ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অমানুষিক নির্যাতন করা হয় শিশু সায়মাকে ॥ রোমহর্ষক বর্ণনা

ছাদ দেখানোর কথা বলে ধর্ষণের পর হত্যা

প্রকাশিত: ১০:১৯, ৮ জুলাই ২০১৯

 ছাদ দেখানোর কথা বলে ধর্ষণের পর হত্যা

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ ওয়ারীর বনগ্রামে স্কুলছাত্রী শিশু সামিয়া আফরিন সায়মাকে (৭) ছাদ দেখানোর কথা বলে ভবনের নবনির্মিত ৯ তলার ফাঁকা ফ্ল্যাটে নিয়ে যায় ধর্ষক নরপশু হারুন অর রশিদ। সেখানে শিশু সায়মাকে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে তাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। একপর্যায়ে সায়মা নিস্তেজ হয়ে পড়লে তার গলায় দড়ি পেঁচিয়ে টেনেহিঁচড়ে রান্নাঘরে নিয়ে সায়মাকে সিঙ্কের নিচে রেখে পালিয়ে যায় পাষ- হারুন। রবিবার দুপুরে এভাবে অবুঝ শিশু সায়মা হত্যার রোমহর্ষক বর্ণনা দেন অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) আবদুল বাতেন। এদিকে এ সময় শিশুটির বাবা আবদুস সালাম দুঃখ, কষ্ট ও বেদনায় জানান, ধর্ষণ ও হত্যার মূল আসামি হারুন অর রশিদের দ্রুত সময়ে ফাঁসি কার্যকর করা হোক। দেশবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, গত দু’দিন ধরে আমি এক ফোঁটা পানিও খেতে পারিনি। ঘরে গেলে মেয়ের কাপড়-চোপড়, ছবি দেখে আর ঠিক থাকতে পারি না। আমার পুরো পরিবারটা বিধ্বস্ত হয়ে গেল। আমি আমার মেয়েকে দেখে রাখতে পারিনি। যাদের সন্তান আছে তারা এসব কুরুচিপূর্ণ ব্যক্তির কাছ থেকে কীভাবে আপনার সন্তানদের দূরে রাখবেন বিষয়টি ভেবে দেখবেন। অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল বাতেন জানান, এ ধরনের ঘটনা অত্যন্ত কুরুচির পরিচায়ক। মানবতাবিরোধী অপরাধ। এ ধরনের অপরাধীরা সাধারণত ধর্ষণের পর যখন ভাবে এ অপকর্মের কারণে সে বাঁচতে পারবে না তখনই হত্যার মতো ঘটনা ঘটায়। এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটিয়েছে ঘাতক হারুন। তিনি বলেন, ঘটনার দিন শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সাড়ে ছয়টার মধ্যে এ ঘটনা ঘটে। ওইদিন সাময়া তার মাকে বলে যায়, ভবনের আট তলায় ফ্ল্যাট মালিক পারভেজের ছোট বাচ্চার সঙ্গে সে খেলবে। ওই ফ্ল্যাটে গেলে পারভেজের স্ত্রী জানান, তার মেয়ে ঘুমাচ্ছে। সেখান থেকে বাসায় ফেরার উদ্দেশে লিফটে ওঠে সায়মা। লিফটেই সায়মার সঙ্গে দেখা হয় পারভেজের খালাত ভাই হারুনের। হারুন সায়মাকে লিফট থেকে ছাদ দেখানোর প্রলোভন দেখিয়ে ছাদে নিয়ে যায়। সেখানে অত্যন্ত পাশবিকভাবে সায়মাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। এরপর সে জোরপূর্বক ধর্ষণের চেষ্টা করলে সায়মা চিৎকার দেয়। এ সময় সে সায়মার মুখ চেপে ধরে ধর্ষণ করে। পরে সায়মাকে নিস্তেজ দেখে তার গলায় দড়ি পেঁচিয়ে টেনে ফ্ল্যাটের রান্নাঘরে নিয়ে যায়। এরপর সায়মার লাশ সিঙ্কের নিচে রেখে ঘাতক হারুন পালিয়ে তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার তিতাস থানার ডাবরডাঙ্গায় চলে যায়। পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, অভিযুক্ত আসামি হারুন ওই ভবনের ফ্ল্যাট মালিক পারভেজের খালাত ভাই। গত দুই মাস ধরে পারভেজের বাসায় থাকত। তিনি জানান, পুরান ঢাকায় পারভেজের রঙের দোকানে কাজ করত হারুন। শিশু ধর্ষণের ঘটনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ উল্লেখ করে অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল বাতেন বলেন, এ ধরনের অপরাধীরা সাধারণত ধর্ষণের পর যখন মনে করে বিষয়টি জানাজানি হবে। নিজে রেহাই পাবে না। ঠিক তখনই ভুক্তভোগীকে হত্যা করে। মূলত অপরাধ ঢাকতে গিয়ে সায়মাকে হত্যা করেছে হারুন। পুলিশের এই উর্ধতন কর্মকর্তা জানান, সায়মাদের পরিবারের সঙ্গে পারভেজের পরিবারের ভাল সখ্য ছিল। তবে এই ঘটনায় অন্য কোন কারণ বা কেউ জড়িত ছিল না। হারুন এটা একাই ঘটিয়েছে। বাতেন বলেন, গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে আসামি হারুন ধর্ষণ ও হত্যার কথা স্বীকার করেছে। হারুনকে মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আজই আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ড চাওয়া হবে। সায়মার বাবার আকুতি ॥ সংবাদ সম্মেলনে সায়মার বাবা ব্যবসায়ী আবদুস সালাম জানান, আমার অবুঝ মেয়ে সায়মাকে (৭) ধর্ষণ ও হত্যার মূল আসামি হারুন অর রশিদের দ্রুত সময়ে ফাঁসি কার্যকরের দাবি জানাই। এভাবেই আকুতি জানায় নিহত শিশু সামিয়ার হতভাগ্য বাবা। তিনি বলেন, অল্প সময়ের মধ্যে মূল আসামিকে চিহ্নিত করতে পেরেছে পুলিশ। তাকে ধরতে পেরেছে। আমি চাই দ্রুত সময়ের মধ্যে, তিন মাস থেকে ছয় মাসের মধ্যে তাকে প্রকৃত শাস্তি দেয়া হোক। সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হোক। সে যেহেতু আমার মেয়েকে দুই রকম নির্যাতন করে হত্যা করেছে। তাকে ছয় মাসের মধ্যে ফাঁসি দেয়া হোক। এ সময় তিনি দেশবাসীর উদ্দেশে বলেন, আমি আমার মেয়েকে দেখে রাখতে পারিনি। যাদের সন্তান আছে তারা এসব কুরুচিপূর্ণ ব্যক্তির কাছ থেকে কীভাবে আপনার সন্তানদের দূরে রাখবেন বিষয়টি ভেবে দেখবেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে মেয়েটা আমার স্ত্রীকে বলে ১০ মিনিটের জন্য বাইরে গেল। এরপর আমার মেয়েটা আর ফিরল না। তাকে নৃশংসভাবে খুন করা হলো। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ সময় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। বাকরুদ্ধ কণ্ঠে সায়মার বাবা জানান, গত দু’দিন ধরে আমি এক ফোঁটা পানিও খেতে পারিনি। ঘরে গেলে মেয়ের কাপড়-চোপড়, ছবি দেখে আর ঠিক থাকতে পারি না। আমার পুরো পরিবারটা বিধ্বস্ত হয়ে গেল। সংবাদ সম্মেলনে ওয়ারী বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপ-কমিশনার (ডিসি) ইফতেখার আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। নিহত সায়মার বাবা আবদুস সালাম নবাবপুরের একজন ব্যবসায়ী। গত ফেব্রুয়ারিতে ওই ভবনে ফ্ল্যাট কেনার পর তিনি পরিবার নিয়ে সেখানে ওঠেন। নিহত সায়মা পুরনো ঢাকার ওয়ারীর সিলভারডেল স্কুলের নার্সারির ছাত্রী ছিল। ২ বোন ও ২ ভাইয়ের মধ্যে সামিয়া সবার ছোট। সে ওয়ারীর বনগ্রাম মসজিদ রোডের ১৬৯ নম্বর ৯ তলা ভবনের ষষ্ঠ তলায় থাকেন। নিহতের পারিবারিক সূত্র জানায়, শুক্রবার মাগরিবের নামাজের সময় সামিয়া নিখোঁজ হয়। পরে অনেক খোঁজাখুঁজির পর ওই ভবনের ৯ম তলার একটি ফাঁকা ফ্ল্যাটে শিশু সামিয়ার গলায় রশি পেঁচানো লাশ দেখতে পেয়ে পুলিশে খবর দেয়া হয়। পরে পুলিশ গিয়ে সেখান থেকে শিশুটির লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠায়। ঘটনার পর সিআইডির ক্রাইম সিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও আশপাশে আলমত সংগ্রহ করে। শনিবার দুপুর ১টা ৫৪ মিনিটে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে শিশুটি সায়মার মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করার পর তার ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক ডাঃ সোহেল মাহমুদ সাংবাদিকদের জানান, প্রাথমিকভাবে তার শরীরে ধর্ষণের আলামত মিলেছে। হত্যার আগে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ধর্ষণের পর তাকে গলায় রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। সোহেল মাহমুদ জানান, ময়নাতদন্তে তার যৌনাঙ্গে ক্ষতচিহ্ন, মুখে রক্ত ও আঘাতের চিহ্ন, ঠোঁটে কামড়ের দাগ দেখা গেছে। এক প্রশ্নের জবাবে ঢামেক ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডাঃ সোহেল মাহমুদ জানান, এ বিষয়ে আরও স্পষ্ট হতে তার ‘হাই ভ্যাজাইনাল সয়াব’ জন্য ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। সকল নমুনা পরীক্ষাগারে পাঠানো হবে। এসব প্রতিবেদন পাওয়ার পর পূর্ণাঙ্গ তথ্য দেয়া হবে। পরে ময়নাতদন্ত শেষে তার বাড়িতে নেয়ার পর বিকেলে সায়মার লাশ আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। পুলিশ জানায়, শনিবার সকালে শিশুর বাবা আবদুস সালাম বাদী হয়ে ওয়ারি থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা করেছেন। ভবনের আশপাশের ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে যাচাই-বাছাই করা হয়। পরে সন্দেহে কয়েকজনকে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। এরপর ঘাতক হারুন উর রশীদকে শনাক্ত করে গ্রেফতার করা হয়।
×