ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বকাপে মাশরাফির শেষ ম্যাচ আজ

প্রকাশিত: ১১:৪৮, ৫ জুলাই ২০১৯

 বিশ্বকাপে মাশরাফির শেষ ম্যাচ আজ

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশ দলে মাশরাফি বিন মর্তুজার ভূমিকা অনস্বীকার্য। বর্তমান দলটি যে এত সাফল্য পেয়েছে, তার পেছনে মাশরাফির ভূমিকা যে কতটা তা সবারই জানা। তিনি দলকে উদ্দীপ্ত করে রেখেছেন। কঠিন সময়ে দলের হাল ধরেছেন। সেখান থেকে দলকে চূড়ায় নিয়ে এসেছেন। কিন্তু কি দুর্ভাগ্য, যাকে দাঁড়িয়ে সম্মান দিয়ে বিদায় দেয়ার কথা, শেষ বেলায় এসে তারই সমালোচনা হচ্ছে! এবারের বিশ্বকাপ যে খুবই বাজে যাচ্ছে মাশরাফির। সেটি আবার তার শেষ বিশ্বকাপ। আজ আবার বিশ্বকাপে নিজের শেষ ম্যাচটি খেলতে নামবেন মাশরাফি। মাশরাফি যখন ম্যাচ শেষে মাঠ থেকে বের হবেন, তখন আবেগ জড়িয়ে থাকবে। তার কাছ থেকে নিশ্চয়ই ম্যাচের পর পুরস্কার মঞ্চে শেষ ম্যাচটি খেলা নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করা হবে। তখন শেষ বেলায় কি নিজের চোখে পানিও জমা থাকবেনা? টেস্ট খেলতে পারেন না। ২০০৯ সাল থেকেই পারেন না। টি২০ অবসর নিয়ে ফেলেছেন। হুট করে জানান দিয়েছেন, আর টি২০ খেলবেন না। বাকি থাকে ওয়ানডে। বাংলাদেশের সেরা অধিনায়ক ওয়ানডেও হয়তো ছেড়ে দেবেন। তবে আজ বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচ খেলবেন। তাতে আর যে মাশরাফিকে বিশ্বকাপে দেখা যাবে না তাতে কী মাশরাফির মতো দেশের ক্রিকেটভক্তদের চোখেও পানি টলমল করবে না? মাশরাফি হুট করেই অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। নিজে যদি মনে করেন আর হচ্ছে না তাহলেই সিদ্ধান্ত দিয়ে ফেলেন। মাশরাফির এখন আর হচ্ছে না। বিশ্বকাপই তার প্রমাণ। বল হাতে যার সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার কথা, তিনি এবার নিষ্প্রভই ছিলেন। এমনই অবস্থা হয়েছে সেরা বোলারদের দূর দূরান্ত তালিকাতেও মাশরাফির নাম নেই। বিশ্বকাপে আজ পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ ম্যাচটি খেলতে নামার আগে ৭টি ম্যাচ খেলেছেন। উইকেট শিকার করতে পেরেছেন মাত্র ১টি। কি করুণ দশা হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে ৪৯ রান দিয়ে কোন উইকেট শিকার করতে পারেননি। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও ৩২ রান দিয়েছেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১ উইকেট নিলেও ৬৮ রান দেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৩৭ রান, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৫৬ রান, আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৩৭ রান ও ভারতের বিপক্ষে ৩৬ রান দেন। কয়েকটি ম্যাচে পুরো ১০ ওভারও শেষ করেননি। আর তাই তাকে নিয়ে সমালোচনাও হয়। একাদশেই তাকে রাখা উচিত নয়। এমন কথাও ওঠে। যদি ক্রিকেটাররা এবং প্রধান কোচ স্টিভ রোডস আগলে রেখেছেন মাশরাফিকে। কিন্তু সময় যে খারাপ তাতো মাশরাফি নিজেও বুঝতে পারছেন। তাহলে কী অবসরের সময় কাছেই? আজই নাকি? এমনও প্রশ্ন উঠছে। শেষ বিশ্বকাপ তাই পরিবার নিয়ে ইংল্যান্ড এ্যান্ড ওয়েলসে আছেন মাশরাফি। স্ত্রী সুমনা হক, মেয়ে হুমায়রা মর্তুজা, ছেলে সাহেল মর্তুজা, ছোট ভাই মোরসালিন মর্তুজা আছেন ইংল্যান্ডে। স্ত্রী ক্রিকেট নিয়ে এত বেশি ভাবেন না। এরপরও মাশরাফির শেষ বিশ্বকাপে পুরোটা সময়ই ছিলেন। মাশরাফির বাবা গোলাম মর্তুজা স্বপনও বিশ্বকাপে ছেলের সঙ্গে আছেন। সবাইকে এবার বিশ্বকাপে নিয়ে গেছেন মাশরাফি, নিজের শেষ বিশ্বকাপ তাই। কিন্তু অনেকেই মনে করেছেন, তাহলে কী মাশরাফি শেষ ম্যাচটিতে ওয়ানডে থেকেও অবসর ঘোষণা দিয়ে দেবেন? যদিও এ নিয়ে মাশরাফি নিশ্চিত কোন সিদ্ধান্ত নেননি। হয়তো আরও সিরিজ খেলে অবসর নেয়ার ভাবনায় আছেন। কিংবা টি২০তে যেমন হুট করে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছেন, আজও সেই সিদ্ধান্ত এসে পড়তে পারে। তাকে নিয়ে যে সমালোচনা হচ্ছে, তা তো তিনি নিজেও ভাল করেই টের পাচ্ছেন। এমনও হতে পারে মাশরাফি দেশের মাটিতে কোন ম্যাচে ওয়ানডেও ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেবেন। মাশরাফিকে নিয়ে সমালোচনা হওয়ার পর কোচ এ নিয়ে কথা বলেছেন। জানিয়েছেন, ‘গেল দুই সপ্তাহ ধরেই এটি নিয়ে (মাশরাফি অবসর এবং সমালোচনা) আলোচনা হচ্ছে, সেই প্রশ্নের উত্তর আসলে মাশরাফি ও বোর্ড দিতে পারবে। আমি উত্তর দিতে পারছি না। তবে আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে, আমাদের এমন বোলার লাগবে যে মাশরাফির বিকল্প হওয়ার মতো সামর্থ্য রাখে। কারও এই দিকটি মনে থাকে না।’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘সাতটি অস্ত্রোপচারের পরও দুই শ’র বেশি ওয়ানডের অসাধারণ ক্যারিয়ার তার। ক্যারিয়ারে কখনই সে চেষ্টা করা থামায়নি, এটা বলতে পারি। মাশরাফি নিজের পারফর্মেন্সে গর্ব খুঁজে নেয়। এবারের পারফর্মেন্সে পেছন ফিরে তাকিয়ে তার মনে হবে, নিশ্চয়ই আরও ভাল হতে পারত! তবে এটা বলার পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, সে টুর্নামেন্ট জুড়ে চেষ্টা করে গেছে। ম্যাশের একটি ব্যাপার হলো সে প্রতিটি বলে চেষ্টা করে।’ মাশরাফি চেষ্টা করেও এবার বিশ্বকাপে বিশেষ কোন অবদান বল হাতে রাখতে পারেননি। দলে তাকে প্রয়োজন। তিনি দলকে সবসময়ই উদ্দীপ্ত করেন। ক্রিকেটারদের আগলেও রাখেন। কিন্তু এবারের বিশ্বকাপ যেন মাশরাফির জন্য বিভীষিকাময় হয়ে গেল। যে মাশরাফিকে ভক্ত-সমর্থকরা সবাই মাথায় করে রেখেছেন, তিনিই এখন সমালোচনা সহ্য করছেন! ৭ ম্যাচে ৩১৫ রান দিয়ে যে ১ উইকেটের বেশি শিকার করতে পারেননি। নখদন্তহীন হয়ে পড়েছে মাশরাফির বোলিং। ব্যাট হাতে ৪ ম্যাচে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়ে ১৯ রানের বেশিও করতে পারেননি। অথচ ২০০১ সাল থেকে ক্যারিয়ার শুরু তার। প্রায় ১৯ বছর ধরে খেলছেন। বিশ্বকাপ খেলেছেন চারটি। ২০০৩ সালে যখন কঠিন সময় পার করছে বাংলাদেশ, বিশ্বকাপে একের পর এক ম্যাচ হারছে, এমনকি কানাডার মতো দলের কাছেও হেরেছে; তখন থেকে বিশ্বকাপে মাশরাফির পথ চলা। সময় গড়ায়। ২০০৩, ২০০৭, ২০১৫ ও ২০১৯ বিশ্বকাপ খেললেন। ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে মহাব্যর্থতার পর ২০০৭ সালে তার দুর্দান্ত বোলিংয়েই ভারতকে হারিয়ে সুপার এইটে ওঠে বাংলাদেশ। এরপর ২০১১ সালের বিশ্বকাপে আনফিট থাকায় দলে জায়গা পাননি। নিজ দেশে হওয়া বিশ্বকাপে খেলতে পারেননি। কান্নায় ভেসেছেন। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে তার নেতৃত্বে দল কোয়ার্টার ফাইনালে খেলে। এবার আশা ছিল, দল সেমিফাইনালে খেলবে। সেই আশা পূরণ হওয়ার পথেও ছিল। কিন্তু ভারতের বিপক্ষে হারে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয় বাংলাদেশ। আজ এবার বিশ্বকাপে বাংলাদেশের শেষ ম্যাচ। ২১৬ ওয়ানডেতে ২৬৬ উইকেট পাওয়া মাশরাফিরও বিশ্বকাপে শেষ ম্যাচ এটি। এই বিশ্বকাপ মাশরাফির জন্যই রাঙ্গিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন সতীর্থরা। মুশফিকুর রহীমই যেমন বলেছিলেন, ‘মাশরাফি ভাই যদি এরপর আর বিশ্বকাপ খেলতে না পারে এটাই আমাদের এক সঙ্গে শেষ বিশ্বকাপ। তো আমরা সবাই চাইব মাশরাফি ভাইয়ের জন্য হলেও যেন বিশেষ কিছু করতে পারি। যা কি না স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমার মনে হয়, এটা অবশ্যই অনেক বড় সুযোগ।’ বাংলাদেশ সেমিফাইনালে খেলতে পারেনি। তবে পাকিস্তানের বিপক্ষে জিতলেও প্রাপ্তির খাতা ভারি হবে অনেক। মাশরাফির বিদায়টি জয় দিয়েও দিতে পারবেন সতীর্থরা। মাশরাফি নিজেও বলেছিলেন, ‘অসম্ভব (সেমিফাইনালে খেলা) কোন কিছুই না। অবশ্যই সম্ভব। তবে কঠিন। অনেক কঠিন।’ সেই কঠিন পথটাই দেখা গেল। বাংলাদেশ সেমিফাইনালে খেলতে পারল না। তবে মাশরাফি যে নিজের শেষ বিশ্বকাপ নিয়ে বলেছিলেন, ‘এটাই আমার শেষ বিশ্বকাপ। প্লেয়ার হিসেবে আমাকে পারফর্ম করতে হবে। অবশ্যই অধিনায়কত্বটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হবে। আমার যে দায়িত্বটা আছে সেগুলো চেষ্টা করব পুরোপুরি ঠিক করার।’ মাশরাফি সেই শেষ বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচটি আজ খেলে ফেলবেন। শেষটা এখন নৈপুণ্য ভরা হলেই হলো। অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফি কেমন তা সবারই বোঝা হয়ে গেছে। তিনি না থাকলে নেতৃত্বে প্রভাব পড়বেই। এটা নিশ্চিত করেই বলে দেয়া যায়। তার অভাব পূরণ হওয়া কঠিন। তিনি না থাকলে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ওপরও এর প্রভাব পড়বে নিশ্চয়ই। মাশরাফির নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো দুইয়ের অধিক দলের সমন্বয়ে হওয়া সিরিজের শিরোপা জিতেছে। আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজের শিরোপা জিতেছে। বাংলাদেশের পুরুষ ক্রিকেট ইতিহাসে শিরোপা জয়ের দিক দিয়ে যা সর্বোচ্চ অর্জনই বলা চলে। তা মাশরাফির হাত ধরেই এসেছে। এমন সময় শিরোপা জেতা গেল, যখন অবসর নেয়ারও দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন মাশরাফি। আজ অন্তত বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচটি জিতে মাশরাফিকে জয় দিয়ে বিশ্বকাপে বিদায় দেয়া গেলেই হলো।
×