-এনফিল্ড রাইফেলের মাধ্যমে কীভাবে গুলি করতে হয় তা শেখানো। এই রাজাকাররা স্থানীয় শান্তি কমিটির অধীনে পরিচালিত এবং তাদের মূল কাজ হচ্ছে সৈন্যদের আওয়ামী লীগের সমর্থকদের বাড়ি চিনিয়ে দেয়া। এই শান্তি কমিটিও গঠিত হয়েছে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে। .... পাকিস্তান রিভার সার্ভিসের একটি টাগবোটকে নৌবাহিনীর একটি গানবোট গোলার আঘাতে ডুবিয়ে দিয়েছে। স্থানীয় নৌবাহিনীর প্রধান আলহাজ গুলজারিন আমাকে জানিয়েছেন যে যে টাগবোটটি দুষ্কৃতকারীরা দখল করে নেয়ায় সেটি ডুবিয়ে দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। কারণ তারা টাগবোটটি ব্যবহার করে নৌবাহিনীর একটি জাহাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। যদিও স্থানীয় মাঝিদের কাছ থেকে জানা যায় যে টাগবোটটিতে সাধারণ ক্রুরাই ছিল এবং পাল্টা জবাব দেবার কোন সুযোগই তারা পায়নি। অপারেশনে সক্রিয় থাকা অবস্থায় আমি একজন রাজাকার কমান্ডার আবদুল ওয়াহাবের সঙ্গে আমার কথা হয়। তার মতে বিগত কয়েক সপ্তাহে খুলনায় অন্তত ২০০ জন রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্য নিহত হয়েছে। তিনি বলেন, তার নিজের গ্রুফ দু’জন দুষ্কৃতকারীকে হত্যা করেছে। যুদ্ধের গ-গোল ও সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা অভিযানে ঠিক কতজন লোক মারা গেছে তা আমি শেষ পর্যন্ত স্থির করতে পারলাম না। প্রত্যক্ষদর্শী একজন সরকারী ম্যাজিস্ট্রেট, যিনি তিন দিনের কারফিউয়ে ঘরে বন্দী ছিলেন জানালেন নদীর পাশে অবস্থিত নিজের বাড়ি থেকে তিনি অভিযানের দিন দশ মিনিটের মধ্যে ৪৮টি লাশ ভেসে যেতে দেখেছেন। শহরের অনেক এলাকাতেই আগুন দেয়া হয়েছে, কর্তৃপক্ষের ভাষায়: ‘বস্তি নির্মূল অভিযান। খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলে যাওয়ার রাস্তার দুই পাশে এক মাইলেরও বেশি এলাকা জুড়ে সবকিছু সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস করা হয়েছে। মংলা বন্দরে কী ঘটেছে সেটাও অস্পষ্ট। মংলাতে নৌকাযোগে পৌঁছানোর পর সেখানে দেখা যাচ্ছে বন্দরের ঘরবাড়ি ও বাজারের দোকানপাট পোড়ানো হয়েছে। বন্দরের পাশের দালানগুলোতে গুলির দাগ। বন্দরের ধ্বংসযজ্ঞ এপর্যন্ত আমার দেখা সবচেয়ে বেশি মারাত্মক ধ্বংসযজ্ঞ, অথচ এই সম্পর্কে পুলিশ কর্মকর্তা জানান যে বাজারের কোন একটা দোকান থেকে হ্যারিকেন উল্টে গিয়ে নাকি এই অগ্নিকা- ঘটেছে। কিন্তু পিএনএস তিতুমীরের কমান্ডার জারিন বললেন অন্য কথা। তার ভাষ্যে, ‘মংলায় দুষ্কৃতকারীদের সঙ্গে আমাদের জোর লড়াই হয়েছে। রাস্কেলগুলো আমাদের বিরুদ্ধে হাতবোমা ও পাইপগান নিয়ে যুদ্ধ করতে এসেছিল। কিন্তু গুলি নিক্ষেপের সময়ই তা বিস্ফোরিত হয় এবং অর্ধেক এলাকা পুড়ে যায়। ঘটনার কথা মনে করে কমান্ডার হেসে উঠেন। নদীর পাশের দালানগুলোতে গুলির দাগের কোনো ব্যাখ্যা তিনি আমাকে দিতে পারলেন না। মংলায় আমি এবিষয়ে আমি খুব বেশি অনুসন্ধান করতে পারলাম না কারণ আমার নিরাপত্তার জন্য সবসময় দু-জন বন্দুকধারী সৈনিক আমার সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে ছিল। তাদের ভয়ে এলাকাবাসী মুখ খুলতে পারছিল না। শরণার্থীদের ফিরে আসা প্রসঙ্গে বলা যায় যে কেবল অতি সাহসী এবং অতি বোকা লোকই এই মুহূর্তে দেশে ফিরে আসতে চাইবে এবং কেউ যদি ফিরেও আসে তবে তাকে অভ্যর্থনা জানানো হবে কিনা সে ব্যপারে সন্দেহ আছে। কেবল ভারত ও পাকিস্তানের যৌথ উদ্যোগই উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেরকম হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। আরও আশংকার কথা, শান্তিকমিটি ও রাজাকারদের দাপটে পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসন ক্রমশ ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েছে এবং এই রাজাকার বাহিনী একটি সমান্তরাল সরকার ব্যাবস্থা গড়ে তুলেছে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×