ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তৌহিদুল ইকবাল সম্পদ

কমিকসের ফেরিওয়ালা

প্রকাশিত: ০৮:৫৭, ৯ জুলাই ২০১৯

কমিকসের ফেরিওয়ালা

ডিপ্রজন্ম : আপনার সম্পর্কে বলুন- সম্পদ : ছোটবেলা থেকেই কমিকস নিয়ে কাজ করি, বলতে পারেন কমিকস আমার প্যাশন। বর্তমানে থ্রি ডি এ্যানিমেশন ফ্রিল্যান্সার হিসেবেও কাজ করছি। বাবা আনোয়ার ইকবাল, মা সফুরা ইকবাল। গ্রামের বাড়ি সিলেটের হবিগঞ্জে হলেও জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই। পড়াশোনা করেছি নিকুঞ্জের জানে আলম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, শহীদ রমিজউদ্দিন সরকারী কলেজ এবং ঢাকা সিটি কলেজে। ডিপ্রজন্ম : আমাদের দেশে কমিকস ও এ্যানিমেশনের কাজ শেখার সুযোগ-সুবিধা এখনও সীমিত। তারপরও আপনি কিভাবে এই কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়ালেন? সম্পদ : বিশ্বের অনেক দেশেই কমিকস ও এ্যানিমেশ বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু আমাদের দেশে এখনও ততটা প্রচলিত নয়। তারপরও কেন জানি ছোটবেলা থেকেই কমিকস আমার প্রিয় বিষয়। নন্টে ফন্টে ও সুপারম্যান খুব পড়তাম। শুধু কমিকস পড়তামই না তৈরি করারও চেষ্টা করতাম। আমার বয়স যখন সাত-আট বছর তখন কমিকস লেখা শুরু করি। ১৯৯২ সালের কোন একদিন আমার আব্বা কিশোর পত্রিকার সম্পাদক কাজী আনোয়ার হোসেনের কাছে নিয়ে যান। আমি তাকে আমার কিছু কাজ দেখাই। তিনি আমার কাজ দেখে মুগ্ধ হয়ে সেগুলো কিশোর পত্রিকায় ছাপানোর অনুমতি দেন। তখন থেকেই ‘রিঙ্কু-পিঙ্কুর বেড়া দেয়া,’ নামে কিশোর পত্রিকায় আমার দুই পৃষ্ঠার কমিকস ছাপা হতো। ফলে আগ্রহটা আরও বেড়ে যায় এবং আমার কাজের পরিমাণ ও গুণগত মান বাড়ানোর চেষ্টা করি। পরবর্তীতে ২০০১ সালে এ্যানিমেশনের সঙ্গে পরিচিত হই এবং এ্যানিমেশনের ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি আমার শিক্ষণীয় বিষয় ছিল অটোটেক্সট থ্রিডি এস ম্যাক্স এবং অটোডেক্স কমিউনিটি মায়া। এক কথায় বলতে গেলে ছোটবেলা থেকেই এই কাজের প্রতি আমার স্বভাবজাত যে ভাললাগা ও ভালবাসা তৈরি হয়েছে সেটিই আমাকে এই পেশায় নিয়ে এসেছে। ডিপ্রজন্ম : কোন কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন এবং আপনার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাজ- সম্পদ : এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। আমি ডেনমার্কের অর্থায়নে পরিচালিত ক্লিক হাইজ স্টুডিও-তে কাজ করেছি প্রায় সাড়ে তিন বছর। এছাড়াও ওডেক্স ডট কম-এ ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করেছি। বর্তমানে আপওয়ার্ক ডট কম এ ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করছি। আমার উল্লোখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে দুর্জয় ও মারুফ নামে দুটি কমিকস সিরিজ। বর্তমানে দুর্জয় সিরিজটির ১-১৩ পর্ব এবং মারুফ সিরিজটির ১-৪ পর্ব পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়াও অনলাইনে স্যাম’স প্যাড নামে আমি একটি অনলাইন টিউটোরিয়াল পরিচালনা করছি। ডিপ্রজন্ম : এ ধরনের চ্যালেঞ্জিং পেশা বেছে নিলেন কেন? সম্পদ : আমি চাই আমাদের দেশে কমিকস ও এ্যানিমেশন আরও বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠুক এবং শিল্প সংস্কৃতির অন্যান্য শাখার মতোই বলিষ্ঠরূপে আত্মপ্রকাশ করুক। আমি এই কাজ শিখতে গিয়ে পরামর্শ নেয়ার মতো তেমন কাউকে পাইনি। নিজের চেষ্টায় যা শিখেছি তা নিয়েই এগিয়েছি। আগেই বলেছি এই কাজই আমার ধ্যান-জ্ঞান। আমাদের দেশে এই কাজের প্রসারের লক্ষ্যেই নিজেকে এই পেশায় জড়ানো। তাছাড়া এই কাজে যারা আগ্রহী তাদের পরামর্শদাতা কিংবা সহযোগী হয়ে কাজ করতে পারলে নিজেকে সার্থক মনে করব। এর জন্য আমি আমার জীবনের অনেক কিছুই ত্যাগ করতে প্রস্তুত। ডিপ্রজন্ম : আপনার কমিকস সিরিজ দুর্জয় ও মারূফ সম্পর্কে জানতে চাই- সম্পদ : আমার এই দুটি সিরিজের প্রধান চরিত্র দুর্জয় এবং মারূফ উভয়েই প্রতিবাদী রূপক চরিত্র। এরা সামাজিক নানা অসঙ্গতি সম্পর্কে প্রতিবাদ ও সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করে। বিশেষ করে মাদক ও মাফিয়া চক্রের বিরুদ্ধে। দুর্জয় ছোটবেলায় মা-বাবার অবহেলায় বড় হয়েছে। তাই তার ক্ষোভ রয়েছে পরিবার ও সমাজের প্রতি। কাউকে সহজে বিশ্বাস করতে চায় না। এমনকি প্রতিবাদের ক্ষেত্রে সে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও খুব একটা পাত্তা দেয় না। নিজে নিজেই সমস্যার সমাধান করতে চায় বা করে থাকে। ফলে মাফিয়া ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনী উভয়ের কাছেই সে অপ্রিয়। অপরদিকে মারূফ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় নানা সমস্যার সমাধান করে থাকে। এতে করে মারূফ মাফিয়াদের কাছে অপ্রিয় হলেও আইনের লোকদের কাছে তার সখ্য রয়েছে। ডিপ্রজন্ম : আন্তর্জাতিক মানের কাজের সঙ্গে আমাদের দেশের কাজের মূল্যায়ন কিভাবে করবেন? সম্পদ : বিশ্বের যে সব দেশে কমিকস ও এ্যানিমেশন আজ বেশ জনপ্রিয়, সে সব দেশের মানুষ এই বিষয়গুলোর সঙ্গে অনেক বছর ধরে পরিচিত। আর আমাদের দেশে এসব বিষয় এসেছে অল্প কিছুদিন হলো। সেদিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যায় বর্তমানে যেসব দেশে ভাল ভাল কাজ হচ্ছে তারা বিষয়টিকে বোঝার এবং এর মানোন্নয়নে যথেষ্ট সময় পেয়েছেন। সেদিক থেকে তারা এগিয়ে। অপরদিকে আমাদের দেশে এই ধরনের কাজের সঙ্গে পরিচিতি, কাজের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনা করলে আমরাও একেবারে খারাপ অবস্থানে নেই। তবে সাধারণভাবে বিশ্বমানের কাজ করতে অবশ্যই আমাদের এখনও আরও অনেক বেশি কাজ করতে হবে। ডিপ্রজন্ম : আমাদের দেশে কমিকসের জনপ্রিয়তা না পাওয়ার কারণ কী হতে পারে? সম্পদ : বিষয়টি আমার কাছেও বিস্ময়ের। তবে সাধারণত আমাদের দেশের প্রকাশনা সংস্থাগুলো কমিকসের বই ছাপানোয় কম আগ্রহী। সম্ভবত কমিকস প্রকাশ করে ব্যবসায় সফল না হওয়ার ভয় কাজ করে তাদের মাঝে। অথচ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি প্রচুর পাঠক কমিকসে আগ্রহী কিন্ত তাদের অভিযোগ তারা বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণ খুঁজে পান না। আমার কাছে কমিকসের প্রচারের সীমাবদ্ধতাকেই এর বিকাশে বড় বাধা মনে হয়। ডিপ্রজন্ম : আপনারা যারা এই কাজের সঙ্গে জড়িত; তারা কমিকস- কে জনপ্রিয় করে তুলতে কী ভূমিকা রাখতে পারেন? সম্পদ : কমিকসকে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের যথেষ্ট ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আর্থিক সীমাবদ্ধতার দরুন খুব বেশি কিছু করতে পারছি না। এর জন্য যেসব ভাল বই রয়েছে সেগুলো বিদেশী এবং বেশ চড়া মূল্যের, যার ক্রয়ক্ষমতা বেশিরভাগ মানুষের সাধ্যের বাইরে। কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা পেলে, আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির উপর কমিকস এর বই তৈরি করে স্বল্পমূল্যে প্রচার ও প্রকাশ করতে পারলে মানুষ সহজেই বিষয়টি নিতে পারত। তাছাড়া বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে এই বিষয়গুলো নিয়ে ক্যাম্পেইন করা, বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা ও পুরস্কৃত করে নতুন প্রজন্মকে উৎসাহিত করেও এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো যেতে পারে। ডিপ্রজন্ম : তরুণ প্রজন্ম যারা এই কাজ করছে তাদের উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ- তৌহিদুল : তরুণ প্রজন্মের প্রতি আমার প্রথম কথা এই কাজ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট মনোযোগ ও শ্রম দিন। অভিজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে নিজস্ব সংস্কৃতি ধরে রেখে বাস্তবধর্মী কাজ করুন। এমন অনেক কাজ রয়েছে, যেগুলো দেখনে উন্নত দেশের কাজের কপি মনে হয়। তাই সকলের প্রতি আমার অনুরোধ কপি নয়, আপনাদের মেধা-শ্রম, কাজের মাধ্যমে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিকে তুলে ধরুন। যেমন : জাপান তাদের কমিকসে নিজস্ব সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এমনিভাবে ইউরোপীয় দেশগুলোর কাজ দেখলেও একই বিষয় পরিলক্ষিত হয়। ডিপ্রজন্ম : এ ধরনের কাজ শিখে দেশে এবং দেশের বাইরে ক্যারিয়ার গঠনের সম্ভাবনা কেমন? সম্পদ : ভাল মানের কাজ করতে পারলে এই কাজের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। ডিপ্রজন্ম : কার্টুন ও কমিকস কি একই বিষয়? তৌহিদুল ইকবাল সম্পদ : মোটেও না। কার্টুন ও কমিকস সম্পূর্ণ আলাদা। কার্টুনে সাধারণত রাজনৈতিক ও পরিবেশবান্ধব নানা বিষয় ব্যঙ্গাত্মকভাবে তুলে ধরে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়। কার্টুনে ড্রইং মূখ্য নয়। মুখ্য বিষয় হলো– আইডিয়া ও মেসেজ। তাছাড়া কার্টুন এক ফ্রেমে হতে হবে। অপরদিকে কমিকস এর ক্ষেত্রে ফ্রেম একাধিক হয় এবং গল্প, সংলাপ ও ড্রইং এ গুণগত মানের ঘাটতি রাখা চলে না। ডিপ্রজন্ম : আপনার প্রিয় ব্যক্তিত্ব- তৌহিদুল ইকবাল সম্পদ : পশ্চিমবঙ্গের নারায়ন দেবনাথের কাজ আমার ভাল লাগে। এছাড়াও অস্টিন ব্রিকস, এ্যালেক্স রেমন্ড আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব। আর এন্ড্রু লুমিসের কাজ দেখে আমি আমার কাজে যথেষ্ট উন্নতি করতে পেরেছি বলে আমি মনে করি। ডিপ্রজন্ম : ব্যক্তি ও শিল্পী তৌহিদুল ইসলাম সম্পদকে কীভাবে দেখেন? তৌহিদুল ইকবাল সম্পদ : শিল্পী তৌহিদুল ইকবাল সম্পদ সর্বদা অন্যায়ের প্রতিবাদী, তার স্বপ্ন আকাশছোঁয়ার। হাতের কাছে যে কাজই পায়, সেই কাজে শতভাগ ইফোর্ট দেয়। সে তার কমিকসে ধর্ম ও রাজনীতিকে এড়িয়ে চলে। আর ব্যক্তি সম্পদ কঠোর পরিশ্রমী, নিজ ও পরিবারের প্রতি যথেষ্ট সচেতন ও দায়িত্বশীল, ব্যতিক্রমধর্মী ও চ্যালেঞ্জিং কাজ করতে কখনও পিছপা হয় না।
×