ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুস্তাফিজকে নিয়ে উচ্ছ্বাসের মাঝে তামিমকে নিয়ে কষ্ট

ভারতের বিরুদ্ধে পরাজয়ে চারদিকে হতাশা!

প্রকাশিত: ১১:৪৫, ৪ জুলাই ২০১৯

ভারতের বিরুদ্ধে পরাজয়ে চারদিকে হতাশা!

মিথুন আশরাফ ॥ ভারতের বিপক্ষে ২৮ রানে হেরে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়েছে বাংলাদেশ। তাতে চারিদিকে হতাশা জড়িয়ে ধরেছে। জয়ের সুযোগ তৈরি করা যেত। এমনকি জয়ও হয়তো পাওয়া যেত। যদি রোহিত শর্মার ক্যাচটি তামিম ইকবাল মিস না করতেন। ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সাকিব আল হাসান ও মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের সঙ্গে আরেকজন হাফ সেঞ্চুরি করতে পারতেন। হয়নি। তাই মুস্তাফিজুর রহমানের নিজের বিশ্বকাপ সেরা বোলিংয়েরও বিশেষ কোন তাৎপর্য থাকল না। ম্যাচ শেষে তাই হতাশাই শুধু যুক্ত হলো। মুস্তাফিজকে নিয়ে উচ্ছ্বাসের মাঝে তামিমকে নিয়েও থাকল কষ্ট। এখনও আরেক ম্যাচ বাকি আছে। বিশ্বকাপ শেষ হয়ে গেলেও বাংলাদেশের খেলা এখনও বাকি আছে। শুক্রবার লন্ডনের লর্ডসে পাকিস্তানের বিপক্ষে লড়াই করবে বাংলাদেশ। সেটিই বাংলাদেশের এবার বিশ্বকাপে শেষ ম্যাচ হবে। ম্যাচটি জিততে পারলে মাথা উঁচু করেই মাঠ ছাড়তে পারবে বাংলাদেশ। হারলে হতাশা আরও বেশি করে ঘিরে ধরবে। কিন্তু এ মুহূর্তে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটি নিয়ে নয়, সবার মনের ভেতর বারবার উঁকি দিচ্ছে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটি। ম্যাচটিতে ভারত যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল তাতে মনে হচ্ছিল ৪০০ রান করে ফেলবে। কিন্তু সাকিবের সঙ্গে ৫ উইকেট শিকার করা মুস্তাফিজের দুর্দান্ত বোলিংয়ে ৩১৪ রানেই ভারতকে আটকানো গেছে। হয়তো ভারতকে আরও আগেই আটকানো যেত। যদি ৯ রানে থাকা রোহিতের ক্যাচটি ধরতে পারতেন তামিম। সেই রোহিত শেষ পর্যন্ত ১০৪ রান করে মাঠ ছাড়েন। প্রথম উইকেটেই ভারত ১৮০ রান তুলে ফেলে। যেখানে ১৮ রানেই ১ উইকেট পড়তে পারত। তামিমের এই ক্যাচ মিসে শুরুতেই আসলে হতাশা জড়িয়ে পড়ে। এরপরও সাকিব-মুস্তাফিজ মিলে ভারতের রানের চাকা দুর্বল করেন। মুস্তাফিজতো ভারতকে পেয়ে আবারও জ্বলে ওঠেন। বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে প্রথমবার খেলতে নামেন। প্রথমবারেই ১০ ওভার বোলিং করে ১ মেডেনসহ ৫৯ রান দিয়ে ৫ উইকেট নেন ‘কাটার মাস্টার’। আরেকটি উইকেট পেতে পারতেন। বিশ্বকাপে ৬ উইকেট নেয়া বামহাতি পেসারদের চারজনের ছোট্ট তালিকায় তিনিও থাকতেন। কিন্তু রোহিতের ক্যাচটি তামিম ধরতে পারেননি। দলের ১৮ রানের সময় রোহিতের ৯ রান ছিল। এমন মুহূর্তে খেলা পঞ্চম ওভারে চলছিল। ওভারের চতুর্থ বলে মুস্তাফিজের করা শর্ট বলটি ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে টাইমিং হয়নি। ডিপ স্কয়ার লেগে তামিমের বুক উচ্চতায় থাকে বলটি। কিন্তু তামিম ধরতে পারেননি। এরচেয়েও কঠিন ক্যাচ ধরেন তামিম। দলের সেরা ফিল্ডারদের মধ্যেও আছেন তিনি। অথচ সহজ ক্যাচটি ফসকে যায়। তখনই হতাশা জড়িয়ে ধরে। রোহিতের মতো ব্যাটসম্যানকে সুযোগ দিলে কি আর রক্ষা পাওয়া যায়। সেই রোহিতই ডুবিয়ে দেন। কিন্তু শেষ ১০ ওভারে মুস্তাফিজ এমনই ঝলক দেখান, তাতে রান যে আকাশচুম্বী হওয়ার ইঙ্গিত মিলছিল। তা হয়নি। না হওয়ার পিছনে কারিগর একজনই। তিনি মুস্তাফিজ। সঙ্গে সাকিবও ভারত ব্যাটসম্যানদের রুখে দেন। তবে আলো ছড়ান মুস্তাফিজই। বিশ্বকাপে প্রথম বাংলাদেশী পেসার হিসেবে ৫ উইকেট শিকার করেন তিনি। দেশের পক্ষে এক আসরে সর্বাধিক ১৫ উইকেট দখলের রেকর্ডও গড়েন মুস্তাফিজ। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের যাত্রা ভারতের বিপক্ষেই ২০১৫ সালে ম্যাচ দিয়ে শুরু করেন। প্রথম ম্যাচেই ৫০ রানে ৫টি উইকেট নিয়ে কাঁপিয়ে দেন। পরের ম্যাচে আবার ৪৩ রানে ৬ উইকেট নিয়ে নিজের আগমন জানিয়ে দেন। সেই থেকে ভারতকে সামনে পেলেই যেন গর্জে ওঠেন মুস্তাফিজ। দেশের পক্ষে বিশ্বকাপে মুস্তাফিজ দ্বিতীয় সেরা বোলিং করেন। বাঁহাতি স্পিনার সাকিব আগের ম্যাচে যে ২৯ রান দিয়ে ৫ উইকেট নেন, সেটি সেরা। তবে বিশ্বকাপের এক আসরে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বাধিক উইকেট মুস্তাফিজের। ৭ ম্যাচে ১৫ উইকেট শিকার করেন মুস্তাফিজ। বাঁহাতি স্পিনার আব্দুর রাজ্জাক ২০০৭ বিশ্বকাপে ৯ ম্যাচে নিয়েছিলেন ১৩ উইকেট। মুস্তাফিজ সেটিকেও টপকে যান। ভারতের বিপক্ষে মঙ্গলবার প্রথম দুই ওভারে মাত্র ৫ রান দিলেও পরের ২ ওভারে ১৮ রান দেন। ৪ ওভারের প্রথম স্পেলে ২৩ রান দিয়ে ছিলেন উইকেটশূন্য। কিন্তু রোহিতের উইকেটটি পেতে পারতেন। ইনিংসের ২৪তম ওভারে আক্রমণে ফিরে প্রথম বলেই রোহিত শর্মার কাছে ছক্কা হজম করে ওভার শেষ করেন ১১ রান দিয়ে। আবার ফেরেন ৩৯তম ওভারে। সেই ওভারটিতে দারুণভাবে দলকে ম্যাচে ফিরিয়ে আনেন মুস্তাফিজ। দ্বিতীয় বলে ভারতীয় অধিনায়ক বিরাট কোহলিকে সাজঘরে ফেরান। চতুর্থ বলে বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান হারদিক পা-িয়াকে আউট করে দেন। ওভারটিতে মেডেনসহ ২ উইকেট শিকার করেন মুস্তাফিজ। ৪২তম ওভারে আবার আক্রমণে আনা হয় মুস্তাফিজকে। সেই ওভারে ১০ রান দেন। আবার ৪৬তম ওভারে ফিরেন। শেষের ৩টি ওভার দুর্দান্ত বোলিং করেন ফিজ। ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা ঠিকভাবে খেলতে পারেননি তাকে। ৪৬তম ওভারে ৯ রান দেয়ার প্রতিশোধ নিয়েছেন ৪৮তম ওভারে দীনেশ কার্তিককে তুলে নিয়ে। ইনিংসের শেষ ওভারে মাত্র ২ রান দিয়ে মহেন্দ্র সিং ধোনি ও মোহাম্মদ শামিকে তুলে নিয়ে ওয়ানডে ক্যারিয়ারে চতুর্থবারের মতো ইনিংসে ৫ উইকেট শিকারের কীর্তি দেখান। এর আগে বিশ্বকাপে বাংলাদেশী পেসারদের মধ্যে সেরা বোলিং করেছিলেন ডানহাতি শফিউল ইসলাম। ২০১১ বিশ্বকাপে মিরপুরে তিনি আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে নিয়েছিলেন ৮ ওভারে ২১ রানে ৪ উইকেট। এবার মুস্তাফিজ দেশের পেসারদের মধ্যে সেরা বোলিং করেন। পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে আর দু’টি উইকেট নিলে ষষ্ঠ বাংলাদেশী হিসেবে ১০০ ওয়ানডে উইকেটের মালিক হবেন তিনি। ভারতের ইনিংস শেষে তামিমের ক্যাচ ছাড়ার হতাশার সঙ্গে মুস্তাফিজকে নিয়ে উচ্ছ্বাস দেখা যায়। কিন্তু ম্যাচ শেষে আসলে কোন উচ্ছ্বাসই থাকেনি। শুধু হতাশাই ছিল সঙ্গী। তামিম ব্যাট হাতেও হতাশ করেন। সাকিব আবারও নিজে উজ্জ্বলতা ছড়ান। ৬৬ রানের ইনিংস খেলেন। শেষে গিয়ে সাইফউদ্দিনতো আশার বাতি জ্বালিয়ে দেন। কিন্তু বাকিরা ব্যর্থ হওয়াতে ২৮৬ রানেই দম ফুরায় বাংলাদেশের। তাতে করে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় ঘণ্টা বেজে যায়। এমন হারে যে হতাশা ভালভাবেই যুক্ত হয়েছে তা প্রধান কোচ স্টিভ রোডসের কণ্ঠেও পরিষ্কার। তিনি বলেছেন, ‘শুরুতেই বলে নেই, আমাদের ড্রেসিং রুমে ক্রিকেটার ও কোচরা সবাই হতাশ। সত্যি বলতে, সাপোর্ট স্টাফের সবাই (হতাশ)। আমরা এই টুর্নামেন্টে ভাল করতে মরিয়া ছিলাম, চেষ্টা করেছিলাম এগিয়ে যেতে। শেষ পর্যন্ত সেটি হয়নি।’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘আমরা খুব ভাল একটি দলের বিপক্ষে খেলেছি। এমন একটি দল যাদের আমি মনে করি বিশ্বের এক নম্বর। আমরা চেষ্টা করেছি, কিন্তু শুরুতে কিছু ভুলের কারণে পেরে উঠিনি।’ সেই ভুলটি যে তামিমের ক্যাচ ছাড়া তা না বললেও বুঝে নেয়া যায়। তবে তামিমকে ভাল সমর্থনই দিয়েছেন কোচ। জানিয়েছেন, ‘এত বছর ধরে ক্রিকেট দেখছি, খেলেছি। কাজেই জানি, ক্যাচ মিস কতটা মূল্যবান হতে পারে। যদিও জানতাম না, কতটা মূল্য দিতে হবে। আশায় ছিলাম যে দ্রুতই আরেকবার সে ক্যাচ দেবে।’ সঙ্গে আরও বলেন, ‘রোহিত শর্মা বিশ্ব ক্রিকেটের দাওুণ এক ব্যাটসম্যান। তার মতো ব্যাটসম্যানকে বা কোহলিকে সুযোগ দিলে তার মূল্য চুকাতে হবেই। ক্যাচটি ছেড়েছে তামিম। আউটফিল্ডে আমাদের সবচেয়ে নিরাপদ ফিল্ডারদের একজন সে। এ জন্যই তার মিস কিছুটা বিস্ময়কর। তবে সেও মানুষ, আমরা সবাই মানুষ। আমিও জীবনে অনেক ক্যাচ ছেড়েছি। ক্রিকেট যারা খেলেছে সবাই ছেড়েছে। তবে কখনও কখনও ক্যাচ মিসের চড়া মূল্য দিতে হয়, এখানে যেমনটি হয়েছে।’ অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজাও আগলে রেখেছেন তামিমকে। সঙ্গে মুস্তাফিজের বোলিংয়ের প্রশংসা করেছেন। কেন জিততে পারেননি, সেই ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। মাশরাফি বলেছেন, ‘এই ম্যাচটি আমাদের জেতা উচিত ছিল। আমরা এটা করতে পারিনি। কিন্তু অনেকেই ভাল পারফর্মেন্স করেছে। বিশেষ করে মুস্তাফিজুর। তাদের (যারা ইনিংস বড় করতে পারেননি) কেউ একজন ৮০-৯০ করতে পারলে সম্ভাবনা ছিল। ভাগ্য আমাদের সহায় হয়নি। টুর্নামেন্টটি দারুণ ছিল। সাকিব অসাধারণ পারফর্মেন্স করেছে এবং মুশি (মুশফিক) দারুণ ব্যাট করেছে ঠিক সময়ে।’ ভারতের বিপক্ষে জিতলেও সেমিফাইনাল নিশ্চিত হতো এমনটি নয়। তবে এক ম্যাচ আগেই ছিটকে পড়তো না বাংলাদেশ। তাতেই হতাশ সবাই। তাছাড়া ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে যে ভুল হয়েছে, সেই ভুল হতাশা আরও বাড়িয়েছে।
×