ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ সাখাওয়াত হোসেন

মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা

প্রকাশিত: ০৮:৫৭, ৫ জুলাই ২০১৯

মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা

মুক্তিযুদ্ধ একটি সংগ্রাম, একটি ইতিহাস, বৈপ্লবিক অর্জন এবং সামষ্টিক বিজয়। বাঙালীর জীবনে এর থেকে বড় অর্জন আর কখনই আসবে না। স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবার সুযোগ করে দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। তাই সামাজিক, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের এ মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং নেতার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য দেশমাতার সন্তানেরা তাদের নিজেদের জীবনকেও উৎসর্গ করতে পিছপা হয়নি। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছেন। ১৯৭১ এ সাত কোটি বাঙালীর মধ্যে কিছু পাকিস্তানপন্থী রাজাকার, আলবদর, আলশামস ছাড়া অধিকাংশ প্রাপ্ত বয়স্ক; মুক্তিযুদ্ধে কোন না কোনভাবে অবদান রেখেছেন, যার ফলে মাত্র নয় মাসের ব্যবধানে আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মহান স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতার অর্জন তখনই অর্থবহ হবে যখন এর পেছনের কারিগরদের যথাযোগ্য মর্যাদায় উপযুক্ত আসনে অধিষ্ঠিত করা যাবে। অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বিবেচনা করলে দেখা যায়, একজন নারী মুক্তিসংগ্রামের ক্ষেত্রে একাধিক দায়িত্ব পালন করতে পেরেছেন। তাই, মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ভূমিকা আলোকপাত করতে হলে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে আলোচনা করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ সরকারের ২০১২ সালের পরিসংখান অনুযায়ী, ২০৩ জন নারী মুক্তিযোদ্ধাকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তালিকার বাইরেও অসংখ্য নারী রয়েছে যারা বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছিল। কেবলমাত্র মুক্তিযুদ্ধ নয়, এ দেশের প্রতিটা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে নারীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে অদ্যাবধি সংঘটিত সকল ধরনের সংগ্রামে নারীদের অংশগ্রহণ অন্যদের অনুপ্রাণিত করেছে। সর্বশেষ, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ মহান ভাষা আন্দোলনে আমাদের মেয়েরা সাহস ও প্রতিভার অসামান্য স্ফূরণ দেখিয়েছিলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙ্গে মেয়েরাই প্রথম রাস্তায় বের হয়ে আসেন। মুক্তিযুদ্ধে নারীরা যে সাহসিকতা ও গৌরবময় অবদান রেখেছেন, তা জাতি হিসেবে আমাদেরকে বিশ্বদরবারে সম্মানিত করেছে। নারী গেরিলাদের মধ্যে অগ্রগণ্য বেগম ফোরকানের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল প্রথম গেরিলা স্কোয়াড। তার নেতৃত্বে প্রথম আটজন নারী প্রশিক্ষণ নেয়, পরবর্তীতে শরণার্থী শিবির থেকে শতাধিক নারীকে নির্বাচিত করে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রথম দিকে তাদের অস্ত্র সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয় এবং তাদের মধ্য থেকেই ভয়ঙ্কর সুইসাইড স্কোয়াড তৈরি করা হয়েছিল। বর্তমান সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল গোবরায় ক্যাম্প, যেটি শুরুর দিকে মুজিবনগর সরকার এবং ভারত সরকারের প্রত্যক্ষ সাহায্য সহযোগিতায় গড়ে উঠেছিল। এ ক্যাম্পে প্রায় ৩০০ তরুণ-তরুণী অবস্থান করতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আহত নারী মুক্তিযোদ্ধা, নির্যাতিতা নারী এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের নারীদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে নারী পুনর্বাসন বোর্ডের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। ১৯৯৬ সালে তিনি সমগ্র দেশের নারী মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে মহিলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গঠন করেন। তাছাড়া, বীর প্রতীক তারামন বিবি রাধুনী হিসেবে যোগদান করলেও গুপ্তচর বৃত্তির কাজ অত্যন্ত সুচারুরূপে করে ফেলতেন। তিনি কুড়িগ্রামের রাজীবপুর ট্রেনিং ক্যাম্পে গেরিলা হিসেবে রান্নার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অত্যন্ত সুদক্ষ একজন সৈনিকের মতো তিনি পাকিস্তানী সেনাদের কুঠিতে ঢুকে অপারেশনের খবর সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সরবরাহ করতেন। তার কাছ থেকে পাওয়া সংবাদের ভিত্তিতে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের হত্যা করেছিল এবং একটি শিবির দখল করতে পেরেছিল। পাশাপাশি অসংখ্য বাঙালী পরিবারকে তিনি পাকিস্তানী সেনাদের হাত থেকে কৌশলে বাঁচিয়েছিলেন। বীর প্রতীক সেতারা বেগমও অনন্যসাধারণ অবদান রেখেছিলেন দেশ মাতার মুক্তিসংগ্রামে। একাত্তরের অন্যতম গেরিলা যোদ্ধা আলমতাজ বেগম মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রান্নাবান্না করা থেকে শুরু করে যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন এবং অবরুদ্ধ অবস্থায় পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি যে ক্যাম্পটিতে ছিলেন, পাকিস্তানী সেনারা সেটি দখল করে ফেলেছিল এবং ৭-৮ দিন অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় তারা যুদ্ধ করেছিলেন এবং সে যুদ্ধে তারা সফলও হয়েছিলেন। কি অদম্য ইচ্ছা এবং আত্মশক্তি একজন নারীকে দেশমাতার টানে যুদ্ধে নিয়ে যেতে পারেন তা বাংলার নারীদের অনুপ্রেরণা দেখলে বোঝা যায়। এছাড়াও বরিশালের করুণা বেগম কুতুব বাহিনীতে নারী যোদ্ধাদের সঙ্গে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন এবং এ বাহিনীতে মোট ৫০ জন নারী সদস্য ছিলেন। করুণা বেগম কুতব বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন এবং তিনি ছদ্মবেশে শত্রু বাহিনীর উপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে অপারেশন চালিয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি আধুনিক অস্ত্র যেমন- রাইফেল, স্টেনগান এবং যে কোন ধরনের বিস্ফোরক দ্রব্য সামগ্রী পরিচালনে প্রশিক্ষণ নেন। চুয়াডাঙ্গার আলেয়া বেগম পুরুষের পোশাক পড়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি থানা ইউনিটের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে প্রশিক্ষিত হয়ে রাইফেল, এসএমজিএসএলআর চালানোতে আলেয়া বেগম সমান পারদর্শিতা দেখান। শত্রুপক্ষের অবস্থান ও কৌশল বুঝে সমরাস্ত্র নিয়ে তিনি সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন। প্রতিটি আন্দোলনে নারীরা পুরুষের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে কাজের ধারাকে গতিশীল এবং প্রাণবন্ত করে তুলে। প্রচলিত সমাজ কাঠামোর চালনায় আমরা নারীদের তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে কুণ্ঠাবোধ করে থাকি যা হীনমন্যতার শামিল। তাই দেশের স্বার্থে নারীদের তাদের কাজের মূল্যায়ন দিয়ে প্রত্যেকটি ভাল কাজের সহিত অংশগ্রহণের সুযোগ দিলে দেশ সামষ্টিকভাবে অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
×