ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ইব্রাহিম নোমান

মেঘের কাছে চিঠি লিখবে ঘাসফুল

প্রকাশিত: ০৭:১০, ৫ জুলাই ২০১৯

মেঘের কাছে চিঠি লিখবে ঘাসফুল

তপ্ত গ্রীষ্মের প্রহর শেষে ধরণী যখন উত্তপ্ত, এক ফোঁটা বৃষ্টির জন্য হাহাকার করছে প্রতিটি ধূলিকণা তখন এক পসলা বৃষ্টি নামে বাংলার বুকে। সেই বৃষ্টির জলরাশি বেয়ে নাকে আসে সোদা মাটির গন্ধ। আমরা প্রাণ ভরে শ্বাস নিই। মাটিরও যে গন্ধ হয় তা তো এই বর্ষার বৃষ্টিতেই বোঝা যায়! রাজধানী ঢাকায় গ্রীষ্মের ধুলোমলিন জীর্ণতাকে ধুয়ে গাঢ় সবুজের সমারোহে সেজেছে প্রকৃতি। বৃষ্টি এলেই তাই নাগরিক মনে সাড়া পড়ে যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে বর্ষার গান-ছবি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই ভরা বষাতেও রোদের তীব্রতায় বিপর্যস্ত জনজীবন। ভ্যাপসা গরমে টেকা দায়। আকাশে মেঘ থাকলেও সাদা ভেলার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। বৃষ্টি কখনও পথ ভুলে এলেও, এসেই যাই যাই করে। এমন আষাঢ় কে কবে দেখেছে? আকাশে হঠাৎ করে কখনও দেখা মিলছে কৃষ্ণমেঘের ঘনঘটা, কখনওবা নীলাকাশ জুড়ে ভাসছে পেঁজা তুলোর মতো শরতের মেঘ। দিনের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের তাপ ঠিকরে এসে লাগছে গায়ে। বাতাসে যেন আগুনের হল্কা। দিন কিংবা রাতের কোন এক সময়ে বর্ষার বদনাম ঘোচাতে কোথাও হয়ত মিনিট পাঁচেকের বৃষ্টি। কড়া রোদে যেন গাছের পাতারাও স্থির, অনড়। তাতেই ঘেমে- নেয়ে একাকার সকলে। প্রাণিকুলে এমন অস্বস্তি ও নাভিশ্বাস ওঠে গ্রীষ্মকালে। কিন্তু, এবার বর্ষার মাঝামাঝি এসে প্রকৃতির এমন ‘পাগলাটে’ আচরণ প্রত্যক্ষ করছে দেশের মানুষ। বর্ষা ঋতুর চওড়া ব্যাটে ঝুম বৃষ্টির ওভার বাউন্ডারি হাঁকানোর এই মোক্ষম সময়ে উল্টো দেশজুড়ে বইছে হাল্কা থেকে মাঝারি মাত্রার তাপপ্রবাহ। খরতাপের দাপটের কাছে তাই বর্ষার চিরচেনা রূপ এবার যেন অসহায়। তবে এবার আষাঢ়ের প্রথম দিনে বৃষ্টি যেন এসেছিল নিজের পরিচয় জানান দিতেই। তারপর থেকে বর্ষাকে হারিয়ে খুঁজে ফিরছে ঘাসফুল। বর্ষার নতুন জল পেয়ে বৃক্ষরাশি জেগে উঠেছে নতুন করে। যেন তারা এতদিন ধরে আকাশের কাছে প্রার্থনায় ছিল। কখন বৃষ্টি নেমে তাদের প্রাণ ফেরাবে। নদ-নদী-পুকুর সব পানিতে ভরে যায় এ সময়। কাগজে-কলমে আমাদের ছয়টি ঋতু থাকলেও শীত, বসন্ত আর বর্ষার বাইরে অন্যসব ঋতুর উপস্থিতি যেন অনেকটা ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে। নদী তার যৌবন ফিরে পায় এই বর্ষায়। শুধু নদী কেন বর্ষার অপেক্ষায় তাকে আরও কত সৃষ্টি। কেয়া, কদম, কলাবতী, শাপলা, পদ্ম, ঘাসফুল, পানাফুল, কলমী ফুল, কচুফুল, ঝিঙেফুল, কুমড়াফুল, হেলেঞ্চাফুল, কেশরদাম, পানি মরিচ, পাতা শেওলা, কাঁচকলা, পাটফুল, বনতুলসী, নলখাগড়া, ফণীমনসা, উলটকম্বল, কেওড়া, গোলপাতা, শিয়ালকাটা, কেন্দার এবং এছাড়া নানা রঙের অর্কিড রাঙায় প্রকৃতিকে। শুধু কবিতায় নয়, বর্ষা তার সৌন্দর্য, রহস্য ও প্রবল দাপট নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে বাংলা গল্প-উপন্যাসেও। বাংলার জনজীবন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, প্রেম-ভালবাসা, সম্পর্কের মিথষ্ক্রিয়া এসব উপন্যাসে বর্ষার প্রকৃতির সঙ্গে এক সুরে মিশে গেছে। আধুনিক বাংলা গল্প-উপন্যাসেও বর্ষা এসেছে নগর ও গ্রামীণ জীবনের সমস্ত আড়ম্বর ও বিড়ম্বনা নিয়ে। সাম্প্রতিক বাংলাসাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের লেখায় বর্ষা নিয়ে মাতামাতি ছিল রবীন্দ্রনাথের মতোই। তার অসংখ্য উপন্যাসে বর্ষা এসেছে নানা রঙে। বিশেষ করে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ উপন্যাসে। প্রকৃতি তার বিচিত্র স্বভাবের অভিব্যক্তি ঘটিয়ে শিল্পরসিক মানুষ মাত্রকেই অভিভূত করে। বিশ্ব প্রকৃতিতে রূপের যে প্রাচুর্য তাকে ভিত্তি করেই বিভিন্ন দেশে আবহাওয়াগত কারণে এক এক দেশের প্রকৃতি তার অন্তর রূপের প্রকাশ ঘটায়। প্রকৃতির বৈচিত্র্য, বৈশিষ্ট্য ও মাধুর্য প্রকৃতিপাগল মানুষের মনে ঘটায় ভাবের উন্মেষ; ফলে সাহিত্যে রূপ লাভ করেছে প্রকৃতি, যার অন্যতম অনুষঙ্গ ঋতুবৈচিত্র্য। বারান্দায় দাঁড়ালে অকস্মাত চোখ যায় আকাশের দিকে, যেখানে ঘনিয়ে আসছে নিকষ কাজল কালো মেঘমালা, গুরু গুরু মেঘের গর্জন, সেই সঙ্গে ভেজা শীতল বাতাস- তখন কেন জানি মনটা হঠাৎ এলোমেলো হয়ে যায়। স্তরে স্তরে কোথা যেন সুদূর হতে ভেসে আসা মেঘপুঞ্জ মনকে উ™£ান্ত করে দেয়, তাই রবীন্দ্রনাথ গানের ভাষায় বলেন, ‘বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ় এলো আমার মনে।’ মনের আকাশে কত মেঘলা দিন ছায়া ফেলে, স্মৃতিবিধুর হয়ে ওঠে, হৃদয়ের কোনে বেজে ওঠে গানের সুর- ‘এলো যে বরষা।’ যদিও বসন্ত আমাদের ঋতুর রাজা কিন্তু বর্ষার আদর বাংলায় একেবারে অন্যরকম। লেখক, কবি, সাহিত্যিক, গায়ক থেকে শুরু করে বর্ষা আর বৃষ্টিকে নিয়ে চিন্তা করে না এমন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। যে বর্ষাকে ভালবাসে না সে নিতান্তই নিরস। বসন্ত ঋতুর রাজা হলেও বর্ষার ভালোবাসার সঙ্গে তুলনা হয় না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে প্রায় সবাই বর্ষা আর বৃষ্টি নিয়ে কবিতা লিখেছেন। কবিগুরু বর্ষার দিনে কবিতায় লিখেছেন- এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়- এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে তপনহীন ঘন তমসায়... প্রকৃতিতে এই মেঘ-বর্ষার একটি পৃথক রূপ আছে। এই বৃষ্টি আর মেঘ মানুষের মনকে করে তোলে উদাস ব্যাকুল। মন হয়ে ওঠে চঞ্চল, স্মৃতিভাবাতুর। মনে হয় যেন বহুযুগের ওপার হতে নেমে আসছে এই বৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথ এই মেঘ-বৃষ্টি আর বর্ষা নিয়ে লিখেছেন অনেক গান। আর সেই গানে বাংলার বর্ষণমুখর প্রকৃতি যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। নজরুলের গানেও এই বর্ষা প্রকৃতি অপরূপভাবে ধরা দিয়েছে। প্রকৃতির সঙ্গে রয়েছে মানবমনের গভীর সেতুবন্ধন। বর্ষার প্রকৃতি মানবচিত্তে এক অপরূপ রহস্যময় সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে। প্রাত্যহিক জীবনের ব্যস্ততার মাঝে আমরা হারিয়ে যাই নিজেকে নিয়ে ভাবনার অবসর কোথায়? কিন্তু বর্ষার প্রকৃতি আমাদের নিজের মাঝে নিজেকে ফিরিয়ে আনে। নিজেকে নিয়ে ভাববার, নিজের অস্তিত্ব আবিষ্কার করার সুযোগ এনে দেয়। অবিরাম বারিধারা পতনের শব্দময় বর্ষা আমাদের হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশকে আন্দোলিত করে। আকাশ কালো করে হঠাৎ নেমে আসা বৃষ্টির আজও আমাদের মনকে ব্যাকৃল করে তোলে। বৃষ্টির সঙ্গে কি এক মায়াবি সম্পর্ক ‘কেউ কেউ বৃষ্টির ভেতর দিয়ে হাঁটতে পারে, বাকিরা কেবল ভেজে!’ এই যে এক অনুভব, এ নিয়ে আমরা কয়জন ভাবি? বৃষ্টির সঙ্গে মিশে আছে আনন্দ, আছে বিরহ। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের মনের এক নিবিড় সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন কবি-শিল্পীরা। রোদ আর বৃষ্টি যেন ভিন্ন ভিন্ন অনুভব ও আলোড়ন তৈরি করে মানুষের মনে। আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘমালা মানুষকে নিয়ে যায় অজানার কোনো রঙিন দেশে। বাংলার প্রকৃতিতে ছয় ঋতুর বর্ণাঢ্যতা তুমুল রাজসিক ও বৈচিত্র্যময়। আমাদের সব ঋতুর বর্ণ-গন্ধ আলাদা। কিন্তু সব ঋতুই যে বাঙালির মানসলোকে নাড়া দেয়, তা-ও নয়। এমন যদি একটি ঋতুও থাকে, যার সঙ্গে বাঙালিমাত্রই একাত্ম হয়ে ওঠে, তা অবশ্যই বর্ষা। সেই কবে খ্রিস্টপূর্ব বা মতান্তরে খ্রিস্টীয় চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতকের দিকে কবি কালিদাস মেঘদূতের কাব্য সাজিয়েছেন। প্রকৃতির লুকোচুরি খেলা বাঙালীর মনে দোলা দেয়। বিরহী হৃদয়ে জাগিয়ে তোলে আকুলতা, কিশোরী হৃদয়ে ছড়ায় আবীর। গ্রীষ্মের প্রচ- তাপপ্রবাহ আর সুস্বাদু আম-কাঁঠালের মাদকতার পর বৈচিত্র্যময়ী বর্ষা ঋতু বাঙালী জীবনে জাগায় শীতল পরশ। মনে ধরায় নতুন রং এবং জ্বালা। এই জ্বালার দহনে ব্যাকুল কৃষ্ণের বাঁশি শুধু রাখা খুঁজে ফিরে। প্রেমিক খোঁজে প্রেমিকাকে। তাই বর্ষা ঋতু প্রেমের, ভাবের, ভালবাসার ঋতু। এমন র্বষার দিনেই কাব্য ফুটতে চায় মনের ভেতরে। মানুষ স্বজন খোঁজে, পেতে চায় প্রিয়জন। এ সময় নিঃসঙ্গতায় চোখকে মেঘলা করে, মনের মাঠে বয়ে যায় কত না এলোমেলো হাওয়া। প্রিয় কোন স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়ায় জাগিয়ে তোলে হৃদয়ের গভীরে অন্য রকম শিহরণ। এই বর্ষায় দিনেই বুঝি তাই মনের মানুষের কাছেই নিজের মনটিকে মেলে ধরে যায়- বলা যায় জীবনের না বলা কথাটি ‘এমন দিনে তারে বলা যায় এমন ঘনঘোর বরিষায়।’ ষড়ঋতুর বাংলাদেশে প্রতি দুই মাসকে এক একটি ঋতু হিসেবে গণনা করা হলেও এখন তা বৈচিত্র্যহীন। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে প্রতিটি ঋতু। পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের অনেক দেশের মতো শীত-গ্রীষ্ম প্রধান হয়ে উঠছে বাংলাদেশের ঋতুচক্রে। বর্ষা-বর্ষণের মাদকতা নিয়ে বাঙালি কবির নান্দনিক আবেগ সম্ভবত চিরন্তনের ঘরে পৌঁছায়। সে পরিবেশের গুণে অকবিও কবি; লেখার সাধ্য না থাকলেও মনের ভুবনটা তখন পালটে যায়। বর্ষায় কবি যেন নেচে ওঠেন ময়ূরীর মতো। কবি যেন পেখম মেলে লিখতে বসেন বর্ষার বৃষ্টি, মেঘ, আলো, অন্ধকার, জল, কাদা, মেঠোপথ, নদীর থৈ থৈ, নৌকোর ঘাট, বাড়ন্ত জল, মৃদু মৃদু ঢেউ। বাংলার কবি যেন বর্ষার আবেশ পেলে যুগের ঘুম ভেঙে জেগে ওঠেন অদম্য এক যৌবনে। দিনের পর দিন, রাতের পর জেগে প্রতিটি অণুক্ষণ ধারণ করেন মনের কোণে কোণে। দৃষ্টির কোটরে। তারপর শব্দে বাক্যে পয়ারে-নানা ছন্দ তালে-রূপ রস গন্ধ মিলিয়ে ব্যক্ত করেন দৃষ্টিগত রূপের বৈচিত্র্য। বর্ষার রূপ যেন কবিকে মাতিয়ে তোলে শব্দের এক অনন্য নৃত্যকলায়। বর্ষা তার রিনিঝিনি শব্দে প্রকৃতির মনকে কখনো আনন্দে সিক্ত করে, কখনো বেদনা রিক্ত করে আবার কখনো বিরহকাতরতায় মূক করে তোলে অনায়াসে। প্রকৃতির সে ভাব কবি অবলোকন করেন একচোখে, তারপর সে ভাব ভর করে কবির সরল মানসপটে। সেখান থেকে কবি তা তুলে আনেন কলমের কালিতে। প্রকৃতি কবিকে যেভাবে প্রেরণ করে তার গন্ধ কবি সেভাবেই তা ছড়িয়ে দেন কালো অক্ষরে। আনন্দ যেন আর ধরে না! কবি এ-বেলা বৃষ্টির ফুল কুড়ান তো ও-বেলা মেঘের মালা গাঁথেন। ও-বেলা মেঘের মালা তো পরের বেলা ঝড়ের তোড়ে ছিন্ন মালার বেদনায় নীল হয়ে কুঁকড়ে হাঁটেন। সামান্য পরই আবার উঁকি দেওয়া সূর্য কবিকে নিয়ে চলে যায় ঝিলের কাছে, বিলের কাছে, ঘাঁটের কাছে, গ্রাম্য বধূয়ার কলসির কাছে, কবি যেন সে রূপে বিমোহিত হয়ে ফেটে পড়েন অট্ট হাস্যে, ভুলে যান ঘরদোর, বিগত বেদনার লেন-দেন। আর তাকেই উপমা করে কবি রচনা করেন মনের অমৃত সুধা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্ষাকে আর একবাঁকে দেখেননি। বহুবাঁকে বহুপাকে বর্ষা দেখেছেন তিনি। উপস্থাপন করেছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে। রবীন্দ্রনাথই যেন কবিতার মাধ্যমে বর্ষাকে পূর্ণতা দিলেন। তাই তাঁর কবিতায় বর্ষার বিচিত্র রূপ প্রকাশ পায় বন্দনারূপে। আকাশ ঘনকালো করে গুরুগুরু গর্জনে বৃষ্টির অবিরাম ধারা নেমে এলে কবি যেন ফিরে যান তাঁর শৈশব-কৈশোরের দিনগুলোতে। তখনই তাঁর কবিতায় (বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর) ঝরে পড়ে স্মৃতিকাতরতার বৃষ্টি : বাদলা হাওয়ায় মনে পড়ে ছেলে বেলার গান বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এলো বান।... আবার তিনি এ বর্ষাকেই বেছে নিয়েছেন প্রেমিকাকে প্রেম সম্বোধনের উত্তম সময় হিসেবে। বর্ষার বারিধারায় অধিক ব্যাকুল হয়ে আবেগতাড়িত কবি-মন (‘বর্ষার দিনে’ কবিতায়) বলেছেন : ‘এমন দিনে তারে বলা যায় এমন ঘনঘোর বরিষায়- এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে তপনহীন ঘন তমসায়। সে কথা শুনিবে না কেহ আর, নিভৃত নির্জন চারিধার।... বর্ষার ঘনঘটায় কবি রবীন্দ্রনাথ যুগপৎ আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্নায় উদ্বেলিত হয়ে উঠেছেন। বৃষ্টি দেখে তিনি যেমন পুলকিত হয়েছেন তেমনি মেঘের ঘনঘোর দেখে শঙ্কিত হয়েছে। এ কারণেই রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় বর্ষা ফিরে এসেছে বারবার- বহু কবিতায় বিভিন্ন আঙ্গিকে, সৌন্দর্যে-সৌকর্যে। তাই অনেকেই রবীন্দ্রনাথকে বর্ষার কবি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাই বলে বিদ্রোহী খ্যাত কবি কাজী নজরুল ইসলাম আগুনের কবিতাই লেখেননি তাঁকেও প্রভাবিত করেছে বর্ষা। তাঁর কবিতায়ও বর্ষা ধরা দিয়েছে নানা প্রতীকী ব্যঞ্জনায়। ‘বর্ষা বিদায়’ কবিতায় নজরুল গেয়েছেন : ‘যেথা যাও তব মুখর পায়ের বরষা নূপুর খুলি চলিতে চলিতে চমকে ওঠ না কবরী ওঠে না দুলি যেথা রবে তুমি ধেয়ানমগ্ন তাপসিদী অচপল তোমায় আশায় কাঁদিবে ধরায়, তেমনি ফটিক জল।’ বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমান তার এমন বর্ষার দিনে কবিতায় লিখেছেন- চল্লিশটি বর্ষার সজল স্পর্শ তোমাকে আকুল করে আজো, আজো দেখি তুমি জানালার কাছ ঘেঁষে বাইরে তাকিয়ে আষাঢ়ের জলধারা দ্যাখো খুব মুগ্ধাবেশে; মনে হয়, আষাঢ় তোমার মন আর হৃদয় শ্রাবণ। ... ভরা বর্ষা, কিন্তু আকাশে নেই কালো মেঘ, নেই বৃষ্টির দেখা। খরতাপে পুড়ছে দেশ। আষাঢ়ের আকাশ মানে কালো মেঘের ঘনঘটা। তার বদলে রৌদ্রজ্জ্বোল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা মেঘের ভেলা। তীব্র গরম আর তাপদাহে পুড়ছে মানুষ। আষাঢ়ের ষোল দিন শেষে বরষা এসেছে ময়ূরের পেখম মিলে ! হাওরে বর্ষা ধরা দেয় অন্য রূপে। হাওরের বিলে পানকৌড়ির রোদ পোহায়। হিজল বরুণ করচ গাছেদের পাতাহীন ডালে- দলবেঁধে বসত। ভরা বর্ষায় সারি সারি হিজল বরুণ করচ গাছ নির্বিঘ্নে পানির উপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে। কী অপরূপ! ভরা বর্ষার নিঝুম বিকালে হাওরের পানির সঙ্গে এসব গাছেদের সখ্যতার সৌন্দর্য একবার দেখলে মনে লেগে থাববে আমৃত্যু। ঝর্ণা ফুল কেউ চেনেন? দেখেছেন? হাওর পাড়ে বেড়ে ওঠা যে কাউকে জিজ্ঞেস করলে, নামে না চিনলেও ছবি দেখালেই চিনতে পারবে। এখানের প্রতিটি গ্রামের আনাচে কানাচে, গভীর হাওরের কান্দায় অথবা বিলের ধারে এই ফুলের অপূর্ব সমারোহ দেখা যায়। এরা অবহেলা অযত্নে জন্মে। সাধারণত পৌষের শুরুতেই ফোটে। বর্ষায় চিরচেনা হাওর যেন অপরিচিত হয়ে ওঠে। হাওরের পানির বিশালত্ব সমুদ্রের কথা মনে করিয়ে দেয়। গ্রামগুলোর চারপাশে শুধু পানি আর পানি। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে নৌকার কোনো বিকল্প নেই। বর্ষায় হাওরের ভাসমান ঘরবাড়ি, গ্রামগুলো যেন এক একটি দ্বীপ। বৈচিত্র্যে ভরা বর্ষার হাওর ভূ-প্রাকৃতিক অচেনা এক আবাসন। তাই বর্ষা হাওরকে রানীর সাজে সাজিয়ে রাখে। প্রকৃতির এই অনন্য সুন্দর রমণীকে সূর্য ডোবার পূর্বমুহূর্তে কিংবা জ্যোৎস্না রাতে আরও মোহনীয় হয়ে ওঠে। তখন হাওর শাসন করবে আপনার আবেগ, ভালোবাসা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে। মনে করিয়ে দেবে এই তো অনাদিকালের প্রকৃতি। যা স্রষ্টার অপূর্ব সৃষ্টি। বর্ষার হাওর আপনার হৃদয়ে বিশেষ স্থান দখল করে নেবে। বর্ষায় পানিতে দ্বীপের মতো গ্রামগুলো ভেসে থাকে। হাওরের প্রবহমান সাগরসম স্রোতধারা আর বাতাসের মিলনে থই থই পানির তা-ব নৃত্য আর হাওরের বিশাল ঢেউয়ের আঘাতের নাম আফাল। সাহসী মানুষের কাছে তা অন্যরকম সৌন্দর্য। বর্ষাকাল নিয়ে গান-কবিতা যতটা হয়েছে বাংলা সাহিত্যে অন্য কোন ঋতুর রূপবৈচিত্র্য নিয়ে ততটা নয়। মেঘ, বৃষ্টি আর অবিরাম বর্ষণের নৈসর্গিক বর্ণনায় বাংলা সাহিত্য ঋদ্ধ। সুকুমার রায় লিখেছেন- কাগজ কলম লয়ে বসিয়াছি সদ্য, আষাঢ়ে লিখিতে হবে বরষার পদ্য। কি যে লিখি কি যে লিখি ভাবিয়া না পাই রে, হতাশে বসিয়া তাই চেয়ে থাকি বাইরে। সারাদিন ঘনঘটা কালো মেঘ আকাশে, ভিজে ভিজে পৃথিবীর মুখখানা ফ্যাকাশে।... পল্লী কবি জসিমউদ্দীনের কবিতায় বর্ষা এসেছে আরেক রকম ব্যঞ্জনা হয়ে। তিনি উদাস হয়ে দেখেছেন বর্ষার রূপ। সে রূপে এমনই ব্যাকুল হয়েছেন যে তিনি কোনো পথ আর খুঁজে পান না, সব পথই আনন্দে ভরপুর : ‘আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছল ছল জলধারে বেণু-বনে বায়ু নাড়ে এলো কেশ, মন যেন চায় কারে।’... রূপ বৈচিত্র্যে বর্ষা অতুলনীয়। বর্ষাকাল বাঙালি জাতির প্রাণের ঋতু। ভালবাসার সিক্ত স্পর্শে আরও বেশি সজীব-প্রাণবন্ত। বর্ষা মানব মনে সঞ্চার করে অনন্ত বিরহ-বেদনা-সুখ। মনকে উদ্ভাসিত করে অনন্ত সৌন্দর্যলোকে। মহাদেব সাহা বলেছেন কাগজ আবিষ্কারের আগে মানুষ প্রেমের কবিতা লিখে রেখেছে আকাশে। সেই ভালোবাসার কবিতা এই বৃষ্টি এই ভর বর্ষা। নাগরিক জীবনে তীব্র দাবদাহ মানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কাটিয়ে আকাশে প্রেমের বারিধারা যেন এই বর্ষায় নেচে উঠে তার জন্য মেঘের কাছে চিঠি লিখবে ঘাসফুল। [email protected]
×