ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ধর্ষণের শিকার ৭৩১ জন

৬ মাসে ২ হাজারের বেশি মেয়ে শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে

প্রকাশিত: ১০:২৬, ৯ জুলাই ২০১৯

 ৬ মাসে ২ হাজারের বেশি মেয়ে শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে দুই হাজারের বেশি নারী ও মেয়েশিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৩১ জন। যাদের মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ২৬ জনকে। সোমবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়। এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্য ৩২টি সুপারিশও করেছে মহিলা পরিষদ। দেশের ১৪টি জাতীয় দৈনিকের তথ্য বিশ্লেষণ করে এই তথ্য তুলে ধরে মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আয়েশা খানম জানান, গতবছর সারাদেশে ৯শ’ ৪২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয় ৬৩ নারী ও শিশুকে। অর্থাৎ, গতবছর যে পরিমাণ ধর্ষণ হয়েছে তার অর্ধেক সময়ে এ বছর ধর্ষণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় দেড়গুণ। এই পরিসংখ্যান বলছে, শেষ ছয় মাসে শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন ৫৪ নারী, ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১২৩ জনকে, যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৭০ জন। এছাড়া এ্যাসিড সন্ত্রাস, যৌতুক, পাচার, শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা তো ঘটছেই। এমন বাস্তবতায় বর্তমান জাতীয় পরিস্থিতি, অব্যাহত নারী-শিশু নির্যাতনের প্রতিবাদ ও সামাজিক নিরাপত্তার দাবিতে সংবাদ সম্মেলনে দেশে ক্রমবর্ধমান ধর্ষণ ও সামাজিক অবক্ষয়ের বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে মহিলা পরিষদ। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০১৪ থেকে ২০১৮ সময়কালে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধিসহ মোট ৫২৭৪ নারী ও কন্যা নির্যাতনের শিকার হন। নারী ও শিশুদের উত্ত্যক্তকরণ ও যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা বেড়েই চলছে। এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত দুই হাজার ৮৩ নারী ও শিশু সহিংসতার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার ১১৩ জন। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১২৩ জনকে। শ্লীলতাহানির শিকার ৫৪ নারী ও শিশু। যৌন নির্যাতনের শিকার ৭০ জন। আর এ সময়ে মারধরের শিকার ১৪৭ জন। যৌতুকের কারণেও বড় সংখ্যক নারী নির্যাতনের শিকার হয় বলে সম্মেলনে জানানো হয়। তথ্য বলছে, যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার ৯৪ জন। এর মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ৪৭ জনকে। এতে আরও জানানো হয়, এসব নির্যাতন ও সহিংসতার ঘটনায় মাত্র তিন থেকে চার শতাংশ মামলায় সাজা হয়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। অভিবাসন নিয়ে বলা হয়, এখনও বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাড়ি দেয়ার জন্য দালালদের খপ্পরে পড়ে সাগর-মহাসাগরে অনেক তরুণের মৃত্যু হচ্ছে। মহিলা পরিষদ বার বার এই নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে। মানব পাচারকারীতে জড়িত এজেন্টদের শাস্তি দিতে হবে। সম্মেলনে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম বলেন, অধিকার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্ষণ আইনের সংশোধন ও সংস্কার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি দ্রুত বিচারের মাধ্যমে অপরাধীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। অন্যরা যাতে এ ধরনের অপরাধ থেকে দূরে থাকে। তবে এ জন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতির সংস্কার জরুরী বলে মনে করেন তিনি। নারী ও মেয়েশিশুর প্রতি যৌন নিপীড়নসহ সকল প্রকার সহিংসতা ও নির্যাতন বন্ধ করা, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে ছেলে ও মেয়েশিশুর সমঅধিকার নিশ্চিত করা, উত্ত্যক্তকরণ, যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, হত্যা ও নিপীড়ন রোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলাসহ সম্মেলনে সংস্থাটির পক্ষ থেকে ৩২টি সুপারিশ করা হয়। এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আয়েশা খানম বিশ্বের অন্যান্য দেশের উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, এখনও বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুকেই প্রমাণ করতে হয় যে সে ধর্ষণের শিকার। অথচ বিশ্বের অনেক দেশে অভিযুক্তকে প্রমাণ করতে হয় যে সে ধর্ষণ করেনি। সেই সঙ্গে কোন পরিস্থিতিতেই ১৮ বছরের আগে বিয়ে নয়, এমন প্রচারের সুপারিশ জানান। আয়েশা খানম বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতির সমাধান করা সবচেয়ে জরুরী। এজন্য আইনের যথাযথ সংশোধন ও প্রয়োগ হতে হবে। আমরা জানি, আইন প্রণয়ন একটি দীর্ঘ ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু যদি আমরা এটাকে জরুরী অবস্থা ধরি তাহলে কেন বিকল্প উপায়ে দ্রুত এই আইন সংশোধন করা যাচ্ছে না? এই পরিস্থিতি কী টেকসই উন্নয়নের সঙ্গে যাচ্ছে? গত বছরের তুলনায় ধর্ষণের হার দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে মহিলা পরিষদের সভাপতি বলেন, হঠাৎ ছয় মাসে এমন কী হলো যে এত বেশি ঘটছে এই ঘটনা? মনস্তত্ত্বের কী এমন পরিবর্তন হলো সেটা তো গবেষণা করে দেখা দরকার। অপরাধবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী এদের সমন্বয়ে বিষয়টি নিয়ে দ্রুত গবেষণা করা উচিত। পাশাপাশি গণমাধ্যমকেও বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা বাড়াতে, ফলোআপ বাড়াতে অনুরোধ করেন আয়েশা খানম। তিনি বলেন, বাচ্চাদের আমরা ভয়ে এ্যাকুরিয়ামের মধ্যে রেখে দিচ্ছি, তাদের এতটাই নিরাপদে রাখতে চাইছি যে তারা স্বাভাবিকভাবে বড়ই হতে পারছে না। অথচ বাচ্চারা তো প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াবে। কিন্তু সেই পরিবেশটা তাদের দিতে পারছি না। অন্যদিকে পরিবারেও তারা নিরাপদ নয়। মামা, চাচা, ফুফা কারও কাছেই নিরাপদ নয়। এটা কেন হবে? কেন সমাজের এই পরিবর্তন? বাতাসে যেমন দূষণ বেড়েছে তেমনি সমাজেও দূষণ বাড়ছে উল্লেখ করে এই মানবাধিকার কর্মী বলেন, সমাজের এই ময়লা পরিষ্কার করতে। বেগম রোকেয়ার মতো বলতে চাই, সমাজের বিবেক জাগ্রত হোক। আরেক পরিসংখ্যানের বরাত দিয়ে আয়েশা খানম বলেন, দেখা গেছে ধর্ষণের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের একটি বিরাট অংশ তরুণ। তারুণ্যের শক্তির কেন এই অপচয় হচ্ছে তা ভেবে দেখতে অনুরোধ করেন তিনি। এই অবক্ষয় রোধে আইন পরিবর্তন করার ওপর জোর দেন তিনি। সম্মেলনে সংস্থাটির সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু, লিগ্যাল এইডের পরিচালক মাকসুদা আক্তারসহ কেন্দ্রীয় কমিটির অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।
×