ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রাম

প্রকাশিত: ০৮:২৩, ৫ জুলাই ২০১৯

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রাম

গ্রামীণ মেঠোপথগুলোতে এখন পিচঢালা বা ইটের আবরণ। তবে এই সড়কগুলো থেকে ছোট ছোট কিছু রাস্তা গেছে যেখানে পিচের বালাই নেই। দূর্বা ঘাসই আঁকড়ে ধরে আছে রাস্তা। এই ঘাসের উপর দিয়ে চলাচলের পদচিহ্ন দেখে বোঝা যায় এই রাস্তায় লোকজনের চলাচল কম। এমনই একটি ছোট রাস্তা পাড়ি দিয়ে এবং ঘর-বাড়ির ভেতরের রাস্তা দিয়ে যেতে হয় তাঁর বাড়ি। বাড়িটিতে এখন তেমন জৌলুস নেই। তবে একটি পরিবার বসবাস করছে। এটি বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান উপজেলার মালপদিয়া গ্রাম। কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি এটি। এলাকায় বাড়িটির পরিচিতি দারোগাবাড়ি হিসেবে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জেঠাত ভাই সতীশ ব্যানার্জী কলকাতার লালবাজার থানার ওসি ছিলেন। তাই তার নামানুসারেই হয়েছে দারোগাবাড়ি। বাড়িটি যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈত্রিক বাড়ি তা নিশ্চিত করেছেন সদ্য অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা এম মুজিবুর রহমান। মানিকভক্ত জনাব রহমান পাশের গ্রাম নাইশিংয়ের বাসিন্দা। মালপদিয়া গ্রামের প্রবীণদের সঙ্গে তাঁর বেশ সখ্যতা। তিনি জানালেন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে প্রথম নারীদের স্কুল করা হয়েছিল তার চাচির নামে। এই বিদ্যালয়ের নাম ছিল ‘দিনতা রানী মালপদিয়া বালিকা বিদ্যালয়’। ১৯২০ সালের দিকে এটি প্রতিষ্ঠা করেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জেঠাত ভাই সতীশ ব্যানার্জী। স্কুলটি অপেক্ষাকৃত ভেতরে থাকায় সমস্যা হচ্ছিল। তাই বছর দুই চলার পর বিদ্যালয়টি স্থানান্তর করা হয় প্রায় ৫শ’ গজ দূরে মালপদিয়া রাস্তার পাশে। এখানেই বিদ্যালয়টি ক্রমে প্রসারিত হয়। এখন বিদ্যালয়টির নাম বদলে হয়েছে ‘মালপদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়’। বিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী সংখ্যা এখন ২ শ’ ৮৫। মালপদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ আলমাছ মাঝি জানান, কয়েক বছর আগে এই বিদ্যালয়ের দায়িত্ব নেন তিনি। এখন প্রতিষ্ঠাকাল উল্লেখ রয়েছে ১৯৮৩ সাল। তাই বোঝা যায় ঐ সময় থেকে এই পরিবর্তন হয় নামের এবং প্রতিষ্ঠাকালের। এর মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা বেশি। অর্থাৎ ছাত্রী রয়েছে দেড় শতাধিক। মুজিবুর রহমান বলেন, হীন মানসিকতার কারণেই বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাকাল এবং নাম পরিবর্তন করা হয়েছে যা একেবারেই ঠিক হয়নি। তিনি বলেন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবার বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করলেও কোথাও তাদের নাম নেই। নতুন প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এমনকি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িটি পর্যন্ত সংরক্ষণ করা হয়নি। ছোট এই গ্রাম মালপদিয়া। অথচ গ্রামের কেউ জানেন না মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি কোন্টি। মালপদিয়া গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা মোঃ কামাল উদ্দিন। তিনি উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা অফিসার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন। এই গ্রামেই তার বেড়ে ওঠা। কিন্তু তিনিও জানতেন না ত্রিশোত্তর বাংলা কথাসাহিত্যের শক্তিমান লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি এটি। কামাল উদ্দিন বলেন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মালপদিয়া গ্রামের সন্তান এটুকুই জানতাম। কিন্তু তার বাড়িটি চিহ্নিত করতে পারিনি। তবে মুজিবুর রহমান যে দারোগাবাড়িটি চিহ্নিত করেছেন এটিই সঠিক বলে তিনি মনে করেন। মালপদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি সর্বজন শ্রদ্ধেয় সিরাজুল ইসলাম মৃধা। তিনি প্রায় একযুগ ধরে স্কুলটির সভাপতি। সিরাজুল ইসলাম মৃধা জানান, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবার স্কুলটি প্রতিষ্ঠাতা করেছে এতে কোন সন্দেহ নেই। তারপরও স্কুলটির নাম সঠিক করা যাচ্ছে না নানা কারণে। তবুও চেষ্টা চলছে। তিনি আরও জানান, মালপদিয়া দারোগাবাড়ি যে মানিক বন্দ্যোপধায়ের পৈত্রিক বাড়ি এতেও কোন সন্দেহ নেই। তিনি কালজয়ী এই সাহিত্যিকের জন্মভিটা সংরক্ষণের দাবি জানান। মানিক বন্দ্যোপধ্যায়ের বাড়িটিতে বর্তমানে ইন্তাজউদ্দিন ঢালীর পরিবার বসবাস করছেন। আনুমানিক ১৯৩৮ সালের দিকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বংশধররা ভারতে চলে যাওয়ার পর ইন্তাজউদ্দিন ঢালীর পিতা কেতু ঢালী বাড়িটি কিনে নেন বলে প্রাথমিকভাবে জানা যায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বংশধরদের ক্রিম কালারের একটি একতলা ভবন ছিল, সেটি এখন আর নেই। এখন টিন-কাঠের ঘর রয়েছে বাড়িটিতে। তবে বাড়ির বেশিরভাগ জায়গা এখনও ফাঁকা। গ্রামটিতে বাড়ি খুঁজতে গিয়ে সিমা রানী বন্দ্যোপাধ্যায়, তার পুত্র প্রিয় শঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, তৈয়ব আলী শেখ, শিক্ষক রেদোয়ান ইসলাম মানিক, আলী আহম্মদ, মোঃ ওয়ালী উল্লাহ, হৃদয় চন্দ্র দেবনাথ, আয়শা আক্তার, মাহফুজা আক্তার, মনির হোসেন, রুনা আক্তার, গ্রামবাসী মোঃ রকিব, মফিজুর রহমান ঢালী, মোহাম্মদ হোসেন মিয়া, মধ্যপাড়া ইউনিয়নটির সাবেক দুই উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা (তহশিলদার) বুলবুল আহম্মেদ ও উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল কাদের, মধ্যপাড়া ইউপির বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল করিম শেখ, সাবেক চেয়ারম্যান আলিম আল রাজি, রিয়াজুল ইসলাম মৃধাসহ নানা বয়সী অনেকের সঙ্গে কথা হয়। তারা বাড়িটি খুঁজতে সকলেই সহযোগিতা করেছেন। তবে বর্তমানে ইউনিয়নটিতে উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তার পদটি খালি রয়েছে বলে সিরাজদিখান উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) জানিয়েছেন। বাড়িটি খুঁজতে গিয়ে বেশ কয়েকটি বাড়ি ঘুরতে হয়। সংশ্লিষ্ট জৈনসার ভূমি অফিসার মোঃ আব্দুল কাদের ২০১৫ সালের ৮ জানুয়ারি উপজেলা ভূমি অফিসে একটি রিপোর্ট প্রেরণ করেছেন। এই রিপোর্টে প্রাথমিকভাবে তিনি ধারণা করেছেন- মালপদিয়া মৌজার এসএ ২০২৯, আরএস ৩০৭৮ দাগে মানিক বন্দ্যোপধ্যায়ের বাড়ি। বাড়িটি অর্পিত সম্পতি হিসেবে রেকর্ডকৃত। মফিজউদ্দিন শেখের নামে (ভিপি কেস নং ৩১/৮৫) নামে লিজ দেয়া আছে। তবে মোঃ আব্দুল কাদের এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, রিপোর্ট দেয়া হলেও এটিই যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি তার সঠিক প্রমাণ নেই। ধারণার ওপর দেয়া হয়েছে মাত্র। এছাড়া মালপদিয়া বিদ্যালয়ের পূর্বেদিকে পার্বতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িটিও ধারণা করেন অনেকে। তবে অবসরে যাওয়া পাট মন্ত্রণালয়ের সহকারী ব্যবস্থাপক এম মুজিবুর রহমান বলেন, তিনি শতভাগ নিশ্চিত দারোগা বাড়িটিই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। এর প্রমাণ হিসেবে তিনি বলেন, এই অঞ্চলের বেগম রোকেয় হিসেবে পরিচিত ছিলেন জুলেখা খাতুন। যিনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বংশধরদের প্রতিষ্ঠিত ‘দিনতা রানী মালপদিয়া বালিকা বিদ্যালয়ে’র প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তাঁর ডায়েরি থেকেই এসব তথ্য নিশ্চিত করা গেছে। তাঁর বাড়ি পাশের নাটেশ্বর গ্রামে। জুলেখা খাতুনের কন্যা ফাতেমা আবেদীন চৌধুরী মুজিবুর রহমানকে স্নেহ করতেন। তাঁর ছোট ভাই আমজাদ ঢালী ছিলেন তার বন্ধু। এসব কারণে তাদের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। ২০১৪ সালে সিরাজদিখান উপজেলা মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত মুন্সীগঞ্জ জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও বুদ্ধ দেব বসু এবং ইংলিশ চ্যানেল বিজয়ী সাতারু ব্রজেন দাসের বাড়ি চিহ্নিত উদ্ধারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরই অংশ হিসেবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণে নেয়া হয়। তবে তা বেশিদূর এগোয়নি। সিরাজদিখান উপজেলা নির্বাহী অফিসার ডাঃ আশফাকুন্নাহার বলেন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি চিহ্নিত হয়েছে আজকেই জানতে পারলাম সুসংবাদটি। শুনে খুশি হলাম। আমি বাড়িটি চিহ্নিতকারী সাংবাদিক মীর উজ্জ্বলকে নিয়ে সেখানে যাব। আরও যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কালজয়ী বাঙালি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রামের মানুষ হিসেবে গর্ববোধ করেন গ্রামবাসীরা। ১৯০৮ সালের ২৯ মে পিতার কর্মস্থল ভারতের বিহারের সাঁওতাল পরগনার দুমকা শহরে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস ছিল এই মালপদিয়া গ্রামে। পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় সেটেলমেন্ট বিভাগে চাকরি করতেন এবং শেষজীবনে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার ‘মানিক’ তাঁর ডাকনাম। পিতার চাকরিসূত্রে মানিককে দুমকা, আড়া, সাসারাম, কলকাতা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বারাসাত, টাঙ্গাইল ও মেদিনীপুরের নানা স্কুলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি কলকাতার মেদিনীপুর জেলা স্কুল থেকে ১৯২৬ সালে এন্ট্রান্স পাস করেন। পরে বাঁকুড়া ওয়েসলিয়ন মিশন কলেজ থেকে আইএসসি (১৯২৮) পাস করে তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে বিএসসিতে ভর্তি (১৯২৮) হন, কিন্তু পাঠ অসমাপ্ত রেখেই পেশাগত জীবনে প্রবেশ করেন। তবে মালপদিয়া গ্রামের চেয়ে মানিকের বসবাস বেশি ছিল নানাবাড়ি পাশের লৌহজং উপজেলার গাঁওদিয়া গ্রামে। যার প্রমাণ ১৯৩৬ সালে গাঁওদিয়া গ্রাম কেন্দ্রিক তাঁর অমর সৃষ্টি ‘পুতুল নাচের ইতি কথা।’ একই বছরে তিনি রচনা করেন ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ধারণা করা হয় এটিও পদ্মা তীরের গ্রাম গাঁওদিয়া বসেই রচনা করেছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিবিজড়িত তার নানার বাড়িটিও সংরক্ষিত হয়নি। আনোয়ার ভিলা নামে বাড়িটি এখন পরিচিতি লাভ করেছে। বাড়িটির উত্তরের ভিটায় এখনও দাঁড়িয়ে আছে মানিকের নানার আমলের সেই দ্বিতল ভবনটি। দক্ষিণের ভিটায় রয়েছে একতলা একটি ভবন। বাড়িতে এখন সপরিবারে বাস করে জব্বার নামের এক ভদ্রলোক। গৃহকর্তাকে না পেয়ে কথা হলো জব্বারের স্ত্রী সাহানা বেগমের সঙ্গে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নানাবাড়ি জিজ্ঞেস করতেই তিনি একবাক্যে অস্বীকার করলেন এবং বললেন এটা তার শ্বশুর সিদু শেখের বাড়ি। এক সময়ের হিন্দু অধ্যুষিত বিক্রমপুরের অধিকাংশ বাড়ির মালিকই এখন মুসলমানদের। কেউ হয়ত স্বীকার করে আবার কেউবা বাড়িটি হাতছাড়া হতে পারে এই ভয়ে স্বীকার করতে চায় না। তবে সাহানা বেগমের মতো লোকেরা স্বীকার করুক আর নাই করুক, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতি ধরে রাখতে তার নানাবাড়ি সংলগ্ন গাঁওদিয়া বাজারে অন্বেষণ শিক্ষা ও সেবা ফাউন্ডেশনের পরিচালনায় গড়ে উঠেছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় স্মৃতি পাঠাগার। পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা শাহাদাৎ হোসেন জানালেন, যে প্রতিভা এই গ্রামে বসে পুতুল নাচের ইতিকথায় গাঁওদিয়াকে উপমহাদেশের কাছে তুলে ধরেছেন সেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যে আমাদের দেশের সন্তান তা আমরা ভুলে গেছি। সামান্য ভিটামাটির লোভে প্রতিভাবান এই মানিককে আমরা অস্বীকার করছি। ভূমি লোভীদের মতো আমরাও যেন মানিককে ভূলে না যাই । সেই লক্ষ্যেই মানিকের স্মৃতিগাঁথা গাওদিয়া গ্রামে তারই নামে গড়ে তুলেছি মানিক স্মৃতি পাঠাগার। মানিকের নানা সৃষ্টির মধ্যে গাঁওদিয়ার এ দুটির মাধ্যমেই তিনি সর্বাধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। পদ্মা নদীর মাঝি চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর রচনায় মানুষের অন্তর্জীবন ও মনোলোক বিশ্লেষণে শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর প্রথম দিকের রচনায় নিপুণভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে মানুষের অবচেতন মনের নিগূঢ় রহস্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও পঞ্চাশের মন্বন্তর পরবর্তী রচনায় তাঁর সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা নাগরিক জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করে তার নিখুঁত চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তাঁর এ পর্যায়ের রচনায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে চরম দারিদ্র্যের সম্মুখীন হয়েছেন, তা সত্ত্বেও তিনি সাহিত্যচর্চাকেই পেশা হিসেবে আঁকড়ে ধরেছিলেন। ১৯৩৬ সালের উপন্যাসের সঙ্গে এখনও অনেক কিছু মিলে যায়। তবে কালজয়ী এই বাঙালির আদর্শ এবং সৃজনশীলতা নতুন প্রজন্মকে ছড়িয়ে দেয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন শিক্ষক মনির হোসেন। ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর কলকাতায় তাঁর জীবনাবসান হয়। মাত্র ৪৮ বছরের জীবনে তিনি যা রেখে গেছেন জগৎজুড়ে অমর হয়ে থাকবে। এই শিক্ষক মনে করেন তাঁর এই অমর সৃষ্টির জন্য তার স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি সংরক্ষণ করা জরুরী। গাঁওদিয়া গ্রামের বাসিন্দা বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি বলেন, প্রবীণদের কাছে শুনে এবং ইতিহাস থেকে যা জানা গেছে মানিক বন্দোপাধ্যায় তাঁর নানাবাড়িতে মুক্তবুদ্ধি চর্চা এবং পারিপার্শি¦ক অবস্থা যে অমর উপন্যাস তৈরির ক্ষেত্র তৈরি করেছে। তখন এই জনপদে এত ভাল যোগাযোগ ছিল না। নৌপথই ছিল একমাত্র অবলম্বন। দিঘলী (বর্তমানে বিলীন) থেকে স্টিমারে চেপে দিনের পর দিন অপেক্ষার পর কলকতায় যাওয়া যেত। এমন নানা প্রতিকূলতা ছিল। তারপরও এই জনপদ থেকেই আলোর দ্যুতি ছড়ানো হয়েছে। এই জনপ্রতিনিধি বলেন, তখন মামারবাড়ির সঙ্গে সকলেরই একটি বিশেষ টান ছিল। অনেকেরই শৈশব ও কৈশোর কাটে মামাবাড়ি। মানিকের বিশেষ টান ছিল এই মামাবাড়ির প্রতি। এই সময়টি খুব বেশি আগেরও নয় প্রায় ৮৩ বছর আগের কথা। ১৯৩৬ সালে পুতুল নাচের ইতিকথা উপন্যাসেই এই সমাজ ব্যবস্থার একটি চিত্র ফুটে ওঠে। তখন যেমন সমাজে অনেক কুসংস্কার গ্রাস করে তেমনি এখনকার সমাজ ব্যবস্থায় ভর করেছে যান্ত্রিকতা। আগের মতো পারিবারিক বন্ধন এবং মমত্ববোধ নেই। এই কয়েক দশকেই বড় একটি পার্থক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। মানিক বেঁচে থাকলে তাও তুলে ধরতেন।
×