ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাঁচাও সমুদ্র বাঁচাও পৃথিবী

প্রকাশিত: ০৮:৫০, ৯ জুলাই ২০১৯

বাঁচাও সমুদ্র বাঁচাও পৃথিবী

প্রতিবছর ৮ জুন আনুষ্ঠানিকতা ও আনন্দঘন পরিবেশের মধ্য দিয়ে বিশ্ব সমুদ্র দিবস পালন করা হয়। এই দিনে আমরা আমাদের জীবনে সমুদ্রের গুরুত্ব পুনরাবিষ্কারের চেষ্টা করে থাকি। সেমিনার, কর্মশালা এবং সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচারণামূলক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের মনে করিয়ে দিতে চাই যে, আমাদের বেঁচে থাকার জন্য সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্র (ইকোসিস্টেম) কতটা জরুরী। বিভিন্ন বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান আয়োজনের সঙ্গে আমাদের নিজেদের সম্পৃক্ত করার সময়, আমাদের নিজেদের এটা জিজ্ঞেস করা জরুরী যে, সাগর সুরক্ষায় আমরা যৌথভাবে কী করেছি, যার ওপর আমাদের জীবন নির্ভর করছে। একইভাবে, বিশ্ব সমুদ্র দিবসের এই একটি দিনে, আমাদের জীবনের ভার বহনকারী এই সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাকে এক দিনের জন্য স্মরণ করাই কি আমাদের জন্য যথেষ্ট ? অবশ্য এটাই কিন্তু প্রকৃত চিত্র নয়। দুঃখজনকভাবে সাগরসমূহ প্রাকৃতিক উৎসজাত ও মানবসৃষ্ট দূষণের ভারে অব্যাহতভাবে হুমকির সম্মুখীন। এসব কারণে ক্রমাগত সাগরের জীববৈচিত্র্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে এবং ফলে সমগ্র সাগরীয় বাস্তুতন্ত্র- ছলকে পড়া তেল, ছুড়ে ফেলা বিষাক্ত বর্জ্য, আবর্জনাও প্লাস্টিক পণ্য এবং নিঃসরিত ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ইত্যাদি দূষণমূলক উপাদানের মিলিত প্রভাবে ভীষণভাবে হুমকির মুখোমুখি। সচরাচর সাগরে দেখতে পাওয়া জিনিসগুলোর মাঝে প্লাস্টিক এককভাবে সবচেয়ে সাধারণ একটি উপকরণ, যা পরিবেশের জন্য প্রচন্ড ক্ষতিকর। কেননা এটি খুব সহজে পরিবেশে মিশে যায় না। হাজার হাজার টন তেল, ময়লা, পয়োবর্জ্য, কৃষিবর্জ্য, খামারবর্জ্য, জাহাজ থেকে ছলকে পড়া বর্র্জ্য এবং প্লাস্টিক প্রতিদিন আবর্জনা আকারে সাগরে এসে জমা হচ্ছে। সারা বিশ^ যখন এই রূঢ় বাস্তবতা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে এবং দূষণের বৈরী প্রভাব হ্রাসে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, এই অঞ্চলে আমরা তখন কী করছি? বঙ্গোপসাগর সবচেয়ে সঙ্গীন দূষণ আক্রান্ত এলাকাসমূহের একটি। একই সঙ্গে সাইক্লোন, বজ্রঝড়, বন্যা, ভূমিক্ষয় এবং লবণাক্ততার মতো যে সব প্রাকৃতিক দুর্যোগসমূহ সাধারণত মানবসৃষ্ট দূষণের প্রভাবে সংগঠিত হয়ে থাকে, বঙ্গোপসাগর এ রকম দুর্যোগপ্রবণ একটি অঞ্চল। এ ছাড়াও এসব মানবসৃষ্ট দূষণের কারণে আমাদের ভয়াবহ মাশুল গুনতে হচ্ছে। যে সকল দূষক পদার্থ খাল ও নদীবাহিত হয়ে আসে চূড়ান্ত পর্যায়ে তা বঙ্গোপসাগরে এসে বড় আকারের দূষণ সৃষ্টি করে। প্রতিবছর আমাদের বন্দরসমূহে তিন হাজারেরও বেশি জাহাজ ও তেলবাহী জাহাজ তথা ওয়েল ট্যাঙ্কার যাতায়াত করে আসছে সেগুলো পর্যন্ত নিয়মিতভাবে যে সকল তরল ও তৈল বর্জ্য বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করে আসছে, তা মোকাবেলায়ও আমাদের কার্যকর দূষণ নিরোধী আইন এবং দূষণের বিপরীতে চাপানো ট্যাক্স আইন খুবই অপ্রতুল। তা ছাড়া চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকাজুড়ে অবস্থিত জাহাজভাঙ্গা ইন্ডাস্ট্রি অপ্রতিহতভাবে সাগরে তেল ও কঠিন বর্জ্য নিক্ষেপ করেই যাচ্ছে। এই সবকিছু বিবেচনায় নিলে, আমাদের সাগর দূষণের বাস্তব চিত্র খুবই ভয়াবহ এবং এখনই এতে সাড়া দেয়া প্রয়োজন। প্রায় চল্লিশ বছরেরও অধিককাল যাবত বঙ্গোপসাগরে কাজ করা এবং আরো অসংখ্য সাগরে ভ্রমণের সুবাদে আমরা পক্ষপাতহীনভাবে এ কথা স্বীকার করতে পারি যে, আমাদের জীবন রক্ষাকারী বঙ্গোপসাগরের দূষণ রোধে কিছুই করিনি। আমাদের সত্বর তৎপর হওয়া প্রয়োজন। কারণ সময় খুব দ্রুতই গড়িয়ে যাচ্ছে। আমরা যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করি, তাহলে সত্যিই দেরি হয়ে এটা আমাদের দেশের সমগ্র বাস্তুতন্ত্রকে (ইকোসিস্টেম) আক্রান্ত করে গলাটিপে আমাদের জীববৈচিত্র্যকে হত্যা করতে পারে। সম্প্রতি যারা চট্টগ্রাম পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত ঘুরে এসেছেন, তাদের হয়ত স্মরণ আছে সমুদ্র উপকূলজুড়ে পানির রং সব সময়ই বাদামী এবং কর্দমাক্ত এবং সারা বছরই তা একই রকম থাকে। কিন্তু আজ থেকে পনেরো বছর আগেও যাদের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত ভ্রমণের সৌভাগ্য হয়েছিল, তারা স্পষ্টই মনে করতে পারবেন তখন শীতকালে সেখানকার পানি নীল রঙে পরিণত হতো। আর বর্ষাকাল ঘনিয়ে আসার আগ পর্যন্ত এর আগের কয়েক মাসজুড়ে পানির সেই রং অপরিবর্তিতই থাকত। সত্তর দশকের শেষ দিকের একজন তরুণ নাবিক হিসেবে শীত ও বসন্ত জুড়ে পতেঙ্গা সৈকত জুড়ে আমি নিয়মিত নীলজল দেখেছি। তেমনটা এখন আর দেখতে পাওয়া যায় না। এখন সারা বছর সেখানকার পানি বাদামী ও ঘোলাটে থাকে। মাত্রাতিরিক্ত মানবসৃষ্ট দূষণের প্রভাবেই এমনটা ঘটছে। আমরাই এই দৈত্যের জন্ম দিয়েছি। এবার এ সম্পর্কিত আমার আরও একটি অভিজ্ঞতার কথা বলতে চাই। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের একমাত্র উপকূলবর্তী দ্বীপ। আশির দশকের শুরুর দিকে আমরা এই দ্বীপটির চারপাশ দিয়ে জাহাজে করে নিয়মিত ঘুরে আসতাম। সে সময় আমরা দ্বীপটির দক্ষিণ-পূর্ব পাশে বরাবরই অসংখ্য জীবন্ত কোরাল দেখতাম। এর কিছু কিছু কোরাল ছিল বিচিত্র আকার ও আকৃতির; আর উজ্জ্বল সব রঙে আশ্চর্য রকমের বর্ণিল। আজকাল আমরা সেন্ট মার্টিনের আশপাশ জুড়ে একটিও কোরাল দেখতে পাই না। কোরাল দ্বীপের বাস্তুতন্তু মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াই এর কারণ। এরই মধ্যে আমরা আমাদের সমুদ্র সম্পদের এ ধরনের আরও বেশকিছু ক্ষতিসাধন করেছি, যার কারণ মূলত দূষণ এবং বঙ্গোপসাগরের বাস্তুতন্ত্রের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব। আরও কোন ক্ষতি হয়ে যাবার আগেই দায়িত্বের সঙ্গে আমাদের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নিরাপদে ও শান্তিতে জীবনযাপন করতে আমাদের নিশ^াসের জন্য বাতাস, পান করার জন্য জল, খাওয়ার জন্য খাবার, সেই সঙ্গে ওষুধ ও নিরাপদ একটি জলবায়ুর দরকার। আমরা যাদের লালন পালন করে বড় করছি আমাদের সেই সব সন্তান-সন্ততির জন্য আমরা নিরাপদ একটি ভবিষ্যত চাই। আমাদের বেঁচে থাকা ও উন্নতির জন্য আমাদের স্বাস্থ্যকর সব সমুদ্র দরকার। সাগর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাস্তুতন্ত্র। এটাই এই গ্রহের জীবনের ভার বহনকারী ব্যবস্থা। আমরা নিশ^াসের সঙ্গে যে অক্সিজেন গ্রহণ করছি, তার অর্ধেক এই সাগর প্রস্তুত করে এবং সাগর সব সময় পৃথিবীর ৯৭ ভাগ পানি ধারণ করে। লোকেরা যে সব প্রাণিজ আমিষ খেয়ে থাকে তার অন্তত ছয় ভাগের এক ভাগ আমিষ আসে সাগর থেকে। সাগর আমাদের আবহম-ল থেকে পঞ্চাশ গুণ বেশি হারে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে জলবায়ু পরিবর্তন হ্রাস করে থাকে। নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে মেরু অঞ্চলের দিকে তাপ পরিবহন করে সাগর জলবায়ু এবং আবহাওয়ার ধরন নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। সাগরের এই বৈচিত্র্য এবং উৎপাদনশীলতা সমগ্র মানবজাতির জন্য খুবই অপরিহার্য। আমাদের নিরাপত্তা, আমাদের অর্থনীতি, আমাদের টিকে থাকা, এই সবকিছুর জন্যই দরকার স্বাস্থ্যকর সমুদ্র। আমাদের নিজস্ব লাভালাভের জন্যই সাগরকে সুরক্ষা দেয়া প্রয়োজন। কেবল সমুদ্র দিবসে নয়, বরং প্রতিদিন এটাই আমাদের শপথ হতে হবে। আমাদের ছোট্ট একটু পদক্ষেপ দীর্ঘ মেয়াদে বিশাল এক পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে। চলুন আমরা আমাদের কার্বন পদাঙ্কের কথা ভেবে এখনই আমাদের জ্বালানি ব্যবহার হ্রাস করি। চলুন আমরা আমাদের প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার কমাই এবং আমাদের সৈকতগুলোর যত্ন নেই। চলুন আমরা সাগর এবং সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে নিজেদের শিক্ষিত করে তুলি এবং সমাজকে বদলাতে অনুপ্রাণিত করি। চলুন শুধু ৮ জুন নয়, বরং আমরা আজই সতর্ক হই এবং প্রতিদিন সতর্ক থাকি। চলুন নিজেদের বেঁচে থাকার স্বার্থে এবং আমাদের এই সবুজ গ্রহকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সাগরসমূহকে সুরক্ষিত রাখি। লেখক : সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব মেরিটাইম রিসার্চ এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিমরাড)
×