ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মতি লাল দেব রায়

রেলপথ হোক নিরাপদ যাতায়াতের মাধ্যম

প্রকাশিত: ০৯:৫৩, ৬ জুলাই ২০১৯

 রেলপথ হোক নিরাপদ যাতায়াতের মাধ্যম

বিশ্বে সবচেয়ে নিরাপদ ও আরামদায়ক যানবাহন হচ্ছে রেল। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৫০-এর অধিক জেলার মধ্য দিয়ে রেলগাড়ি যাতায়াত করে, রেলওয়ে লাইন এর দৈর্ঘ্য হবে ২৮৮৫৫, মোট ৪৯৮টি রেলস্টেশন আছে। রেলওয়ের মোট কর্মকর্তা কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৩৫,০০০ হাজার, ১৮৬২ সালে বাংলাদেশে প্রথম রেললাইন স্থাপিত হয়। এক সময় বাংলাদেশে রেল যাতায়াত নিরাপদ ও আরামদায়ক ছিল কিন্তু নানা সময়ে কিছু দুর্নীতিপরায়ন কর্মকর্তার কারণে বাংলাদেশে রেলওয়ে লোকসানী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এই সংস্থাটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে দেশের উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপ ছাড়া সমস্যাগুলো সমাধান করা সম্ভব নয় বলে আমার ধারণা। সিলেট লাইনে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে যে লাইনের ওপর দিয়ে এতগুলো বগি নিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী যাতায়াত করছে তারা জানে না তারা কত ঝুঁকিপূর্ণ রেললাইনের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা থেকে সিলেট যাওয়ার পথে অসংখ্য রেলওয়ে স্টেশন দেখতে পাবেন কোনটা একেবারে বন্ধ, কোনটা খোলা, কোন স্টেশনে দেখবেন টিকেট বিক্রি হচ্ছে, কোন স্টেশনে দেখা যাবে স্টেশন মাস্টার ছাড়া লাইনমেন বা অন্য কেউ টিকেট বিক্রি করছে। এই স্টেশনগুলোতে স্থানীয় ট্রেনগুলো থামে, এই লোকাল ট্রেনগুলো দেখলে মনে হবে, যেন সেকেলে এক পরিত্যক্ত রেলগাড়ি কিছু যাত্রী সাধারণ নিয়ে যাচ্ছে, কিছু যাত্রী ছাদে, কিছু যাত্রী দেখবেন দুই বগির সংযোগস্থলে আর কিছু ভাসমান ছেলেমেয়ে ট্রেনের বগিতে মেঝেতে বসে টিকেটবিহীন গন্তব্যে যাচ্ছে। এই স্থানীয় ট্রেনগুলোর দিকে কেউ নজর দেয় না। সুশীল সমাজের কেউ এই ট্রেনগুলোতে উঠে না। তাই এই ট্রেন নিয়ে কেউ কোন কথা বলে না। দেখে মনে হবে বাংলাদেশ রেলওয়ের আইন এখানে অচল। ঢাকা রেলস্টেশন থেকে যখন ট্রেন ছেড়ে চলে তখন দুদিকে তাকালে দেখতে পাবেন হাজার হাজার আশ্রয়হীন ঘরবাড়িহীন দরিদ্র মানুষের তাঁবুঘর, রেললাইনের ওপর যেন তাদের স্থায়ী বাসস্থান। কিভাবে কাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এরা বছরের পর বছর ধরে রেললাইনের পাশে বসবাস করে তা খুঁজে বের করা দরকার। অবিলম্বে জনস্বার্থে, এদেরকে অন্য কোন সরকারী ভূমিতে পুনর্বাসন করা যায় কি-না সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। আন্তঃনগর ট্রেনে প্রতিটি বগিতে যাত্রীদের সেবা দেয়ার জন্য একজন করে কর্মী কর্মরত। কিন্তু বাস্তবে ট্রেন ছাড়ার সময় তাদের ট্রেনের বগিতে দেখা যায় কিছুক্ষণ পর তারা হয় ট্রেনের খাবার বগিতে অথবা অন্য কোন বগিতে এক সঙ্গে বসে আড্ডা দিয়ে সময় কাটায়। এদেরকে এই দায়িত্বে রাখার প্রয়োজন আছে কি-না কর্তৃপক্ষের ভেবে দেখা দরকার। লোকাল ট্রেনগুলোতে প্রায়শই দেখা যায়, ট্রেনের বগির সংযোগস্থলের মাঝখানে যাত্রী বসে দূর-দূরান্তে যায়, ট্রেনের ছাদে বসে বিনা টিকেটে যাত্রীরা রাত দিন ভ্রমণ করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে- তা কি রেল কর্তৃপক্ষ দেখেন না। বাথরুমের প্রয়োজনীয় সাবান টিসু পেপার দেখা যায় না। কোন কোন সময় বাথরুমে পানি থাকে না। ট্রেন চালু অবস্থায় বগির দরজা বন্ধ রাখার কথা কিন্তু সব বগির দরজা খোলা থাকে যা খুবই বিপজ্জনক। দুঃখজনক হলেও সত্য ট্রেনের বগিতে যে বাথরুম আছে সেই বাথরুম ব্যবহার করলে সরাসরি ময়লা রেললাইনের ওপর পড়ে। এতে অহরহ বায়ু দূষণ এবং পরিবেশ দূষণ করছে। পৃথিবীর কোন দেশে ট্রেনের বাথরুমের ময়লা চলন্ত ট্রেন থেকে রেললাইনের ওপর গিয়ে পড়ে এই রকম রেলগাড়ি চলে কি-না আমার জানা নেই। অবিলম্বে রেলগাড়ির বাথরুমে মানুষের বর্জ্য কিভাবে বগির নিচে থেকে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা যায় তার ব্যবস্থা করা জরুরী হয়ে পড়েছে। একবার সারাদেশের কথা চিন্তা করে দেখুন কি পরিমাণ মানুষের বর্জ্য রেললাইনের ওপর সরাসরি পরে এবং রোগজীবাণু বাতাসে মিশে জন স্বাস্থ্যের জন্য হুমকির সৃষ্টি করছে। রেললাইনের দিকে তাকালে মনে হয় বছরের পর বছর ধরে রেললাইন কেউ দেখাশোনা করেননি। রেললাইনের ওপর ঘাস উঠে গেছে। কুলাউড়ার বরমচাল বড়ছড়া ব্রিজ এলাকার উপবন ট্রেন দুর্ঘটনাস্থলের আশপাশে এখনও চোখে পড়ে চরম ঝুঁকিপূর্ণ জরাজীর্ণ রেললাইন। সবকিছুই আছে, কিন্তু নেই সততা, দায়িত্বশীলতা। বরমচালে যেখানে রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে সেই রেললাইনের দিকে চোখ দিলে দেখা যায় রেললাইনে ঘাস উঠে গেছে। রেললাইনের স্লিপারগুলো যেভাবে আটকানো হয়েছে, নেই নাট বল্টু, লাইনের আশপাশে নেই কোন পাথর, এই রেললাইন মৃত না জীবিত বোঝা যায় না। প্রশ্ন রেল বিভাগের হাজার হাজার কর্মী বাহিনী, কর্মকর্তারা কী করেন। কাদের দায়িত্ব রেললাইন দেখাশোনা করা? এত বড় একটি মন্ত্রণালয় থাকা অবস্থায় কেন রেললাইনের এই পরিণতি। কুলাউড়ার বরমচাল বড়ছড়া ব্রিজের নাট বল্টুতে ত্যানা ও সুতলি মেয়াদ উত্তীর্ণ ইঞ্জিন, জরাজীর্ণ বগি, পরিত্যক্ত রেললাইন, বিপজ্জনক রেল ক্রসিং, সিডিউল বিপর্যয় এটা হলো এ অঞ্চলের রেল বিভাগের চলমান ও দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। দেশের রেল লাইনের অবস্থা দেখলে মনে হয়, এই রেললাইনগুলো ব্যবহার হয় না, তার পরও এই রেললাইনের ওপর দিয়ে রেল চলছে দীর্ঘদিন ধরে। এমন নাজুক অবস্থার রেল লাইন কোন রকম জোড়াতালি দিয়ে সচল রাখা হয়েছে। যে কোন মুহূর্তে বিপদ ঘটার সম্ভাবনা আছে। রেল লাইনের সঙ্গে সংযুক্ত ক্লিপ-হুক, ফিসপ্লেট, নাট বল্টু, স্লিপার ক্রমেই দুর্বল হয়ে কার্যক্ষমতা হারাচ্ছে। রেল লাইনের ভেতর এবং বাইরে নেই পর্যাপ্ত পাথর। আর ওই রেলপথের নানা স্থানে ব্রিটিশ আমলের নির্মিত রেলসেতু ও কালভার্টসমূহের ওপর জীর্নশীর্ণ কাঠের স্লিপারের সঙ্গে পেরেক দিয়ে বাঁশের ফালি স্থাপন করে কোন রকম আটকানো হয়েছে রেললাইন। প্রতিবছরই ম্যান্টেনেন্স কাজ করার কথা থাকলে বাস্তবে কোন কাজ হয়েছে কি-না প্রমাণ পাওয়া যায় না। জানা যায়, এই রেললাইন দিয়ে ঘণ্টায় ৬০ কি.মি. বেগে প্রতিদিন যাত্রীবাহী আন্তঃনগর, লোকাল ও মালবাহী মিলিয়ে প্রায় ১০-১২টি ট্রেন ঝুঁকি নিয়েই চলাচল করছে। দ্রুত মেরামত কিংবা নির্মাণ না হলে ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। সিলেট আখাউড়া রেলপথের ১৭৯ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ২৫-৩০ টি সেতু ও কালভার্ট চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। আর বাকিগুলো আছে ঝুঁকিপূর্ণের তালিকায়। এছাড়া অনেক রেলওয়ে স্টেশন বন্ধ রয়েছে কিংবা জরাজীর্ণ অবস্থায় কোন রকম ঠিকে আছে। রেলওয়ের উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রত্যেক বছর প্রকল্প একনেকের সভায় পাস হয় কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। যদি বর্তমান রেলওয়ের জনবল বা প্রশাসন রেলকে জনগণের চাহিদা এবং সময় ঊপযোগী করতে অপারগ হন তাহলে নতুন এবং দক্ষ জনবল নিয়োগ দিয়ে অবিলম্বে রেললাইনের অবস্থার পরিবর্তন করা জরুরী। আমরা চাই রেল হোক নিরাপদ যাতায়াতের মাধ্যম। লেখক : আমেরিকা প্রবাসী
×