ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুশান্ত কুমার রায়

ভাওয়াইয়ার সুর ও উৎপত্তি

প্রকাশিত: ০৭:১৩, ৫ জুলাই ২০১৯

ভাওয়াইয়ার সুর ও উৎপত্তি

বাংলা সঙ্গীতের ধারা সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই প্রবহমান। আর লোকসঙ্গীতের অমীয় সাগরে প্রাণবন্ত একটি ধারা ভাওয়াইয়া। ভাওয়াইয়ার ভাব, ভাবনা, বিষয় ও বাণীর ভাষা আঞ্চলিক কথ্যরীতি প্রভাবপুষ্ট এবং আঞ্চলিকতার আবেশে উদ্ভাসিত বৈশিষ্ট্যময় সুরের মূর্ছনায় ঝর্ণাধারা সতত প্রবহমান। আজও বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল রংপুর-দিনাজপুর, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার-জলপাইগুড়ি ও আসাম এবং নেপালের তরাই অঞ্চলের বৃহৎ এক জনগোষ্ঠীর অন্তরের গান। এ গান মূলতঃ নারী, নদী ও প্রকৃতিনির্ভর। খেটে খাওয়া সাধারণ বা শ্রমজীবী মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, বিরহ-বেদনা, আবেগ-অনুভুতি, প্রেম-ভালোবাসা, ইতিহাস-ঐতিহ্য প্রভৃতি ভাওয়াইয়া গানের বিষয়বস্তু। শিল্পীর উদাস করা সুরের মূর্ছনায় ভাংতি এ গানের সুরের বৈশিষ্ট্য। ভাওয়াইয়া গানের সঙ্গে বিশেষ ছন্দে বাজানো হয় দোতারা, তবলা, সারিন্দা, ঢোল ও বাঁশি। এই বাদ্যযন্ত্রগুলোকে সঙ্গত করে সঙ্গীতের এক মধুময় মূর্ছনা ও আবেগ সৃষ্টি করা হয়। ভাবের যে গান তা হলো ভাওয়াইয়া। অন্তরের আবেগ মিশ্রিত সুমধুর ধ্বনি ভাওয়াইয়া গানের প্রাণ। ভাব শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে প্রেম, প্রীতি, প্রণয়, প্রকৃতি, ভক্তি, আবেগ, স্বভাব, ধরন, মর্ম, চিন্তা প্রভৃতি। ভাব শব্দের সম্পৃক্ততা অর্থে ইয়া প্রত্যয় যুক্ত করে ভাব+ইয়া > ভাওয়াইয়া শব্দের উৎপত্তি। বিভিন্ন সময়ে লোকসঙ্গীত গবেষকগণ ভাওয়াইয়া শব্দের উৎপত্তি নিয়ে নানা ধরনের মত প্রকাশ করেছেন। ‘ভাওয়া’ শব্দ থেকে ভাওয়াইয়া কথাটি এসেছে বলে উল্লেখ করেছেন। ‘ভাওয়া’ হচ্ছে নিচু মহিষ চারণভূমি। আবার অনেকে বাও (বাতাস) বা ভাও (ভাব) থেকে ‘ভাওয়াইয়া’ শব্দটি এসেছে বলে মনে করেন। ভাব রসিক গান পাগল মানুষ সংসারে মনোযোগ না দিয়ে উদাসীন মনে ‘বাউরা’ বা ‘বাউদিয়া’ হয়ে ঘুরে বেড়াতো বলে অনেকে ‘বাউদিয়া’ বা ‘বাউয়াইয়া’ থেকে পরিবর্তিত রূপ ‘ভাওয়াইয়া’ এসেছে বলে মনে করেন। তবে ‘ভাওয়াইয়া’ শব্দটি কোন ভাওয়াইয়া গানে উল্লেখ না থাকলেও ‘বাউদিয়া’ ও ‘ভাও’ শব্দটির বহুল ব্যবহার ও প্রচলনের দৃষ্টান্ত আছে ভাওয়াইয়া গানের কথামালার অখন্ড সুরে। আসামের গোয়ালপাড়া হলো ভাওয়াইয়া গানের আদিভূমি আর রংপুর হলো ভাওয়াইয়ার উর্বরভূমি বা চর্চাভূমি। ধরলা-তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা অঞ্চলে ভাওয়াইয়া গানের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটেছে। অনেকে ভাওয়াইয়াকে ‘গোয়ালপাড়িয়া’ গানও বলে থাকেন। অন্যদিকে আবার রংপুর অঞ্চলে রচিত ও গীত ভাওয়াইয়া গানকে অনেকে রংপুরিয়া ভাওয়াইয়া গান বলে অভিহিত করে থাকেন। ইতিহাস থেকে জানা যায় আজকের অসমের গোয়ালপাড়া এক সময় রংপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইতিহাসবিদ ও লোকসঙ্গীত গবেষক এবং ভারতের উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. আনন্দগোপাল ঘোষের মতে, ‘রংপুরের আয়তনের কথা ভেবেই ইংরেজ কোম্পানি রংপুরকে বিভাজন করে উত্তর-পূর্ব রংপুর জেলার সৃষ্টি করেছিলেন ১৮২২ সালে। এই উত্তর-পূর্ব রংপুরই পরে গোয়ালপাড়া নামে পরিচিতি পেয়েছিল। লোকসঙ্গীত গবেষকদের মতে ভাওয়াইয়া গানের উৎপত্তি হিমালয়ের পাদদেশীয় তরাই অঞ্চল। ভাওয়াইয়া উৎপত্তিগত দিক থেকে তিনটি দেশের তিনটি অঞ্চলে প্রসারিত হয়েছে।’ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল বা রংপুর-দিনাজপুর, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চল বা কোচবিহার-জলপাইগুড়ি ও অসম এবং নেপালের সমতটের তরাই অঞ্চলের আপা ও মোরং উপঅঞ্চল। অন্যদিকে বিশিষ্ট লোকসঙ্গীত ও ভাওয়াইয়া গবেষক হাবিবুর রহমানের মতে, বর্তমান বাংলাদেশের রংপুর, দিনাজপুর ও পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি ও পশ্চিম দিনাজপুর এবং কোচবিহার ও অসমের গোয়ালপাড়া অঞ্চলের মাটি ও মানুষের গভীর থেকে উৎসারিত গান ভাওয়াইয়া। ভাওয়াইয়া গানের আদি উৎপত্তিস্থল হিমালয়ের পাদদেশীয় তরাই অঞ্চল (পর্বতের নিম্নদেশ বা উপত্যকা) জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার। এ অঞ্চলের ভৌগোলিক পরিবেশের জন্যই এখানে এ জাতীয় সঙ্গীতের উদ্ভব ও কেন্দ্রায়ন সম্ভব হয়েছে। ভাওয়াইয়া হিমালয়ের তরাই অঞ্চলের কোচবিহার জলপাইগুড়িতে উৎপত্তির পর পাদদেশীয় রংপুর, দিনাজপুর জেলায় প্রসারিত হয়ে চর্চাগত দিক থেকে মুখ্যত রংপুর অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত হয়ে একান্তভাবে এ অঞ্চলের নিজস্ব লোকসঙ্গীতে পরিণত হয়েছে। ভাওয়াইয়া গানের প্রসঙ্গ আসলে যে বিষয় প্রসঙ্গগুলো আসে তা হলো হাতি. মাহুত, মহিষ, বাথান, মহিষাল, গরু, গরুরগাড়ি, গাড়িয়াল, গ্রাম্যবধূ বা নাইওরি, গ্রাম্য আঁকাবাঁকা মঠোপথ, নিধূয়া পাথার। তখনকার দিনে নাইওরি ও নানা ধরনের পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে গরু ও মহিষের গাড়িই ছিল একমাত্র ভরসা। সোয়ামীর বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে ব্যাকুল হয়ে পথপানে চেয়ে থাকতো গ্রাম্যবধূ। সোয়ামীর বিরহে বিরহিনী নারীর করুণ আর্তি নিয়ে– ‘পতিধন মোর দূর দ্যাশে/ মৈলাম পৈল কালা চিকন ক্যাশে রে’ (আব্দুল করিম), ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই / কত কান্দিম মুই নিধুয়া পাথারে’, ‘গান্তাল হাতির মাহুত রে / যে দিন মাহুত শিকার যায়/নারীর মন মোর ঝুরিয়া রয় রে’ প্রভৃতি ভাওয়াইয়া গান রচিত। ‘উত্তরাঞ্চলের গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা, সমাজ, পরিবেশ, প্রকৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, উৎসব-পর্ব, আচার-আচরণ, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, লাঞ্ছনা-বঞ্চনা-গঞ্জনা, শ্রেণী- বৈষম্য ইত্যাদি বাঙময় হয়ে ফুটে উঠেছে শিল্পীর শৈল্পিক গুণে ভাওয়াইয়ার কথা ও সুরের মূর্ছনায়। ভাওয়াইয়ার সুরের স্থানে স্থানে দীর্ঘটান যুক্ত এবং এই টান নিরবচ্ছিন্ন। স্থানে স্থানে আঘাত মিলে ভাওয়াইয়ায় এক প্রকার স্বতন্ত্র সৌন্দর্য মন্ডিত ভাবোদয়ের সৃষ্টি হয়’ (তথ্যসূত্র-সঙ্গীত কোষ, করুণাময় গোস্বামী, বাংলা একাডেমি, ঢাকা-১৯৮৫)। এ প্রসঙ্গে লোকসঙ্গীত গবেষক হাবিবুর রহমান বলেন- ‘তরাই অঞ্চলের চারণভূমিতে গরু-মোষ চড়াতে গিয়ে রাখাল, মৈষালরা অবসর অলস মুহূর্তগুলোতে গান বাঁধে, সুরারোপ করে- গেয়ে ওঠে আপন মনে। পাদদেশীয় উপত্যকায় মোষ পালকের কণ্ঠনিঃসৃত ধ্বনি পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে বাতাসে কাঁপনের সৃষ্টি করে। যার ফলে এ গানের গায়কের কণ্ঠস্বর ভেঙে ভেঙে উচ্চারিত হয়’ (তথ্যসূত্র- হাবিবুর রহমান, বাংলাদেশের লোকসঙ্গীত ও ভৌগোলিক পরিবেশ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা-১৯৮২)। উত্তরাঞ্চলের রাখাল মৈষালরা মাঠ প্রান্তরে গরু মোষ চরানোর সময় এদের পিঠে বসে ভাওয়াইয়া গান গাইতো। তখন এদের চলার গতিতে যে উত্থান পতন ঘটে তার প্রভাবে গানের সুরে ধাক্কা বা ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেকে ধারণা করেন। ‘অতীতে হাতির চালক বা মাহুত দূরে কোথাও হাতি চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় হাতির পিঠে বসে ভাওয়াইয়া গান জুড়ে দিতো। আর এক্ষেত্রে হাতির চলন ভঙ্গির উত্থান-পতনের কারণে গানের সুরে ধাক্কা বা ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। অতীতে উত্তরাঞ্চলের জনজীবনে যানবাহন হিসেবে গরু-মোষের গাড়ির ব্যাপক ব্যবহার ছিল। এ অঞ্চলের মাঠ প্রান্তরের উঁচু-নিচু মেঠোপথ বেয়ে দূর গন্তব্যে গরু মোষের গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় গাড়িয়ালরা গলা ছেড়ে গাইতো দীর্ঘটানের ভাওয়াইয়া গান। আর এই গান গাওয়ার সময় উঁচু-নিচু পথে গাড়ি ওঠানামা করার ফলে যে ঝাঁকুনি বা দুলুনীর সৃষ্টি হতো তার প্রভাবে গায়কের গানের সুরও ভেঙ্গে ভেঙ্গে আসতো। কারণ ভাওয়াইয়া যখন সমতলের আসরে গাওয়া হয় তখনও এই ভাঙ্গনের কাজ থাকে- আসলে এই ভাঙ্গন একটি সুরভঙ্গি (তথ্যসূত্র- নির্মল দাস, ভাওয়াইয়ার ভাষাতত্ত্ব লোকসাহিত্য গবেষণা, কলকাতা-১৩৯৯)। তবে এই সুরভঙ্গি সৃষ্টির মূলেও গায়কের বাহনের চলন ভঙ্গির উত্থান পতনজনিত প্রভাবকে একবারেই অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু আবার অনেকে গায়কের বাহনের চলন ভঙ্গির উত্থান পতনের প্রভাবেই যে ভাওয়াইয়ার সুরে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে এই ধারণাকে মানতে নারাজ। তাঁরা ভাওয়াইয়ার সুরে ভাঙ্গনের সৃষ্টির কারণ সম্পর্কে Ethnic বা গোষ্ঠীগত বৈশিষ্ট্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে করেন। এ প্রসঙ্গে সুখবিলাস বর্মা বলেন, ‘আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি রাজবংশী গোষ্ঠীজাত কোন গ্রাম্য শিল্পীর কাছে এই গলাভাঙ্গা স্বর বা সুর অতি সহজেই আসে যেহেতু কণ্ঠ থেকে উৎপন্ন ধ্বনি মুখমন্ডলে প্রবেশ করার পর জিহ্বা, তালু, নাসারন্ধ্র এবং ওষ্ঠ (ঠোঁট), মুখগহ্বর ও চোয়ালের বিশেষ ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন রূপ লাভ করে তাই রাজবংশী গোষ্ঠীর দৈহিক বৈশিষ্ট্য নাক, মুখ, মুখগহ্বর ও চোয়াল এক্ষেত্রে এই গলাভাঙ্গা বা স্বরভঙ্গির ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক হিসেবে কাজ করে’ (তথ্যসূত্র- সুখবিলাস বর্মা, ভাওয়াইয়া লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, কলকাতা-১৯৯৯)। আবার কেউ কেউ মনে করেন ভাওয়াইয়া গানে গলাভাঙ্গা উচ্চারণের যে বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে তা উত্তরবঙ্গের নৈসর্গিক ও ভৌগোলিক পরিবেশের কারণে ঘটে থাকে। নদীর উপর্যুপরি ভাঙনের ফলে নদীগুলো বার বার বাঁক নিয়ে আঁকাবাঁকা পথে খরস্রোত ধারায় প্রবাহিত হয়। নদীর এই ঘন ঘন ভাঙন ও বাঁক পরিবর্তনের প্রভাব এসে গাঙের পাড়ের মানুষের ওপর পড়ে। তাদের জীবনেও চলে ভাঙা-গড়ার অনেক পরিবর্তন। আর এই প্রভাব পড়েছে নদী পাড়ের মানুষের গাওয়া ভাওয়াইয়া গানের কথা ও সুর বৈচিত্র্যে। নদী ভাঙ্গন ও নানা উত্থান পতন ঘটা স্বাভাবিক বলে অনেকে ধারণা পোষণ করে থাকেন। সুতরাং আমরা বলতে পারি কোন একক বৈশিষ্ট্য মন্ডিত কারণে ভাওয়াইয়ায় গলাভাঙা বা সুরভাঙন বা সুরভঙ্গি ঘটেনি। কিছুটা ভূ-প্রকৃতিজাত ও পরিবেশগত ভৌগোলিক পারিপার্শ্বিকতার কারণে- কিছুটা বিভিন্ন পেশাশ্রেণীর মানুষের পেশাবৃত্তি বা কর্মপ্রবাহজাত আবার তেমনিভাবে কিছুটা আঞ্চলিকতার বেড়াজালে আবদ্ধ ভাব ভাবনা ও ভাষাগত তথা নৃতাত্ত্বিক (জাতিগত) বা গোষ্ঠীগত বৈশিষ্ট্যের সম্মিলিত প্রয়াসের প্রভাবজনিত ফলাফল। ভাওয়াইয়ার ভাষা ও সুরের কাঠামোয় উত্তরাঞ্চলের আঞ্চলিকতার (উপভাষা) প্রাধান্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। রংপুর-দিনাজপুর কোচবিহারের উপ-ভাষার শব্দ ভান্ডার (Vocabulary) শব্দতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব, ধ্বনিতত্ত্ব, বাক্যতত্ত্ব, উচ্চারণরীতি ইত্যাদির সঙ্গে এর কথার ও সুরের নিবিড় সম্পর্ক আছে। অন্য অঞ্চলের ভাষারীতি ও উচ্চারণ ভঙ্গি দ্বারা ভাওয়াইয়া গান বাধা ও সুর তোলা যায় না। শিল্পীর উদাস করা সুরের মূর্ছনার মাঝে ভাঙতি এ গানের সুরের বৈশিষ্ট্য। দোতরা হচ্ছে ভাওয়াইয়ার প্রধান বাদ্য অনুষঙ্গ। ভাওয়াইয়ার পরিসর আপাতদৃষ্টিতে স্বল্প মনে হলেও এর গন্ডি ব্যাপক ও বিস্তৃত। আর এই ব্যাপকতার কারণে কোন একটি বিষয় প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে অন্য বিষয়গুলো এমনিতেই সে হাজির হয়ে যায়। গ্রামীণ মানুষের জীবন-জীবিকা, ভূ-প্রকৃতি, পরিবেশ, ঐতিহ্য ভাওয়াইয়ার ধ্বনি ও রূপতত্ত্বে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে আছে। যেমন-নিদয়া (নির্দয়), হাউস (শখ), গোসা (অভিমান), নিরলে (নির্জনে), নিদান (দুঃসময়), মঙ্গা (অভাব), নিধুয়া (জনশূন্য), মুই (আমি), মাইয়া (স্ত্রী), নিদ (ঘুম), ভাতার (স্বামী), পোয়াতি (প্রসূতি) প্রভৃতি। আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনুসরণে ভাওয়াইয়া গানে বাহে, প্রাণনাথ, ও বন্ধু, গাড়িয়াল, মহিষাল, নাইয়া, মাই, বন্ধুয়া, ওকি, ওমোর, ওরে, আরে, ও ভাই, কালা, বাপোই, ভাইরে, ও কন্যা, এই যে, চেংড়ি প্রভৃতি সম্বোধন পদ সংযোজিত হয়েছে যা মানবিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধেরই বহির্প্রকাশ। লোকজ সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য হলো তথাকথিত ভদ্রসমাজে গ্রহণযোগ্য নয় এমন শব্দের ব্যবহার। ব্যাকরণগত অসম্পূর্ণতা, ছন্দমিলের অসমানতা, ভদ্রশ্রেণীর প্রকাশ্য রুচিতে অগ্রহনযোগ্য নানা শব্দের ব্যবহার, নাগরিক রুচিতে অগ্রহণযোগ্য রূপক ও প্রতীক প্রভৃতি লোকসঙ্গীতে অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। সময়ের পরিক্রমায় গ্রহণ, বর্জন, পরিবর্তন ও পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে কোন কোন শব্দ কোন এক বিশেষ সময়ে বিশেষ ব্যঞ্জনা ও দ্যোতনায় গ্রাম্য লোকজ সংস্কৃতিতে বিশেষভাবে ভর করে বা বহুলভাবে প্রচলিত হতে থাকে। তবে তা আবার কোন এক নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে ধীরে ধীরে ভাব ও ভাষাগত ব্যবহার প্রক্রিয়ায় তেমন একটা উজ্জ্বল্য আর দেখা যায় না যদিও সেটি বাংলা শব্দ ভান্ডারে নিজেকে স্থান করে নেয়। যেমন- সিডর, সাদ্দাম, নার্গিস, বুশ প্রভৃতি শব্দগুলো ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সময়ে গ্রাম্য লোকজ ভাষায় ঢুকে পড়েছে। এক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, অনেকের নাম বাবা-মা বা পাড়া প্রতিবেশী সাদ্দাম রেখেছে। যা তার সুস্থ-সবল, নাদুস-নুদুস চেহারা বা শক্তির প্রতীক হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। সংস্কৃতি ও প্রকৃতি দুটোই যেন এক অপরের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। আমাদের গ্রামবাংলার প্রকৃতির সৌন্দর্যের সঙ্গে আর কোন দেশের তুলনা হয় না। বাংলা সংস্কৃতির ইতিহাসও হাজার বছরের পুরনো। সংস্কৃতি হচ্ছে চলমান জীবনের প্রতিচ্ছবি যা অঞ্চলভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন ভৌগোলিক পরিবেশে গড়ে ওঠে এবং এক অঞ্চলের লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য অঞ্চলের লোকজ সংস্কৃতির কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিল থাকলেও ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। দূরত্ব যতই বেড়ে যায় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগত পার্থক্য ততটাই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটি নির্দিষ্ট এলাকার বা সমাজের মানুষের দৈনন্দিন আচার-আচরণ, কাজ-কর্ম, পোশাক-পরিচ্ছদ, প্রচলিত লোক-কাহিনী, ধর্মীয়-উৎসব অনুষ্ঠান, চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, আবেগ-অনুভূতি, প্রেম-প্রকৃতি সবকিছুই সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভাওয়াইয়া গানকে প্রথম সাংগীতিক মর্যাদায় অভিষিক্ত করে একে আঞ্চলিকতার গন্ডির বাইরে এদেশের সর্বাঞ্চলে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ও ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন বাংলার সঙ্গীত ভুবনের অনন্য পুরুষ ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দিন আহমদ্। ভাওয়াইয়ার প্রসঙ্গ আসলে সবার আগে আসে ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দিনের নাম। বাংলার পল্লীর বাংলার হিন্দু-মুসলমানের বাংলার সহজ-সরল সাধনার দুঃখ বেদনা আশা-নিরাশা প্রাণ ফিরে পেয়েছে এই মহান শিল্পীর মধ্যে। আর তাইতো খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের কণ্ঠে গীত এ ভাওয়াইয়া গান বাঙালী জনজীবন ছাড়িয়ে বিস্তৃত আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে। সেই সঙ্গে আব্বাস উদ্দিন পরবর্তী মহেশ চন্দ্র রায়, হরলাল রায়, ভাওয়াইয়া যুবরাজ মো. কছিম উদ্দিন, কে. এস. এম. আশরাফুজ্জামান সাজু, মকবুল আলী, মুস্তাফা জামান আব্বাসী, ফেরদৌসী রহমান, মোঃ সিরাজ উদ্দিন, মো. নুরুল ইসলাম জাহিদ, নমর উদ্দিন, শমসের আলী প্রধান, রথীন্দ্রনাথ রায়, সুরাইয়া বেলী, রবীন্দ্রনাথ মিশ্র, নীলকমল মিশ্র, নুরুল ইসলাম জাহিদ, সুভাষ চন্দ্র রায়, এ.কে.এম. মোস্তাফিজুর রহমান, অনন্ত কুমার দেব, তরুণী কান্ত রায়, নির্মল কুমার দে, জগৎপতি বর্মা, ভূপতি ভূষণ বর্মা, ভবতরণ, শফিকুল ইসলাম শফি, পঞ্চানন রায়, রণজিৎ কুমার রায়, সচ্ছিদানন্দ রায়, অরুণ কুমার অধিকারী, মনোরঞ্জন রায়, সুনীল রায়, বিশ্বনাথ মোহান্ত, নীতি রাণী রায়, শ্যামলী সরকার, রানু মন্ডল, দুলালী রায়, বিষাদ চন্দ্র বর্মণ, বাদশা আলমসহ উচ্চারিত হয় উত্তরাঞ্চলের আরও অনেক প্রথিতযশা ও প্রতিষ্ঠিত গুণী শিল্পীর নাম এবং ওপার বাংলার কেশব বর্মণ, সুভাষ দাস, হরিশ্চন্দ্রপাল, সুরেন বসুনিয়া, কেদার চক্রবর্তী, গোপাল চন্দ্র দে, যতীন্দ্রনাথ সিংহ সরকার, ধীরেন্দ্রনাথ বসু, সুখবিলাস বর্মা, সুনীল দাস, সুধাংশুশেখর মুস্তাফী, দেশবন্ধু চক্রবর্তী, মাধবচন্দ্র পাল, উপেন্দ্রনাথ সরকার, ছত্রমোহন সরকার, ঝাপুরা বর্মণ, নায়েব আলী টেপু, অরুণ কুমার ভট্টাচার্য, ত্রিফুল্লকুমার রায়, প্রসেনজিৎ বর্মণ, রথীন্দ্রনাথ গোস্বামী, প্যারীমোহন দাস, গঙ্গাধর দাস, ধনেশ্বর রায়, বিরাজ সেন মাঝু, নীলিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, শেফালী সরকার বসু, অসমের প্রতিমা পান্ডে বড়ুয়া ছাড়াও আরও অনেক ভাওয়াইয়া শিল্পী সংগঠক, গীতিকার ও সুরকার। উত্তরাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী ও অত্যন্ত জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত ভাওয়াইয়া। এক সময় ভাওয়াইয়া গান উপমহাদেশে বেশ জনপ্রিয় ছিল। সময়ের আবহে ও কালের আবর্তনে দীর্ঘ সময়ের পথ পরিক্রমায় তথ্যপ্রযুক্তির ডামাডোলে সমাজ সভ্যতা পরিবর্তনের তালগোলে অজো পাড়াগাঁ তথা গাঁও গেরামের খেটে খাওয়া মানুষের গলা থেকে গীত হয়ে ভাওয়াইয়া উঠে এসেছে আজ জৌলুসে ভরা শহুরে জীবনের মসৃণ চাকচিক্যময় অভিজাত মহলের কণ্ঠে। একদা যে ভাওয়াইয়া গাঁও গেরামের প্রত্যন্ত পল্লীতে গীত হতো সময়ের বিবর্তনে সমাজ সভ্যতার প্রেক্ষাপটে আজ তা লোক লোকালয়কে ডিঙিয়ে ধরলা-তিস্তা-ব্রহ্মপুত্রের ভাটি অববাহিকার স্রোতধারায় স্নাত হয়ে শুধু বাংলাদেশের রংপুর, দিনাজপুর এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি ও আসামের গোয়ালপাড়ায় নয় সুদূর অষ্ট্রেলিয়া নিউইয়র্ক লন্ডনে বাদিত ও গীত হচ্ছে অমর ঐতিহ্যিক উদাস করা সুরের মূর্ছনায়।। দুই বাংলার ভাওয়াইয়া গীতিকার, সুরকার, সংগঠক ও শিল্পীদের জীবনী সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রকাশে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ যৌথভাবে ভারত-বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে করা যেতে পারে। ভাওয়াইয়ার আদি কথা ও সুর বিকৃত রোধে স্বরলিপি সহযোগে ভাওয়াইয়া গানের সিডি প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের কণ্ঠে ধারণ করে প্রকাশ ও সংরক্ষণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। যে সমস্ত বাদ্য অনুষঙ্গ ভাওয়াইয়াকে জনপ্রিয় করে তুলেছে সেগুলোর শরীরী অস্তিত্ব সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করতে হবে। ভাওয়াইয়ার আদিতে আদিস্বরে স্বরলিপি ও গ্রামোফোন রেকর্ডে যে স্বরলিপি ব্যবহৃত হয়েছে তা উদ্ধার ও সংগ্রহে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ভাওয়াইয়া সন্ধ্যা, রজনী, ভাওয়াইয়া বিষয়ক অনুষ্ঠান ও সেমিনারের আয়োজন এবং সেই সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে ভাওয়াইয়া প্রশিক্ষণ চর্চায় কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারলে তবেই আদি, করুণ, হাস্য, বীর ও শান্ত রসে সিক্ত পঞ্চসুরের পঞ্চরসে ভরা ভাওয়াইয়া অখন্ড সুরের মূর্ছনায় অগণিত মানুষের অন্তরে দোলা দেবে অপার মহিমায়। ঐতিহ্যবাহী লোকসঙ্গীত ভাওয়াইয়া শুধু দেশের উত্তরাঞ্চলের সংস্কৃতিগত সম্পদই নয় ভাওয়াইয়া আমাদের জাতীয় সম্পদ। আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত ঐতিহ্যবাহী লোকসঙ্গীত ভাওয়াইয়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রচার, প্রসার ও গবেষণায় ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত ও বেসরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারীভাবে জাতীয় পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ একান্ত কাম্য।
×