ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

৩০ জুলাইয়ের মধ্যে সম্পন্ন হবে

পদ্মা সেতুর আর মাত্র দুটি পাইল বাকি

প্রকাশিত: ১০:২১, ৬ জুলাই ২০১৯

 পদ্মা সেতুর আর মাত্র দুটি পাইল বাকি

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মাওয়া থেকে ফিরে ॥ আষাঢ়ে বৃষ্টি নেই, প্রখর রোদ, তবুও পদ্মা উত্তাল। এই উত্তাল পদ্মাকে বশ মানিয়ে সেতু নির্মাণ সফলতার দিকে ধাবিত হয়েছে। মূল ভিত শেষ প্রায়। সেতুর ২৯৪ পাইলের মধ্যে ২৯২ পাইল হয়ে গেছে। বাকি মাত্র ২৬ ও ২৭ নম্বর খুঁটিতে একটি করে পাইল বসানো। দু’টি খুঁটিরই মাঝখানের অর্থাৎ ৭ নম্বর পাইলটি বাকি। এছাড়া আরও একটি পাইলের ওপরের টপ সেকশন বাকি আছে। এই পাইল সম্পন্ন করার কথা রয়েছে ১৫ জুলাই। তবে ৩০ জুলাইয়ের আগেই এই পাইলিং সম্পন্ন হচ্ছে এটি প্রায় নিশ্চিত বলে জানান পদ্মা সেতুর দায়িত্বশীল এক প্রকৌশলী। তিনি বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানির কেন্দ্রীয় অফিস চীন থেকে নির্দেশনা দিয়েছে ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে। সেতুর ভিত তৈরির এই মূল কাজ সম্পন্ন হওয়ার মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতুর নির্মাণযজ্ঞের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। তাই পাইল সম্পন্ন হওয়ার পরপরই সেলিব্রেশনের আয়োজন রাখা হয়েছে। এদিকে পদ্মা সেতুর ১৫তম স্প্যান বসানোর প্রস্তুতি চলছে মাওয়া প্রান্তের ১৬ ও ১৭ নম্বর খুঁটিতে। তবে এখনও তারিখ নির্ধারণ করা হয়নি। চলতি মাসেই এই স্প্যানটি বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে বলে দায়িত্বশীল প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন। এদিকে গত শনিবার বিকেলে পদ্মা সেতুর ১৪তম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে সেতুটি ২১০০ মিটার দৃশ্যমান হয়েছে । ‘৩-সি’ নম্বর এই স্প্যান মাওয়া প্রান্তে সেতুর ১৫-১৬ পিলারে স্থাপন করা হয়। মঙ্গলবার পদ্মা সেতুর সার্বিক অগ্রগতি সরেজমিন পরিদর্শনে আসেন পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুল মান্নান। তিনি পরিদর্শন শেষে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এই সময় পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক সফিকুল ইসলাম এবং নির্বাহী প্রকৌশলী (মূল সেতু) দেওয়ান আব্দুল কাদেরসহ দায়িত্বশীল কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন। পাইল বাকি মাত্র দুইটি ॥ পদ্মা সেতুর মোট ২৯৪ পাইলের মধ্যে পাইল ড্রাইভ সম্পন্ন হয়েছে ২৯২টি। এছাড়া আরও একটি পাইলের ওপরের টপ সেকশন বাকি আছে। বাকি দুইটি পাইলের কাজ শীঘ্র শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এরই মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতুর কাজের গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ সম্পন্ন হতে যাচ্ছে। পাইলিংয়ের পরপরই মাটি অপসারণ করে রড সেট করে কংক্রিটিং দ্রুত শুরু হয়ে যায়। তাই পিয়ার ওপরে উঠতে অপেক্ষাকৃত সময় কম লাগে। এখন থেকে নদীতে দৃশ্যমান হতে থাকবে একের পর এক আরও পিয়ার। একই সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে স্প্যান বসানোর কাজ। সেতুর মোট ৪২টি পিলারের মধ্যে ইতোমধ্যে ২৯টির পিলার পুরোপুরি তৈরি সম্পন্ন করা হয়েছে। এখন শুধুমাত্র জাজিরা প্রান্তে সেতুর ২৬ ও ২৭ নম্বর পিলারে পাইলের কাজ চলছে। ২৬ ও ২৭ নম্বর পিলারে সাতটি পাইলের মধ্যে ৬টি পাইল ড্রাইভ সম্পন্ন হয়ে গেছে। এখন বাকি রয়েছে শুধু মাঝখানের একটি করে পাইল। এই দুই খুঁটিতে খাঁজকাটা (ট্যাম) সাতটি করে পাইল বসছে। ৩৫ কিলোজুল ক্ষমতার হ্যামারটি এখানে পাইল ড্রাইভ করছে। তবে স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছে ২৪শ’ কিলোজুল ক্ষমতার হ্যামারটিও। আর অলস বসে আছে ১৯শ’ কিলোজুল ক্ষমতার হ্যামারটি। এই ২৬ ও ২৭ নম্বর দুই খুঁটির পাশ দিয়েই শিমুলিয়া থেকে কাওড়াকান্দির ফেরি চ্যানেল প্রবাহিত। তাই ড্রেজিং করে ফেরি চ্যানেলের জায়গা প্রশস্ত করে ২৫ ও ২৬ নম্বরের মাঝখান দিয়ে চ্যানেলটি প্রবাহিত হচ্ছে। বিকল্প চ্যানেল করে দিয়ে এই দুই খুঁটি নির্মাণ শুরু হয়। আর এই খুঁটির মধ্য দিয়েই পাইলের বিশাল কর্মযজ্ঞের পরিসমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে। পদ্মা সেতুর পিলারের একেকটি পাইল লোড ৮ হাজার ২০০ টন। জার্মানি থেকে আনা বিশাল বিশাল ৩টি হ্যামারের প্রয়োজনীয়তাও আর থাকছে না। অথচ ক’দিন আগেও এই হ্যামারই ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণযন্ত্র। একের পর এক স্প্যান বসে যাচ্ছে ॥ একের পর এক স্প্যান বসে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত ১৪টি স্প্যান বসলেও শীঘ্রই আরও কয়েকটি স্প্যান বসতে যাচ্ছে। কারণ পিয়ার (খুঁটি) প্রস্তুত হয়েছে। ওদিকে স্প্যানও প্রস্তুত হয়ে আছে। এছাড়াও চীন থেকে আরও স্প্যান এখন মাওয়ার পথে। এদিকে মংলায় একটি স্প্যান পৌঁছানোর কথা রয়েছে ২/১ দিনের মধ্যেই। পদ্মা সেতুর ১৫০ মিটার দীর্ঘ ৪১টি স্প্যান প্রয়োজন। এর মধ্যে ২৪টি স্প্যান দেশে এসেছে। এর মধ্যে ১৪টি খুঁটিতে উঠেছে। আরও দু’টি মাঝের চরে ড্রেজিং করে নদী তীরে প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে সেখানে স্টোর করা হয়েছে। আরও আটটি স্প্যান রয়েছে কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে। সেখানে ফ্রিটিং করে বসানোর জন্য প্রস্তুত রয়েছে বা করা হচ্ছে। আরও দু’টি স্প্যান কয়েকদিনের মধ্যেই মাওয়া পৌঁছবে। জাজিরা প্রান্তে ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বসানো হয় প্রথম স্প্যান। এর প্রায় চার মাস পর ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি দ্বিতীয় স্প্যানটি বসে। দেড় মাস পর ১১ মার্চ এ প্রান্তে ধূসর রঙের তৃতীয় স্প্যান বসানো হয়। দু’মাস পর ১৩ মে বসে চতুর্থ স্প্যান। এক মাস ১৬ দিনের মাথায় পঞ্চম স্প্যানটি বসে ২৯ জুন। তারপর ছয় মাস ২৫ দিনের মাথায় ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি বসে ষষ্ঠ স্প্যান। এর ২৮ দিনের মাথায় ২০ ফেব্রুয়ারি বসে সপ্তম স্প্যানটি। এর একমাস পরে ২২ মার্চ বসে অষ্টম স্প্যান। এরপর ১০ এপ্রিল বসে দশম স্প্যান। এর ১৩ দিনের মাথায় ২৩ এপ্রিল বসে একাদশ স্প্যান। এর ১২ দিনের মাথায় দ্বাদশ স্প্যানটি অস্থায়ীভাবে বসে চলতি মাসের ৫ মে। আর মাওয়া প্রান্তে একটি মাত্র অস্থায়ীভাবে স্প্যান বসানো হয় ২০১৮ সালের ১২ অক্টোবর। পুরো সেতুতে ২ হাজার ৯৩১টি রোডওয়ে স্ল্যাব বসানো হবে। আর রেলওয়ে স্ল্যাব বসানো হবে ২ হাজার ৯৫৯টি। ২০১৪ সালের ১২ ডিসেম্বরে মূল সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। সেতু নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) ও নদী শাসনের কাজ করছে দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ বহুমুখী সেতুর মূল আকৃতি হবে দোতলা। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে এ সেতুর কাঠামো। পুরো সেতুতে ২ হাজার ৯৩১টি রোডওয়ে স্ল্যাব বসানো হবে। আর রেলওয়ে স্ল্যাব বসানো হবে ২ হাজার ৯৫৯টি। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ৪২টি খুঁটির মধ্যে এ পর্যন্ত ২৯টি খুঁটি সম্পন্ন হয়েছে। ৪১টি স্প্যানের এ পর্যন্ত ১৪টি স্প্যান বসেছে। মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কো¤পানি (এমবিইসি) ও নদী শাসনের কাজ করছে দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ বহুমুখী সেতুর মূল আকৃতি হবে দোতলা। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে এ সেতুর কাঠামো। তবে সংযোগ সেতুসহ পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য প্রায় ৯ কিলোমিটার। জাজিরা প্রান্তে আই-গার্ডার সম্পন্ন ॥ পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তের ভায়াডাক্টে রেলওয়ে স্প্যানের সবগুলো আই-গার্ডার বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। জাজিরা প্রান্তে মোট ৪২টি আই-গার্ডার বসানোর হয়েছে। পদ্মা সেতুর সহকারী প্রকৌশলী আহসান উল্লাহ মজুমদার জানান, “আটটি পিলারে মোট ৪২টি গার্ডার বসানো হয়েছে। রেল চলাচলের জন্য এসব গার্ডার বসানো হয়।” প্রকৌশল সূত্রে জানা যায়, ৩৮ মিটার দৈর্ঘ্যরে মোট ৮৪টি আই-গার্ডার বসবে পদ্মা সেতুতে। এর মধ্যে জাজিরা প্রান্তে ৪২টি ও মাওয়া প্রান্তে ৪২টি। রবিবার বিকেলে জাজিরা প্রান্তের ৪২টি আই-গার্ডার বসানোর কাজ শেষ হওয়ায় ২৬৬ মিটার দৃশ্যমান হলো। তবে মাওয়া প্রান্তের আই-গার্ডার বসানোর কাজ তিন মাস পরে শুরু হবে। জাজিরা প্রান্তে প্রতি ৬টি আই-গার্ডার নিয়ে একটি স্প্যান সম্পূর্ণ হয়। ৪২টি আই-গার্ডারে মোট ৭টি স্প্যান। স্প্যানগুলো হলো জে-১, জে-২, জে-৩, জে-৪, জে-৫, জে-৬, জে-৭। এই স্প্যানের ওপরে স্ল্যাব বসবে এবং স্ল্যাবের উপরে রেললাইন বসানো হবে। গত ১৯ এপ্রিল এই আই-গার্ডার স্থাপন শুরু হয়েছিল। প্রায় ৬৫ দিনে এই গার্ডার স্থাপন সম্পন্ন হল।
×