ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আছে নামমাত্র গাইডলাইন

ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রসার ঘটছে আইন ছাড়াই

প্রকাশিত: ১০:০১, ৯ জুলাই ২০১৯

  ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রসার ঘটছে আইন ছাড়াই

রহিম শেখ ॥ আইন ছাড়াই দেশে প্রসার ঘটছে ইসলামী ব্যাংকিংএর। আছে নামমাত্র একটি গাইডলাইন। এই গাইডলাইনের ওপর ভর করে পুরোদমে ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম চালাচ্ছে আটটি ব্যাংক। আরও নয় ব্যাংকের আছে ইসলামী ব্যাংকিং শাখা। অনেক ব্যাংক পুরোপুরি ইসলামী ব্যাংকে রূপান্তর হতে চাইছে, কিন্তু অনুমতি দিচ্ছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। অনেকেই বলছেন, সাধারণ আমানতকারীদের সঙ্গে প্রতারণা ও বিশ্বাস ভঙ্গ করে দেশে পরিচালিত হচ্ছে ইসলামী ব্যাংকিং। যেখানে ব্যাংকগুলো মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে ব্যবসা করছে। আমানত সংগ্রহ, বিনিয়োগ, বাণিজ্য কোন ক্ষেত্রেই মানা হচ্ছে না ইসলামী ব্যাংকিং নীতি। নীতি অনুসারে ‘মুদারাবা’ বা ‘মুশারাকা’ না থাকলে ইসলামী ব্যাংকিং বলা যাবে না। মুদারাবা অর্থ লাভ বা ক্ষতি যা-ই হোক, সেটার সমান ভাগীদার বিনিয়োগকারীকেও হতে হবে। অন্যদিকে ‘মুশারাকা’ অর্থ অংশীদারিত্ব, সহযোগিতা বা অংশগ্রহণ অর্থাৎ ‘দুই বা ততোধিক পক্ষের পুঁজি যৌথভাবে খাটিয়ে যে লাভ বা লোকসান হয়, তা নিজেদের মাঝে পূর্বনির্ধারিত হারে বণ্টন করে নেয়া।’ কিন্তু ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থায় এখনও মুদারাবা, মুশারাকা পুরোপুরি চালু হয়নি বাংলাদেশে। এছাড়া ‘রিবা’ বা ‘চক্রবৃদ্ধি’ সুদের হার নিষিদ্ধ থাকলেও তাও মানছে না ইসলামী ব্যাংকগুলো। জানা গেছে, ইসলামী ব্যাংকিং-এর প্রসার ঘটলেও দেশে এখন পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকিং পরিচালনার কোন আইন নেই। ১৯৮৩ সাল থেকে দেশে ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক নামমাত্র একটি গাইডলাইন তৈরি করে দেয়। এরপর ২০১১ সালে সংশোধন করা হয়। ২০১১ সালে অর্থমন্ত্রণালয় সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি খসড়া আইন চূড়ান্ত করে জমা দেয়। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে এখনও তা আলোর মুখ দেখেনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, দেশের ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর বিকাশের জন্য ইসলামিক ব্যাংকিং আইন করা হবে খুব শীঘ্রই। তিনি বলেন, আমরা মালেশিয়ার ইসলামিক ব্যাংকিং আইনের আলোকে দেশের ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর বিকাশের জন্য ইসলামিক ব্যাংকিং আইন করতে যাচ্ছি। যদিও সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, ভুলের ওপর নির্ভর করে ইসলামী ব্যাংকিং হচ্ছে। দুর্ভাগ্য হলো, বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় এটি চালু আছে, কিন্তু এটি একটি প্রতারণা। আইএমএফও এর কথা বলছে। এটি বন্ধ করার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ইসলামী ব্যাংকিং বন্ধ হবে কি হবে না, তা মুসলিম উম্মাহর সচেতনতার ওপর নির্ভর করছে। মুসলিম উম্মাহ যখন বুঝতে পারবে, ইসলামের নামে জঘন্য কাজ চলছে, তখনই এটি বন্ধ করা যাবে। মন্ত্রী বলেন, ইসলামে রিবা নিষিদ্ধ। কিন্তু রিবা ও সুদ এক নয়। রিবা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে। এখানে কোন মানবিকতা নেই। সুদ হচ্ছে কস্ট অব ফান্ড (তহবিলের ব্যয়) বা কস্ট অব এ্যাডমিনিস্ট্রেশন (প্রশাসনিক খরচ)। ধর্ম নিয়ে যারা বেশি কথা বলেন তারা সুদ আর রিবাকে এক করে ফেলেন। জানা যায়, দেশে ৫৯ ব্যাংকের মধ্যে আমানত ও ঋণের হিসাবে দেখা গেছে এক-চতুর্থাংশই ইসলামিক ব্যাংকগুলোর দখলে রয়েছে। এখন দেশে পুরোদমে ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম চালাচ্ছে আটটি ব্যাংক। ব্যাংক হলো ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, ফার্স্ট সিকিউরিটিজ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক লিমিটেড, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, এক্সপোর্ট ইম্পোর্ট ব্যাংক অব বাংলাদেশ লিমিটেড (এক্সিম), সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড ও ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড। এছাড়া নয়টি প্রচলিত (কনভেনশনাল) ব্যাংকের ১৯টি শাখা এবং আটটি প্রচলিত ব্যাংকের ২৫ উইন্ডোর মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিং চলছে। এসব ব্যাংক, শাখা এবং উইন্ডোতে মোট আমানতের পরিমাণ দুই লাখ ৩৭ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। যা দেশের সব ব্যাংকের মোট আমানতের ২৩ দশমিক ৫০ শতাংশ। ২০১৪ সালে এর পরিমাণ ছিল এক লাখ ৩৩ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। একইভাবে বিনিয়োগের পরিমাণও বাড়ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, কল্যাণ ও গ্রাহককেন্দ্রিক মডেলের কারণে অনেক ঋণগ্রহীতা ও আমানতকারী ইসলামী ব্যাংকিং পছন্দ করেন। বাস্তবভিত্তিক ব্যাংকিং এবং যথাযথ নিয়ম মেনে ঝুঁকি মোকাবেলা করার কারণে টেকসই ব্যাংকিং হিসেবে ইসলামী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে বলে মনে করছেন ইসলামী ধারার ব্যাংক পরিচালনাকারীরা। তারা বলছেন, এরই ধারাবাহিকতায় ইসলামী ব্যাংকগুলোর সাফল্য দেখে এর প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। এ আগ্রহ শুধু মুসলিম প্রধান দেশে হচ্ছে তা নয়, অমুসলিম প্রধান রাষ্ট্রেও ইসলামী ব্যাংক গ্রহণযোগ্য হচ্ছে। ব্যবসায়িক মুনাফা নয়, সমাজ উন্নয়ন ও মানবতার সেবাই ইসলামী ব্যাংকিংয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য। সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংকিং সংক্রান্ত এক গোলটেবিল আলোচনায় ইসলামী ব্যাংকগুলোর কেন্দ্রীয় শরিয়াহ বোর্ডের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান এম আযিযুল ইসলাম বলেন, মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামিক ব্যাংকের ব্যাপক চাহিদা আছে। আমাদের দেশে ইসলামী ব্যাংক পরিচালনায় মুদারাবা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। মুদারাবা অর্থ লাভ বা ক্ষতি যা-ই হোক, সেটার সমান ভাগীদার বিনিয়োগকারীকেও হতে হবে। আমি এ প্রস্তাব নিয়ে যাই বাংলাদেশ ব্যাংকে। বাংলাদেশ ব্যাংক আমাকে জানাল, সমগ্র ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আমরা আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করি, কিন্তু আপনি বলছেন যদি ক্ষতি হয়, তাহলে সেটা বিনিয়োগকারীকেও বহন করতে হবে, সেটা তো হতে পারে না। তখন আমি বললাম, এটা তো ইসলামিক আইন। আপনাকে সেটা মানতেই হবে। আর ইসলামী ব্যাংকিংয়ের লাইসেন্স তো আপনারাই দিয়েছেন। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক আমাকে বলেছিল, আপনারা এ চিঠি নিয়ে যান। তার পর আপনাদের বোর্ডে এটাকে উপস্থাপন করেন। আমরা তা-ই করলাম এবং বোর্ড অনুমোদন দিল। সেক্ষেত্রে আমাদের প্রয়োজন একটা দায়িত্বশীল নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এটা এখন ইসলামী ব্যাংকগুলোর একটা চাহিদা। সেটা পূরণ না হওয়ায় ইসলামী ব্যাংকিং সম্পর্কে যাদের তেমন ধারণা নেই, তারা এ ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করছে। বিআইবিএমের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে তিন ধরনের ইসলামী ব্যাংকিং করে এমন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তিনটি ভাগ রয়েছে। কিছু ব্যাংক পুরোপুরি ইসলামী ব্যাংকিং করে (এ১ ক্যাটাগরি), কোন কোন ব্যাংক কয়েকটি শাখার মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিং পরিচালনা করে (এ২ ক্যাটাগরি) এবং কিছু ব্যাংক কয়েকটি উইন্ডোর (এ৩ ক্যাটাগরি) মাধ্যমে এটি করে থাকে। এগুলোর ওপর বিআইবিএম গবেষণা করে দেখেছে, এ১ ক্যাটাগরির গড় সুশাসনের হার ৮৩ শতাংশ। আর এ ক্যাটাগরির দুটি ব্যাংক রয়েছে যারা সর্বোচ্চ সুশাসন রয়েছে ৮৯ শতাংশ। তবে সুশাসনের সর্বনিম্ন পর্যায় হলো ৭৮ শতাংশ। সুশাসনের হিসেব করা হয়েছে এএওআইএফআই-এর পাঁচটি স্ট্যান্ডার্ডের ওপর ভিত্তি করে। এ২ ক্যাটাগরির ব্যাংকগুলো সুশাসনের সর্বোচ্চ হার হলো ৮৩ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন ৭৯ শতাংশ। আর এ৩ ক্যাটাগরির ব্যাংকগুলো সব ধরনের সুশাসনের স্ট্যান্ডার্ডগুলো মেনে চলে না। ফলে তাদের গড় সুশাসনের হার অনেক কম, যা ৫৯ শতাংশ। আর এ ধরনের ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ সুশাসনের হার ৭২ এবং সর্বনিম্ন হার ২৮ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, ইসলামী ব্যাংকগুলোর সেবা যথেষ্ট স্বচ্ছ নয়। সেখানে কিভাবে মুনাফা নির্ধারণ হয়, সেটাও স্পষ্ট নয়। প্রথাগত ব্যাংকে এটি নির্ধারিত থাকে ১০ বা ১২ শতাংশ। ইসলামী ব্যাংকগুলো কিভাবে গ্রাহককে মুনাফা দিচ্ছে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সব বিষয় সমন্বয় করাও একটা চ্যালেঞ্জিং। আর ব্র্যান্ডিং হবে তখনই, যখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা যথাযথভাবে বাজারে থাকবে। আইন স্পষ্ট হবে এবং ব্যাংকগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করবে।
×