ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এক মানবিক গল্পের চলচ্চিত্র ‘জন্মভূমি’

প্রকাশিত: ০৯:০৭, ৪ জুলাই ২০১৯

এক মানবিক গল্পের চলচ্চিত্র ‘জন্মভূমি’

অসংখ্য হারিয়ে যাওয়া শিশুর একটি অস্থায়ী আশ্রয়স্থল এবং তাদের অভিভাবকের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া একটি চলচ্চিত্রের দৃশ্যে দেখা যায়। বলছিলাম মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে নির্মিত ‘জন্মভূমি’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যের কথা। হারানো শিশুদের আশ্রয়স্থলটি যার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় সেই মানিক চরিত্রটিও প্রায় ১০ বছর আগে শিশু বয়সে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা এখনকার ২৫ বছর বয়সের এক যুবক। কী বিচিত্র নিয়ম আমাদের এই পৃথিবীর? যার নিজের কোন ঠিকানা নেই; কোথায় আছে তার পরিবার পরিজন সেটিও জানা নেই সেই ঠিকানাবিহীন যুবকই অসংখ্য হারিয়ে যাওয়া শিশুর ঠিকানা খুঁজে দেয়ার মানবিক দায়িত্ব পালন করে চলেছে। ঘটনাটি নিঃসন্দেহে ধাক্কা খাবার মতো। এই আশ্রয়কেন্দ্রেই আকস্মিকভাবে মানিকের সঙ্গে দেখা হয় মিয়ানমার থেকে জীবন নিয়ে পালিয়ে আসা ২৩ বছর বয়সী ৬ মাসের অন্তঃসত্ত্বা এক নারী সোফিয়ার সঙ্গে। ঘটনাক্রমে মানিকের সঙ্গে সোফিয়ার খুব দ্রুতই একটি সখ্যও গড়ে ওঠে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার নৃশংসতায় জীবন হারায় সোফিয়ার স্বামী। প্রতিবেশীদের সঙ্গে কোন রকমে নিজের জীবন এবং গর্ভে ধারণ করা সন্তান নিয়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয় সে। আশ্রয় মিলে বাংলাদেশ সীমানার কক্সবাজার জেলার কুতুপালংয়ের রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে। সেখানে কোন রকমে ঠিকানা হয় ৮ ফিট বাই ১০ ফিটসাইজের এক খুপড়ি ঘর। মিয়ানমার সরকার ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালালে জীবন বাঁচাতে প্রায় ১১ লাখ শরণার্থী নিজেদের জন্মভূমি ছেড়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এর মধ্যে প্রায় ৬৫ হাজার নারী গর্ভবতী ছিল এবং অনেকে মিয়ানমার আর্মি দ্বারা ধর্ষিত হয়। এই ৬৫ হাজার হতভাগ্য নারীরই একজন প্রতিনিধি সোফিয়া। নিজেই দেশ ছাড়া; জন্মভূমি ছাড়া সেখানে অনাগত সন্তান! কী বিভীষিকাময় পরিস্থিতি ভাবা যায়? এই গল্পে সোফিয়ার আত্মপরিচয়ের সঙ্কট এবং তার জীবনের বয়ানের মাধ্যমে নির্মাতা দেশহীন অসহায় ৬৫ হাজার গর্ভবতী নারীর কথা বলতে চয়েছেন। অন্যদিকে মানিক অসংখ্য হারিয়ে যাওয়া শিশুর প্রতিনিধি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যে কী-না একটি হারিয়ে যাওয়া শিশু। হারানো জীবনেই এখন ২৫ বছর বয়সের এক যুবকে পরিণত হয়েছে। নারী এবং শিশু হচ্ছে মানব সমাজের সবচেয়ে সংবেদনশীল অংশ। এই সংবেদনশীল অংশটি রোহিঙ্গা সঙ্কটের মাধ্যমে যে- চরম মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে পতিত হয়েছে সেটিই বোঝাতে চেয়েছেন নির্মাতা। সবমিলিয়ে পুরো ১১ লক্ষাধিক মানুষ যে সীমাহীন মানবিক বিপর্যয়ে পতিত হয়েছে- নির্মাতা সেটি সুনিপুণ মুন্সিয়ানায় ফুটিয়ে তুলেছেন এই চলচ্চিত্রে। দর্শক হিসেবে দুটি দৃশ্য আমাকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছে। প্রথমটি হলো গাইডরূপী জয়নাল জ্যাক এবং ভিনদেশী অভিনেত্রী পামেলা কেচার গাড়িতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাবার সময় গাইডের কণ্ঠে, ‘স্বর্গ আর নরক খুব বেশি দূরে নয়’ অভিব্যক্তিটি এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে ফিরে আসার সময় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে ভিনদেশী পামেলা কেচার গাড়ি থেকে নেমে সৈকতের দিকে এগিয়ে যাওয়া ও স্বর্গ-নরক খুব বেশি দূরে নয় বিষয়টি উপলব্ধি করাটা চোখে পড়বার মতো। আর একটি দৃশ্য হলো, সৌদি আরব কর্তৃক রোবট সোফিয়ার নাগরিকত্ব লাভের নিউজটি টিভিতে দেখে অভিনেতা নাসির উদ্দিনের মন্তব্যটি নাড়া দেয়ার মতা। রোবটও নাগরিকত্ব পায় কিন্তু মানুষ নাগরিকত্ব পায় না বিষয়টি এভাবেই উঠে এসেছে তার মন্তব্যে। ৯০ মিনিট দৈর্ঘের পুরো চলচ্চিত্রে সোফিয়ার আত্মপরিচয় সঙ্কট, রিফিউজি ক্যাম্পের সংগ্রামী জীবনকে মেনে না নেয়া এবং নিজ জন্মভূমিতে ফেরার এক নির্মম আকুতি বার বার ফুটে উঠেছে। নিজের অনাগত সন্তানকে রোহিঙ্গা শিবিরে কোনভাবেই জন্ম দিতে চায় না সে। একমাত্র ভরসাস্থল হয়ে ওঠা মানিকের উপর ভর করে সোফিয়া একসময় জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন বোনে। নানা ঘটনা পেরিয়ে একদিন সত্যি সত্যি মানিককে সঙ্গী করে সোফিয়া নাফ নদীতে নৌকা ভাসায় জন্মভূমির উদ্দেশে পাড়ি দেয়ার জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা জানতে পরিনি সোফিয়া-মানিকের সেই নৌকা ভাসতে ভাসতে মিয়ানমার সীমান্তে পৌঁছাতে পেরেছিল কীÑনা; তারা তাঁদের জন্মভূমিতে ফিরে যেতে পেরেছিল কীনা। এর কাহিনী, চিত্রনাট্য এবং পরিচালনা করেছেন খ্যাতিমান নির্মাতা প্রসূন রহমান। নির্মাণের প্রতিটি স্তরে তিনি মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাস্তবভিত্তিক লোকেশন, সেই অনুযায়ী দৃশ্যায়ন, আবহসঙ্গীত এবং সম্পাদনার নেপথ্যে যারা কাজ করেছেন তারা সবাই এক অপূর্ব কাজের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। ব্যাপক আকারে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে এত অল্প সময়ে ২০১৮ সালের মধ্যেই একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। টিম লিডার হিসেবে পুরো কাজটি সুন্দর সমন্বয় করে দর্শকের কাছে সার্থকভাবে পৌঁছে দেয়ার জন্য পরিচালক প্রসূন রহমানকে অভিবাদন জানাই। আমার কাছে মনে হয়েছে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ যেমন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্ব বিবেককে মানবিকভাবে নাড়া দেয়ার মতো মহান কাজ করেছে ঠিক তেমনি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নয়; একটি সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে প্রযোজনা সংস্থা চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছে। এই চলচ্চিত্রের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন রওনক হাসান, সায়রা আক্তার জাহান, সঙ্গীতা চৌধুরী, অঙ্কন চাকমা, জয়নাল জ্যাক, নাসির উদ্দিন এবং একটি বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করেছেন জার্মান অভিনেত্রী পামেলা কেচার। প্রত্যেক অভিনেতা অভিনেত্রী প্রতিটি চরিত্রকে যার যার চরিত্রে ফুটিয়ে তুলতে শত ভাগ সার্থক হয়েছেন। চলচ্চিত্রটি গত বছর ১৪ ডিসেম্বর মুক্তি পেয়েছে। এরই মধ্যে অনেকগুলো আন্তর্জাতিক উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে এবং বিশ্ব চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের মাঝেও যথেষ্ট প্রশংসা লাভ করেছে বলে সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায়। সামনে আরও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এটি প্রদর্শিত হতে যাচ্ছে। নিজ দেশে ফেরানোর ব্যাপারে বিশ্ব জনমত গঠনে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে নির্মিত একমাত্র পূর্ণদৈর্ঘ্য এই চলচ্চিত্রটি বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে।
×