ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বলুন না এখন আমি কি করব?

প্রকাশিত: ০৮:৫১, ৯ জুলাই ২০১৯

বলুন না এখন আমি কি করব?

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ ১৯৭১ সালের ৯ জুলাই দিনটি ছিল শুক্রবার। এই দিন রুশ সংবাদপত্র ইজভেসতিয়ায় প্রকাশিত এক সংবাদভাষ্যে ভারত ও পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে উপমহাদেশে যুদ্ধ এড়ানোর ব্যাপারে মস্কোর প্রত্যাশার কথা বলা হয়। ‘ওই সংবাদ ভাষ্যে বলা হয়েছে, অতীতে স্থানীয় সংঘাত থেকে বৃহত্তর সামরিক সংঘর্ষের সূচনা ঘটেছে এবং এতে পূর্ব পাকিস্তান ইস্যুতে ভারত ও পাকিস্তানকে শান্তিপূর্ণ একটি সমাধান খুঁজে বের করতে বলা হয়েছে। ভারতে যারা যুদ্ধের পক্ষে ছিলেন, তাদের অভিসন্ধি ইন্দিরা গান্ধীর প্রত্যাখ্যানকে ওই সংবাদে স্বাগত জানানো হয়।’ ... বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আজ সকালে ডেইলি টেলিগ্রাফের ক্লেয়ার হলিংওর্থ পূর্ব পাকিস্তান থেকে রিপোর্ট করেছেন। তিনি জানান সীমান্তে পাকিস্তান ও ভারতীয় সৈন্যরা খুব কাছ থেকে একে অপরের মুখোমুখি অবস্থান করছে এবং রোজ সীমান্ত জুড়ে বিক্ষিপ্তভাবে গুলিবিনিময় চলছে। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা প্রতি রাতে সীমান্ত ক্রস করে প্রবেশ করছে। তারা সীমান্ত এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষতি করছে। ভারতীয় পার্শ্ব, উদ্বাস্তু দ্বারা পূর্ণ। আর পাকিস্তানের পাশ অনেকটা ফাঁকা। কিছু উদ্বাস্তু পাকিস্তানে ফিরে আসছে। তিনি মনে করেন এই অবস্থায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর উপস্থিতি খুব দরকার। ... দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পূর্ববঙ্গের সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষ ঢাকা বিমানঘাঁটি, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এবং অস্ত্রাগারের কাছে স্থায়ীভাবে বিমানবিধ্বংসী কামান বসিয়েছে। এ ছাড়া মিরপুরের চিড়িয়াখানায় কুর্মিটোলার নবনির্মিত বিমানঘাঁটিতে এবং ঢাকা শহরের বৃহত্তম শিল্প এলাকাগুলোতেও বিমানবিধ্বংসী কামান বসানো হয়েছে। সম্প্রতি ঢাকা থেকে আগত একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি এই সংবাদ দিয়েছেন। ... স্বাধীন বাংলা বেতারের বিশ্বজনমত অনুষ্ঠানে মার্কিন সাময়িকী নিউজউইক’-এ প্রকাশিত বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্পর্কিত একটি মর্মস্পর্শী রিপোর্টের অংশবিশেষ উল্লেখ করা হয়েছিল। দ্য টেরিবল ব্লাড বাথ অব টিক্কা খান’ বা ‘টিক্কা খানের বীভৎস রক্তস্নান’ শিরোনামের এই রিপোর্টে নিউজ উইক’ সংবাদদাতা টনি ক্লিফটন বাংলাদেশে পাক বর্বরতার একটি আংশিক চিত্র তুলে ধরেছেন। টনি ক্লিফটন তার রিপোর্টে বাংলাদেশে পাক হানাদারদের হত্যা, নির্যাতন ও ব্যভিচারের বর্ণনা দিতে গিয়ে বাংলাদেশের একটি সর্বহারা বালিকার এক মর্মান্তিক কাহিনী তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, লালফুল ও সবুজ লতাপাতা আকা গোলাপী রঙের একটা ছেড়া ফ্রকের আট-নয় বছরের বালিকা ইসমত আরার মুখে আমি এক ভয়ঙ্কর আতঙ্কের প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করেছি। আমি তাকে দেখলাম শরণার্থী শিবিরের অনতিদূরে একটি হাসপাতালে। শত শত আহতদের ভিতড়ে একপ্রান্তে সে দাঁড়িয়ে ছিলো। দিশেহারা দুটি ভীরু চোখ দিয়ে চারদিকে সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। সে যে আহত আমি তা দূর থেকেই লক্ষ্য করলাম। মনে হলো শীর্ণ আলোর একটি রেখার মতো এই মেয়েটি তো কারও বিপদের কারণ হতে পারে না? এই ছোট্ট মেয়েটি ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর কাছে কি এমন বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল যার জন্য তারা এভাবে আঘাত করেছে? একজন পাকিস্তানী সৈন্য বেয়োনেট দিয়ে তার ঘাড়ে আঘাত করেছে। তার শ্বাসনালী কেটে দিয়েছে। সে তার গলার ব্যান্ডেজের ওপর একটা হাত রেখে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি এগিয়ে গেলাম। মেয়েটি বলল, আমার নাম ইসমত আরা আমার বাবার নাম মরহুম ইশাক আলী। কুষ্টিয়ায় আমার বাবার দোকান ছিল। দুই মাস আগে বাবা কুষ্টিয়ায় রওনা হয়েছিলেন সেই রাতে আমি ঘুমোবার আগে বাইরে কোলাহল আর ভারি ভারি পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। কি হচ্ছে না হচ্ছে দেখতে যাওয়ার আগেই দেখতে পেলাম অনেক পাকসৈন্য আমাদের ঘরে ঢুকে পড়েছে। তারা আমাদের ঘরে ঢুকেই আমার দাদাকে গুলি করে। আমার দাদা বিএসসি পাস করেছিল। তারপর তারা আমার মা ও বোনদের ওপর অত্যাচার চালায় এবং তাদের শেষ পর্যন্ত বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলে। একজন সৈন্য লাফ দিয়ে এসে আমাকে আঘাত করে। তারা বেয়োনেট দিয়ে আমার গলায় আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গে আমি পড়ে যাই এবং মৃতের ভান করি। তারপর সৈন্যরা চলে গেলে পরের দিন একজন লোক আমাকে অচেতন অবস্থায় তুলে নিয়ে আসে। এই কথাগুলো বলার সঙ্গে সঙ্গে সে যেন কেমন হয়ে পড়েছিল। সেই বীভৎস দৃশ্য যেন তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। সে তা সহ্য করতে না পেরে হঠাৎ সরে গেল আমার কাছ থেকে। আর তাকে দেখতে পেলাম না। ... লন্ডনের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে পাকিস্তানী ও ভারতীয় সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ১৫০০ মাইল বরাবর সীমান্ত পারাপার হওয়ার সকল মূল রাস্তার নোম্যান্স ল্যান্ডের ৫ থেকে ৫০ গজ দূরত্বে পরস্পর বিপজ্জনকভাবে মুখোমুখি অবস্থান করছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে, প্রতিদিন ছোট অস্ত্র, দুই-ইঞ্চি মর্টার মাঝেমধ্যে আর্টিলারি বিক্ষিপ্ত গোলাগুলির কারণে সীমান্তে উত্তেজনার তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা স্পষ্টত যুদ্ধের মতো অবস্থার মধ্যে রয়েছে। তারা যাতে কোন ছোটখাটো কিন্তু সংঘবদ্ধ বাহিনীর আক্রমণ থেকে পাঁচ মিনিটের জন্য নিজেদের রক্ষা করতে পারে সে জন্য নিজেদের বাঙ্কার খনন, প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান এবং সীমান্তে যতদূর সম্ভব বলয় তৈরি করছে। ঘন ঘন সতর্কতা জারি- কিছু বাস্তব কিন্তু অন্যগুলো ভুয়া। যখন সবাইকে জলাবদ্ধ পরিখার মধ্যে ঢুকতে বাধ্য করা হয়, তখন এই বিপজ্জনক যুদ্ধ খেলায় উত্তেজনা বৃদ্ধি করে যা একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনাকে সহজেই বাস্তব জিনিসে রূপ নিতে পারে। উভয় পক্ষের প্রেস এবং রেডিওতে প্রতিদিন ক্রমবর্ধমানভাবে একে অপরকে ‘শত্রু’ বলে ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে। উত্তেজনা অব্যাহত রয়েছে।... হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, জনাব জয়প্রকাশ নারায়ণ ,বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বভ্রমণ শেষে ফিরে এসে বলেন, ক্ষমতাধর দেশগুলো এখনও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আগ্রহী, তাদের মধ্যে কেউ কেউ সম্ভবত ভারতের সঙ্গে শরণার্থীর বোঝা ভাগ করতে ইচ্ছুক কিন্তু কেউ বাংলাদেশ বা ভারতকে এই বিপদ থেকে মুক্ত করবে না। তিনি বলেন, মিসেস গান্ধীর জন্য সময় এসেছে ইয়াহিয়া সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়ার। জনাব নারায়ণ যোগ করেন, যুক্তরাষ্ট্র যে অজুহাতেই হোক না কেন পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠিয়েছে এবং পাকিস্তান এই অস্ত্র চালান থামানোর পরিবর্তে এটিকে সাহায্যের পুনরারম্ভ হিসেবে বিবেচনা করছে। ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকরা জনাব নারায়ণের কাছে স্পষ্ট করেছিলেন যে, ‘তারা বাংলাদেশের প্রকৃত প্রতিনিধিদের সঙ্গে রাজনৈতিক পুনর্বাসন দেখতে চায়, কারও হাতের পুতুলের সঙ্গে নয়। জনাব নারায়ণের মতে সোভিয়েত মনোভাব অনেক বেশি সহায়ক ছিল। রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট জনাব পদর্গনি একমাত্র রাষ্ট্রপ্রধান যিনি ইয়াহিয়া খানের কাছে পাঠানো চিঠিতে তার অস্বস্তির কথা জানিয়েছেন ও পাকিস্তানী পদক্ষেপের জন্য সামান্য সমালোচনা করেছেন। জনাব নারায়ণ আরব দেশগুলোর মধ্যে শুধু কায়রোতে ছিলেন এবং সেই সময় মিসর সহিংস রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে ছিল। তবে কায়রোতে তিনি মানুষের নামেমাত্র কৌতূহল ও অপর্যাপ্ত প্রেস কাভারেজে হতাশ হয়েছেন এবং ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াতে এর ঠিক বিপরীত অবস্থা খুঁজে পেয়েছেন। অহিংস আন্দোলন থেকে যুদ্ধে পরিবর্তন করে মুজিব কি সাংঘাতিক ভুল করেছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে জনাব নারায়ণ বলেন, ‘মুজিবকে বিচার করার জন্য বিচারকের আসনে বসা আমার পক্ষে সম্ভব না।’ যে কোন ঘটনায় তিনি সামান্য অস্ত্রে সজ্জিত আক্রমণাত্মক বাংলাদেশ বাহিনীর মধ্যে অহিংস প্রতিরোধের লক্ষণ দেখেছেন। একজন সত্যিকারের গান্ধীবাদী হিসেবে জনাব নারায়ণ বলেন, একটি পরিস্থিতি যা মানুষের মর্যাদা অসম্মানজনক অবস্থায় পরিচালিত করতে পারে, এমতাবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই অস্ত্র হাতে নেয়া পরিস্থিতির দাবি হয়ে ওঠে। তারপর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ওঠে- ভারতের কি করা উচিত? জনাব নারায়ণ কোন শর্ত ছাড়াই পরিষ্কার করে বলেন যে, এমনকি আমি আগেও বলেছি বাংলাদেশ সরকার গঠন এবং আবারও বলছি ভারতকে অবশ্যই বাংলাদেশের ধারণা স্বীকার এবং যথাসম্ভব সহযোগিতা করতে হবে। এটা বোধগম্য হতে পারে যে, এটা ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য পরিচালিত করতে পারে কিন্তু এটি একটি অনিবার্য ঝুঁকি। তিনি দ্রুত যোগ করেন যে, তিনি কোন যুদ্ধে প্ররোচিত করা ও ভারতের বিপক্ষে সামরিক উদ্যোগ চান না। ভারতের বাংলাদেশ স্বীকৃতির মাধ্যমে তিনি আশা করেন যে, আক্রান্ত এলাকাসমূহে অন্যান্য দেশের বস্তুগত সাহায্য পৌঁছাবে। জনাব নারায়ণ নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি উদ্বাস্তুদের নিরাপদে তাদের বাড়ি ফিরতে কত দিন সময় লাগবে। ছয় মাস, আবার এক বছরও লাগতে পারে। তবে তিনি আশা করেন যে তাদের প্রত্যাবর্তনের জন্য অনুকূল অবস্থা অবশ্যই তৈরি করা হবে এবং তার মানে এই যে, বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার সামরিক দাসত্বের সমূলে উৎপাটনের মাধ্যমে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×