ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

শতাব্দীর ভয়াবহ দুর্যোগে পাকিস্তান ॥ ৪ জুলাই, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৮:৪৬, ৪ জুলাই ২০১৯

শতাব্দীর ভয়াবহ দুর্যোগে পাকিস্তান ॥ ৪ জুলাই, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ৪ জুলাই দিনটি ছিল রবিবার। এই দিন পাকবাহিনীর দুই কোম্পানি সৈন্য ফেনী থেকে বিলুনিয়া যাওয়ার পথে শালদা বাজারে সাময়িক অবস্থান নেয়। এ সময় ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের এক প্লাটুন যোদ্ধা ৩ ইঞ্চি মর্টারসহ পাকসেনাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে পাকবাহিনীর ৩০ জন সৈন্য নিহত হয়। পাকবাহিনীর একদল সৈন্য মুক্তিবাহিনীর কুমিল্লার কোটেশ্বর ঘাঁটির সম্মুখবর্তী হলে মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক আক্রমণ চালায়। এতেও মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির সামনে টিকতে না পেরে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত হয়ে পিছু হটে। এ যুদ্ধে পাকবাহিনীর কমপক্ষে ৩০ জন সৈন্য হতাহত হয়। এদিন দিনাজপুরে মেজর নাজমুল হকের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকবাহিনীর কাঞ্চন সেতু ঘাঁটি আক্রমণ করে। পূর্ব-দিনজিপুরের পঁচাগড়ের ৮ মাইল উত্তরে পাকবাহিনীর অমরাখানা সীমান্ত ঘাঁটির ওপর মুক্তিবাহিনী তুমুল আক্রমণ চালায়। তীব্র যুদ্ধ শেষে অমরাখানা সীমান্ত ঘাঁটি মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। রংপুরের গড্ডিমারীতে মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ হয়। মুক্তিবাহিনী ঠাকুরগাঁওয়ের ১৪ মাইল উত্তর-পশ্চিমে পাকবাহিনীর লাহিড় চৌকির ওপর কামান ও মর্টারের সাহায্যে তীব্র আক্রমণ চালায়। পাকিস্তান ব্রিটেনের কাছে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট, বিবিসি ও সংবাদপত্রে বাংলাদেশের পক্ষে ও পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রচারণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। প্রতিবাদ লিপিতে লন্ডনে বাংলাদেশ সংগ্রাম কমিটির মাধ্যমে দায়িত্বপূর্ণ ব্রিটিশ নাগরিক ও বিদেশীরা (বাঙালীরা) যে কর্মতৎপরতা চালাচ্ছেন তার প্রতি ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। লিপিতে বলা হয়-গ্রেট ব্রিটেনে বাংলাদেশের জন্য অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ কেনার উদ্দেশ্যে তহবিল সংগ্রহ করা হচ্ছে। ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে- সাতক্ষীরা থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য এ্যাডভোকেট আব্দুল গফফার ভারত থেকে ফিরে এসে নিজেকে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের কাছে সোপর্দ করেছেন। ফেনী থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য ওবায়দুল্লাহ মজুমদার বর্তমানে সপরিবারে ঢাকায় অবস্থান করছেন। ইরানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেড হাসান জাহেদী পাকিস্তানের সংহতি ও ঐক্য রক্ষার কাজে পাকিস্তানের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেন। ভ্যাটিকানের মহামান্য পোপ পল থেকে শুরু করে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলে উথান্ট এবং পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে বর্বরতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ, ধিক্কার আর ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ সফর করে গিয়ে মিঃ বটমলি সাংবাদিকদের বলেছেন, ইয়াহিয়া তার সাম্প্রতিক বেতার বক্তৃতায় যে রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলেছেন তা স্রেফ ধাপ্পাবাজি। ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি দলের অন্যতম সদস্য মিঃ টোবি জেসেল ও বিশিষ্ট সদস্য মিঃ আর্নেস্ট প্রিন্টিসও এ ব্যাপারে মিঃ বটমলির সঙ্গে একমত। মিঃ টোবি জেসেল বলেন, রাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থা বিপজ্জনক। নিউইয়র্ক টাইমস এক রিপোর্টে বলা হয়, বহু বছর ধরে পূর্ব পাকিস্তানে আছেন এমন একজন বিদেশী জিজ্ঞেস করলেন বিশ্ববাসী কি এখনো বুঝতে পারছে না যে পশ্চিম পাকিস্তানীরা কসাই ছাড়া কিছু নয়? দ্য স্টেটস ম্যান এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র আজ মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন পাকিস্তানী প্রচারণা থেকে ভুল বোঝা যাবে না। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ইংরেজী অনুষ্ঠান ওয়ার্ল্ড প্রেস রিভিউ অন বাংলাদেশে বলা হয়েছে, ইয়াহিয়া বাংলাদেশের ৭৫ মিলিয়ন লোকের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতার ওপর অব্যাহতভাবে নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। ডানপন্থী প্যারিস দৈনিক ‘লা ফিগারো’-কে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি শেখ মুজিবকে একজন অপরাধী এবং নাবালক ফ্যাসিবাদী ‘বলেছেন। দুর্ভাগ্যবশত ‘লা ফিগারো’ সংবাদদাতা তাকে মনে করিয়ে দিতে ব্যর্থ হয় যে তার বর্বর সেনাবাহিনী নিরস্ত্র এবং নিরীহ বেসামরিকদের ওপর লেলিয়ে দেয়া হয় এবং শুধু একটি কাপুরুষোচিত সেনাবাহিনীই নারী ও শিশুদের ওপর যুদ্ধ ঘোষণা করে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×