ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গণপরিষদ সদস্যদের কনফারেন্স ॥ ৬ জুলাই, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৯:৫৪, ৬ জুলাই ২০১৯

  গণপরিষদ সদস্যদের কনফারেন্স ॥ ৬ জুলাই, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ৬ জুলাই দিনটি ছিল মঙ্গলবার। এই দিন দাউদকান্দি থানার মাছিমপুর বাজারের আধমাইল পশ্চিমে জয়পুর গ্রামে গোমতীর শাখা নদীর পারে হাবিলদার গিয়াসের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা দল দাউদকান্দি থেকে আগত পাকসেনাবাহী দুটি লঞ্চকে এ্যামবুশ করে। এতে উভয়পক্ষের মধ্যে তুমুল গোলা বিনিময় হয়। এই সংঘর্ষে ২০/২৫ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং পাকবাহিনী পিছু হটে দাউদকান্দি ফিরে যায়। কুমিল্লার পাকবাহিনীর এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য মন্দাভাগ বাজার থেকে শালদা নদী এনক্লেভের দিকে অগ্রসর হলে ২নং সেক্টরের ‘এ’ ও ‘সি’ কোম্পানি যথাক্রমে মেজর সালেক এবং ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে প্রচন্ড বাধা দেয়। এতে পাকসেনারা কামানের সাহায্যে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে তীব্র গোলাবর্ষণ করে। এই গোলাবর্ষণে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়। এবং ৩২ জন বেসামরিক লোক হতাহত হয়। প্রচ- গোলাবিনিময়ের পর পাকসেনারা পিছু হটে মন্দভাগ বাজারে অবস্থান নিতে বাধ্য হয়। কুমিল্লার-চাঁদপুর রাস্তায় হবিগঞ্জের নিকট রামচন্দ্রপুর ফেরিঘাটে পাকবাহিনীর একদল সৈন্যকে মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানি আক্রমণ চালায়। প্রায় একঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। পরে চাঁদপুর থেকে দু’কোম্পানি সৈন্য পাকসেনাদের সাহায্য করতে এলে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং ৩১ জন পাকসৈন্য নিহত ও ৫৪ জন আহত হয়। অপরদিকে দু’জন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতরভাবে আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা সিলেটের দিরাই থানা আক্রমণ করলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও একজন দালাল নিহত হয়। থানা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে। পাকিস্তানী বাহিনী ঝিনাইগাতীর রাঙামাটি খাঠুয়াপাড়া গ্রামে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। এতে প্রাণ হারায় মুক্তিযোদ্ধাসহ বেশ কয়েকজন গ্রামবাসী। ৫ জুলাই কাঁটাখালী ব্রিজ এবং তিনানি ফেরি ধ্বংসের সফল অপারেশন শেষ করে মুক্তিযোদ্ধারা রাঙামাটি খাঠুয়াপাড়া গ্রামে দুটি দলে বিভক্ত হয়ে হাজী নঈমুদ্দিন ও হাজী শুকুর মামুদের বাড়িতে আশ্রয় নেন। খবর পেয়ে আজ সকালে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই গ্রামে ঢোকার একমাত্র কাঁচা সড়কে দুদিক থেকে ব্যারিকেড দেয় পাকিস্তানী বাহিনী ও রাজাকার, আলবদররা। মুক্তিযোদ্ধারা বিলের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মরক্ষার্থে গুলি করতে করতে পিছু হটে। এ সময় পাকহানাদারদের বেপরোয়া গুলিতে কোম্পানি কমান্ডার এন এম নাজমুল আহসান, তার চাচাত ভাই মোফাজ্জল হোসেন ও ভাতিজা আলী হোসেন শহীদ হন। বাকি মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান পেলেও, বর্বরোচিত হামলার শিকার হন রাঙামাটি খাঠুয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দারা। তাদের ৬০-৭০ জনকে কোমরে দড়ি বেঁধে নির্যাতন করা হয়। তাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়ার অপরাধে অমানবিক নির্যাতনের পর লাইনে দাঁড় করিয়ে ৯জন গ্রামবাসীকে নৃশংসভাবে হত্যা ও ৬জন নারীকে ধর্ষণ করা হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বিশেষ দূত হিসেবে পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো ইরান ও আফগানিস্তান সফরের প্রথম পর্যায়ে তেহরানের উদ্দেশে করাচী ত্যাগ করেন। পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জেনারেল এ.এম. কে. নিয়াজি সিলেট এলাকার সীমান্ত ঘাঁটিসমূহ পরিদর্শন করেন এবং জোয়ানদের মনোবল অটুট রাখার পরামর্শ দেন। সিলেটে শান্তি কমিটির নেতা মকবুল আলী চৌধুরী, শাহাবুদ্দিনসহ ৫ সদস্যের একটি দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রধান নূরুল আমিনের সঙ্গে দেখা করে কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করেন। শায়খে জামিয়া ইমদাদিয়া কিশোরগঞ্জ শাখার প্রাক্তন সদস্য সচিব মওলানা আতাহার আলী, পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষায় ‘মুজাহিদ বাহিনী’-তে সকল মাদ্রাসার ছাত্র, শিক্ষক ও পাকিস্তানের আদর্শে বিশ্বাসী ইসলাম প্রিয় যুবকদের যোগ দেয়া অবশ্য কর্তব্য বলে জানান। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সাবেক ডেপুটি স্পীকার এ.টি.এম. আবদুল মতিন ইয়াহিয়াকে সত্যিকার ‘গণতন্ত্রী’ আখ্যায়িত করে বলেন, পাকিস্তানের অখন্ডতা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রেসিডেন্টের আন্তরিকতায় তিনি মুগ্ধ হয়েছেন। বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা এই মর্মে শপথ গ্রহণ করেছেন যে, তারা পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর হাত থেকে বাংলাদেশের সীমানা মুক্ত করবেন এবং আওয়ামী লীগ ও এর নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ও চেতনা অনুসরণ করবেন। তারা ইসলামাবাদের সঙ্গে কোনরকমের রাজনৈতিক সমঝোতার ধারণা সম্পূর্ণভাবে বাতিল করে দিয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌম ক্ষমতা দৃঢ় করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলের কোন এক জায়গায় আয়োজিত দুই দিনের কনফারেন্স আলোচনায় নির্বাচিত ৩৭৪ জন জনপ্রতিনিধি দৃঢ় সংকল্প ব্যাক্ত করেন। ১৩৫ জন এমএনএ ২৩৯ জন এমপিএ এই দিন (৬ জুলাই, ১৯৭১) এক কনফারেন্সে মিলিত হন। ৭ জুলাই, ১৯৭১ কনফারেন্স সমাপ্ত হয়। উল্লেখ্য, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মন্ত্রীবর্গ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম উদ্বোধনী বক্তব্যের মাধ্যমে সভা শুরু করেন এবং কিছু প্রস্তাবনা গ্রহণের মাধ্যমে সভা সমাপ্ত হয়। জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ (প্রধানমন্ত্রী) এবং কর্নেল এম এ জি ওসমানী, কমান্ডার ইন চিফ, মুক্তিবাহিনী যে কিনা জাতীয় পরিষদেরও একজন সদস্য, সভার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন এবং অনেক মেম্বাররা আলোচনায় অংশ নেন। এদিন দৈনিক যুগান্তরের রিপোর্টে বলা হয়েছে, চারজনের যে ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভের জন্য ভারত ও পাকিস্তান ঘুরে গিয়েছেন তাদের কোন সাক্ষাতকার বা বিবৃতি প্রকাশ বা বেতার প্রচার পাকিস্তান সরকার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছেন। ঐ প্রতিনিধি দলের কার্যকলাপের ছবি তোলাও পাক সরকার নিষিদ্ধ করেছেন। সঙ্গে পাকিস্তান সরকার নতুন মিথ্যা কূটনৈতিক প্রচার শুরু করেছেন। পাক সরকার জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উত্থান্ট, শরণার্থী দফতরের হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দীন ও কয়েকটি বিদেশী মিত্র রাষ্ট্রের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন যে, ভারতীয় জেলে যেসব পাকিস্তানী রয়েছে তাদের প্রত্যাবর্তনে তারা যেন সাহায্য করেন। পাক বৈদেশিক দফতর থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশ হাঙ্গামার জন্য চা-বাগান, ব্যাংক, বাণিজ্যিক সংস্থা ও সরকারী কিছু সংখ্যক কর্মচারী ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে এবং ভারত সরকার নাকি তাদের গ্রেফতার করে জেলে পুরেছেন। পাকিস্তান সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনেও ভারতের বিরুদ্ধে এই মিথ্যা প্রচার চলছে। ভারত সরকার জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশ থেকে যেসব পশ্চিম পাকিস্তানী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছে তাদের সংবাদের জন্য পাকিস্তান সরকারের অনুরোধ ভারত সরকার ‘মানবতার ভিত্তিতে’ বিবেচনা করে দেখতে প্রস্তুত আছেন। তবে পাকিস্তানের জেলে যে ২৫০ জনেরও বেশি ভারতীয় এখন কষ্টভোগ করছেন আন্তর্জাতিক আইন ও বিধি অনুযায়ী তাদের কথাও পাকিস্তানকে বিবেচনা করতে হবে। পাক জেলে আটক এই ভারতীয়দের অপরাধ কি, তারা কেমন এবং কোথায় আছেন সে সম্পর্কে পাকিস্তানের কাছে চিঠি লিখে ভারত কোন জবাব পায়নি। বাংলাদেশের যেসব লোককে ভারতে আটক করে রাখা হয়েছে বলে পাকিস্তান মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছে এবং যাদের নামের তালিকা পাক সরকার দিয়েছে তারা সংখ্যায় মাত্র ৩১ জন এবং সকলেই পশ্চিম পাকিস্তানী, তারা পূর্ববঙ্গের লোক বলে পাক সরকার যে দাবি করেছেন তা মিথ্যা। জনৈক সরকারী মুখপাত্র বলেন যে, বাংলাদেশ থেকে ৭০ লাখ লোক ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন কিন্তু তাদের জন্য পাক সরকারের কোন মাথাব্যথা নেই। মাত্র ৩১ জন পশ্চিম পাকিস্তানীর জন্যই পাক সরকার চিন্তিত। পাকিস্তানের জেলে আটক ভারতীয়দের মধ্যে সাংবাদিকরাও আছেন। ভারতীয় সীমান্ত এলাকা থেকে এপ্রিলের গোড়ার দিকে তাদের অপহরণ করা হয়েছে। তাদের খবরা খবরের জন্য পাক সরকারের কাছে চিঠি লিখেও কোন জবাব পাওয়া যায়নি। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×