ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ-পাকিস্তান লড়াই আজ

প্রকাশিত: ১১:৪৪, ৫ জুলাই ২০১৯

বাংলাদেশ-পাকিস্তান লড়াই আজ

মিথুন আশরাফ ॥ এবার বিশ্বকাপে বাংলাদেশের যে ছক ছিল তার শেষ হচ্ছে আজ। যে জাল বুনা হয়েছিল তাতে ধরা পড়ার শেষ দল পাকিস্তান। এবার কী ছক পূরণ হবে? জালে ধরা পড়বে পাকিস্তান? আজ ইংল্যান্ডের লর্ডসে পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের লড়াই রয়েছে। বাংলাদেশ সময় বেলা সাড়ে তিনটায় ম্যাচ শুরু হবে। ম্যাচটিতে বাংলাদেশ জিতলে মাথা উঁচু করে মাঠ ছাড়তে পারবে। মর্যাদা নিয়ে মাঠ ছাড়তে পারবে। পরিকল্পনা সফল হবে। যে পরিকল্পনা বিশ্বকাপের শুরুতে করা হয়েছিল তা পূরণ হবে। পারবে ক্রিকেট যুদ্ধে পাকিস্তানকে হারাতে বাংলাদেশ? খুবই সম্ভব। বাংলাদেশ যে ছক কষেছে, যে জাল বুনেছে, সেইভাবেইতো সব এগিয়ে চলেছে। বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলার স্বপ্ন ছিল। সেমিফাইনালে উঠলেইতো শিরোপা জিততে আর দুই ম্যাচ জয়ের দরকার ছিল। শেষ চারে খেলার স্বপ্নই পূরণ হয়নি। বিশ্বকাপ থেকে এক ম্যাচ আগেই ছিটকে পড়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু যে দলগুলোকে হারানোর পরিকল্পনা ছিল তাতো সফল হয়েছে। এখন পাকিস্তানকেও হারাতে পারলে পরিকল্পনায় শতভাগ সাফল্যই মিলবে। সেই সাফল্য এখন বাংলাদেশ দল কুড়িয়ে নিতে পারলেই হলো। বিশ্বকাপ শুরুর আগেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ডের মধ্যে যে কোন একটি দল; শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে যে কোন দুটি দল; আফগানিস্তান, ভারত, পাকিস্তানের মধ্যে যে কোন দুটি দলকে হারানোর ছক ছিল। সেভাবে জালও বিছানো হয়। তাতে ধরাও পড়ে প্রতিপক্ষ। মাঝপথে শুধু শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয়ের আশা করা ম্যাচটি বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হয়ে যায়। তা না হলে প্রথম তিন দলের মধ্যে একটি জয় (দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে) মিলেছে। দ্বিতীয় তিন দলের মধ্যে দুটি জয় ছকে ছিল। তা হয়নি। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানো গেলেও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচটি পরিত্যক্ত হয়। তৃতীয় তিন দলের মধ্যে দুটি দলকে হারানোর যে পরিকল্পনা আছে আজ পাকিস্তানকে হারালে সেটিও পূর্ণ হবে। আফগানিস্তানকে বধ করা গেছে। এখন পাকিস্তান বধ হলেইতো হয়। বিশ্বকাপে এবার ১০ দলের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচ দল খেলছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি প্রশংসা কুড়িয়েছে। দলটি যে এবার এখন পর্যন্ত ৩ জয়ের সঙ্গে লড়াকু মনোভাব দেখিয়েছে। এক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটি ছাড়া সব ম্যাচেইতো বাংলাদেশ প্রশংসার দাবিদার। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটিতে ২৪৪ রান করেও লড়াই করেছে। জয়ের আশা তৈরি করেছে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে ৩৮২ রানের টার্গেটের সামনে পড়েও ভেঙ্গে পড়েনি। ৩৩৩ রান করেছে। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচেও আশা তৈরি করে হেরেছে। তাই সব দল, সবাই বাংলাদেশের প্রশংসা করছে। বিশ্বকাপের মধ্যে শুধুই বাংলাদেশকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিশ্বকাপের পরও নিশ্চয়ই তা বজায় থাকবে? আজ পাকিস্তানকে হারাতে পারলেতো সেই আলোচনা আরও দীর্ঘ হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচদলের মধ্যে আফগানিস্তান সবচেয়ে বাজে করেছে এবার। এরপর যে চার দল আছে এর মধ্যে ভারততো বিশ্বকাপ জিততেই খেলছে। তারা শক্তিশালী দলও। পাকিস্তানকে নিয়ে শুরুতে উচ্চাশা না থাকলেও পরে তা তৈরি হয়েছে। কিন্তু সমর্থকদের মন পাকিস্তান ভরাতে পারেনি। শ্রীলঙ্কাতো দুর্বল থেকে শক্ত হয়ে একটু জ্বলে আবার নিভে গেছে। সেই তুলনায় বাংলাদেশ সবার ‘প্রাণের দল’ হয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় বিষয় দক্ষিণ এশিয়ার যে দলগুলো বিশ্বকাপ খেলছে সব দলই বাংলাদেশের অনেক বড় প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছে। দিন দিন তা আরও বাড়ছে। আফগানিস্তানের বিপক্ষে খেলা হলে এখন এমন হুঙ্কার দেন আফগান ক্রিকেটাররা উত্তাপ তৈরি হয়ে যায়। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের ম্যাচ হলে তেমন উত্তেজনা আগে তৈরি হতো না। কিন্তু চন্দ্রিকা হাতুরাসিংহে যে বাংলাদেশের প্রধান কোচের দায়িত্ব হঠাৎ ছেড়ে দিয়ে শ্রীলঙ্কার দায়িত্ব নেন, এরপর থেকেই উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের খেলা হলেতো এখন যে কোন দলের চেয়ে বেশি উত্তেজনা তৈরি হয়। কখনও ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের চেয়েও বেশি উন্মাদনা দেখা যায়! এই দুই দলের ম্যাচ যে এখন একপেশে হয়ে গেছে। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার ম্যাচে যে ‘নো’ বল, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের আউট, ভারতের বিজ্ঞাপন দাপট বিতর্কগুলো তৈরি হয় এবং একই বছর ভারতকে সিরিজে হারায় বাংলাদেশ, এরপর থেকেই আসলে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ হলেই উত্তেজনা চরম পর্যায়ে চলে যায়। তবে সব উত্তেজনা, উন্মাদনা, উত্তাপ হার মানে আসলে যখন পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের ম্যাচ হয়। এই দলটির সঙ্গে ম্যাচ হলে আসলে ক্রিকেট আঙ্গিনা ছাড়িয়ে উত্তাপ অন্য সব স্থানেও ছড়িয়ে যায়। ১৯৭১ সালে যে তাদের বিপক্ষে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে। তাই শুধু ক্রিকেট ম্যাচই নয়, যে স্থানেই পাকিস্তানের বিপক্ষে কোন খেলা হয় তখনই উত্তাপ ছড়ায়। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ইস্যুতে উত্তেজনা সব স্থানেই বিদ্যমান। সেই উত্তাপ টের পান ক্রিকেটাররাও। এবারতো পাকিস্তান ক্রিকেটারদের জ্বালা অনেক বেশি। বাংলাদেশের সেমিফাইনালে খেলার আশা শেষ। তাই বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা অনেক নির্ভার। তারা এখন শুরুর মতো শেষটাও ভাল করতে চায়। বিশ্বকাপে যেমন জয় দিয়ে শুরু করেছে। শেষটাও জয় দিয়ে করতে চায়। নির্ভার থাকায় চাপ খুব বেশি থাকছে না। যদিও ভারতের কাছে জয়ের আশা তৈরি হওয়া ম্যাচে হারায় হতাশাযুক্ত থাকছে। তাতে পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়ের চাপ কিছুটা হলেও থাকছে। কিন্তু বিশদ আকারে তা গায়ে লাগছে না। সেই তুলনায় পাকিস্তান ক্রিকেটারদের ওপর অসম চাপ। তাদের সামনে সেমিফাইনালে খেলার সুযোগ রয়েছে। জিতলে পয়েন্ট তালিকায় চতুর্থ স্থানে থাকা নিউজিল্যান্ডের সমান পয়েন্ট হবে। তখন রানরেটে পাকিস্তানের শেষ চারে খেলার হিসেব আসবে। সেই হিসেবে পাকিস্তানকে বড় ব্যবধানেই জিততে হবে। শুধু জিতলেই হবে না, রানরেটও বাড়াতে হবে। তা না হলে নিউজিল্যান্ডকে পেছনে ফেলা সম্ভব নয়। আর এখানেই অসম্ভবকে সম্ভব করার পেছনে ছুটতে হবে পাকিস্তানকে। সেমিফাইনালে খেলতে হলে আগে ব্যাটিং করতে হবে। আগে ফিল্ডিং করলেই শেষ চারে খেলার স্বপ্ন শুরুতেই শেষ হয়ে যাবে। আগে ব্যাটিং করলেও আবার হিসেব অনেক কঠিনই দাঁড়াচ্ছে। বাংলাদেশকে হারাতে হবে। সেটি আবার অনেক রানের ব্যবধানে। যে রানের ব্যবধানে আজ পর্যন্ত কোন দল জিতেনি। ওয়ানডে ইতিহাসে ২৯০ রানে সবচেয়ে বড় জয় আছে। নিউজিল্যান্ড (৪০২/২) জিতেছে, ২০০৮ সালে, আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে (১১২/১০)। বিশ্বকাপে ২৭৫ রানের বড় জয় আছে। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে আফগানিস্তানকে (১৪২/১০) হারিয়েছে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়া অস্ট্রেলিয়া (৪১৭/৬)। বাংলাদেশের বিপক্ষে পাকিস্তানকেতো আরও বড় ব্যবধানে জিততে হবে। ৩০০ রানের বেশি ব্যবধানে জিততে হবে। যে জয় কোন দলের কল্পনাতেও আসে কিনা সন্দেহ আছে! সেমিফাইনালে যেতে পাকিস্তানের পথ অনেক কঠিন। কারণ পাকিস্তান ৩৫০ রান করলে ৩১১ রানে, ৪০০ রান করলে ৩১৬ রানে, ৪৫০ রান করলে ৩২১ রানে বাংলাদেশকে হারাতে হবে। আর যদি বাংলাদেশ আগে ব্যাটিং করে তাহলেই পাকিস্তানের সব আশা শেষ! তখন অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ডকেই যে বিশ্বকাপের শুরু থেকে সেমিফাইনালের চার দল ভাবা হয়েছে, শেষ পর্যন্ত তাই হবে। সেমিফাইনালে খেলবে তারাই। তার মানে পাকিস্তানের সামনে মহাচাপ। ম্যাচটি বাংলাদেশের বিপক্ষে। তাই পাকিস্তানেরও যে বিশ্বকাপ শেষ, তা ধরেই নিয়েছে ক্রিকেট বিশ্ব। তাতে পাকিস্তান ক্রিকেটারদের মধ্যে চাপের সঙ্গে আছে বাংলাদেশের বিপক্ষে জয় পাওয়ার স্নায়ুচাপও। এই চাপ জিতে এখন বাংলাদেশকে হারাতে পারবে পাকিস্তান? বাংলাদেশও কী তা হতে দেবে? পয়েন্ট তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন সপ্তমে। পাকিস্তানের অবস্থান পঞ্চমে। যদি পাকিস্তানকে হারাতে পারে বাংলাদেশ, তাহলে পঞ্চমে যাওয়ার সুযোগ থাকছে। ভারতের বিপক্ষে শ্রীলঙ্কা যদি হেরে যায় তাহলে ৯ পয়েন্ট নিয়ে রানরেটে এগিয়ে থেকে বাংলাদেশই তখন পঞ্চম স্থানে থাকবে। যে তালিকায় বাংলাদেশের নামটি সম্মানের স্থানেই থাকবে। সবার মুখে একটি কথাই ভেসেছে, বাংলাদেশকে সেমিফাইনালে খেলা উচিত। এই কথা তখনই কারও মুখে বের হয় যখন দল ভাল করে। কিন্তু সেই ভালটা শেষ সময়ে কী আর থাকছে? বোলিং ব্যর্থতায় ম্যাচগুলো হেরেছে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপে খেলছে ১০ দল। এর মধ্যে সেমিফাইনালে উঠতে না পারলেও যদি সেরা পাঁচে না থাকা যায় তাহলে এত প্রশংসার দাবিদারও কী হওয়া যায়? এই একটি বিষয় যখন সামনে চলে আসছে তখন চাপ তৈরি হচ্ছে। এত ভাল খেলা হয়েছে বিশ্বকাপে। যদি ৯ পয়েন্ট থাকা পাকিস্তানের কাছে বড় ব্যবধানে কোনভাবে হার হয় তাহলে সমালোচনাও তখন শুরু হয়ে যেতে পারে। এত ভাল করার পরও তখন খারাপ নিয়েই বেশি আলোচনা হবে। এ নিয়েও আছে ভাবনা। সেই ভাবনা থেকে ক্রিকেটারদের মধ্যে স্নায়ুচাপ বেড়ে যেতে পারে। সেই চাপ নিয়ে খেলতে গেলে বিপদও আসতে পারে। তবে বাংলাদেশ জিতুক। সেই আশাই করা হচ্ছে। পাকিস্তানকে হারালে যে সাফল্য পুরোটাই মিলবে। ছক যেভাবে করা হয়েছে তা পূরণ হবে। জাল যেভাবে বুনা হয়েছে সেই জালে পাকিস্তানও আটকা পড়বে। তাতে সেমিফাইনালে না ওঠার যে কষ্ট তা দূরও হবে। মাথা উঁচু করেই মাঠ ছাড়তে পারবেন বাংলাদেশ ক্রিকেটাররা। বাংলাদেশ পারবে পাকিস্তানকে হারিয়ে মাথা উঁচু করে মাঠ ছাড়তে? মর্যাদা নিয়ে মাঠ ছাড়তে। পাকিস্তান বুঝে গেছে, বিদায় ঘটছে। তাই ভাল একটি অবস্থান নিয়ে মাঠ ছাড়তে পারলে বাংলাদেশের মর্যাদা অনেক বেশি অক্ষুণ্ণ থাকবে। দুই দলের ক্রিকেট যুদ্ধে এখন বাংলাদেশই জিতে। তাই মাশরাফি বিন মর্তুজার বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচটিতে বাংলাদেশের জয়েরই প্রত্যাশা থাকছে।
×