ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সাধারণ মানুষের খবর -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৮:৪৫, ৪ জুলাই ২০১৯

 সাধারণ মানুষের খবর -স্বদেশ রায়

গত কয়েক মাস ধরে নানান পেশার মানুষের সঙ্গে মেশার বেশ সুযোগ হচ্ছে। আনন্দও পাচ্ছি। কারণ, এঁদের অনেকের সঙ্গে আগে বেশ সখ্যতা ছিল। কেউ বড় ভাই হিসেবে শ্রদ্ধা করত, কেউ আঙ্কেল ডাকত। এদের অনেকে সবজি বিক্রেতা, অনেকে রাস্তার পাশে বসা দৈনন্দিন কাপড়-চোপড় বিক্রেতা, কেউ ফল বিক্রেতা, কেউ গ্রোসার, কেউ ডিম বিক্রেতা, কেউবা মুড়ি বিক্রেতা, ফুচকা বিক্রেতা এমনি নানান ধরনের মানুষ। তেমনি সুযোগ হয়েছে ঢাকার আশপাশের গ্রামের মানুষের সঙ্গে মেশার। আবার বাড়তি লাভও হয়েছে, মেঘলা দিনে গ্রামের সবুজ বিলে মেঘের শ্যামল রঙের ছায়া দেখা। মাথার ওপর মেঘলা আকাশ রেখে বুক ভরে শ্বাস নেয়া। আসলে দীর্ঘদিনের বন্দী জীবন থেকে একটি মুক্তির জীবন খুঁজছি, তাই মনকে আগেই মুক্ত করে দিয়েছি। হয়ত রবীন্দ্রনাথের মতো অতটা নিতে পারিনি যে, ‘সবলে কারেও ধরি নে বাসনামুঠিতে’। তার পরেও নিজের মুঠি আলগা করতে শিখছি। যদিও নিজের কথা তার পরেও বলি, হয়ত রবীন্দ্রনাথকে অতটা জীবনে ধারণ করতে পারিনি, লালনকে শতভাগ ধারণ করতে পারিনি। তবে তার পরেও শিখেছি, সংসারে থেকেও কিছুটা বাউল থাকতে হয়। সংসারের বাসনাগুলো যেন শতভাগ জড়িয়ে না ধরে। এতে হয়ত অর্থ মেলে না, অর্থের অভাব হয় জীবনে- তার পরেও সুখ মেলে। সুখী হওয়া যায়। যা হোক, যে বিষয় নিয়ে লিখতে বসেছিলাম সেখানে ফেরা যাক। হঠাৎ করে দু’-চারটা ভিন্ন কথা এসে গেল, যেমন করে হঠাৎ কোন কোন বনফুল ফুটে পড়ে রাস্তার ধারে। এ কথাগুলো তেমনি এসে গেল। ওই যে বলছিলাম, ঢাকার থেকে বের হয়ে গ্রামের পাশে গিয়ে বিলের ধারে দাঁড়িয়ে মেঘলা আকাশের নিচে শ্বাস নিয়েছি বুক ভরে। কিন্তু সেখানেও স্বাদ মেটেনি। অমন জায়গায় যে বিনা কাজে যাওয়া যায়, হয়ত সে কথা ভাবতে ভুলে গেছে এখনকার গ্রামের মানুষ। এখন হয়ত আর বিনা প্রয়োজনে রাস্তা বেয়ে কেউ হাঁটে না বা খোলা আকাশের নিচে কেউ দাঁড়ায় না। তাই ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ধীরে ধীরে পাশে মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। প্রথমে তাদের তীক্ষ্ম দৃষ্টি ফেলেছে আমার ওপর। তার পরে এক সময়ে সোজাসুজি জানতে চেয়েছে জমি খুঁজছি কিনা? তাদের বলে বোঝানোর কোন শক্তি আমার ছিল না, জমি কেনার ইচ্ছে আমার নেই বা সে ইচ্ছে নিয়ে আসিনি। এসেছি একটুখানি মুক্তির স্বাদ নিতে। যা হোক, সাংবাদিক মন। মানুষ পেলেও অন্য রকম একটা খুশি কাজ করে। মানুষের জীবনকাহন জানতে ইচ্ছে করে, জানতে ইচ্ছে করে ওই সব এলাকার নানান কথা। আশ্চর্য হইনি, বরং খুশি হলাম জেনে ওই সব মানুষ জানে, তার এলাকার আগামী বিশ বছরে উন্নয়নের কী কী পরিকল্পনা সরকার করেছে। কোথা থেকে, কোন্ পথে, কতদূর রাস্তা যাবে, কোথায় ব্রিজ হবে সব তাদের জানা। তারা জেনেছে তাদের প্রয়োজনে। কারণ, তাদের জমির দাম বাড়বে। আর সেই সব হিসাব-নিকাশ নিয়ে হচ্ছে জমি বেচা-কেনা। আবার তাদের ভেতর আশঙ্কা আছে, তারা তাদের জমি সবটুকু রক্ষা করতে পারবে কি-না? কারণ বড় বড় হাউজিং এলে দখল করে নেয় তাদের জমি-জায়গা। কেউ কেউ আবার নানান প্রতারণা ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। যেমন, তাদের মুখেই শোনা, এসব জায়গায় যত হাউজিং দেখা যায় এর আশিভাগ মূলত প্রতারণা। অর্থাৎ তারা কোন না কোন জমির মালিককে বছরে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়ে ভাড়ায় সাইন বোর্ড বসায়। শুধু একটা সাইন বোর্ড বসানোর জন্য ওই মালিক বছরে দশ হাজার টাকা পায়। এভাবে হয়ত দশটা সাইন বোর্ড তারা দশ জায়গায় বসায়। তারপরে সেটা দেখিয়ে ঢাকার মানুষের কাছে বা প্রবাসীদের কাছে প্লট বিক্রি করে। পরে এক সময় তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার অনেক সঠিক হাউজিংও আছে। তবে তারা প্লট বিক্রি করে প্রথমে কিস্তিতে। আর শুরুতে যাদের কাছ থেকে টাকা নেয় তাদের ভেতর যারা দুর্বল পার্টি তাদের আর জমি রেজিস্ট্রি করে দেয় না। নানান কথা বলে কিস্তিতে হয়ত কিছু টাকা ফেরত দেয়। কারণ, ততদিনে জমির দাম কয়েক শ’গুণ বেড়ে গেছে। তাই সেগুলো তারা এখন আবার নতুন কাস্টমারের কাছে বিক্রি করে। এমনি নানান ঘটনা, যার অনেক গল্প ও উপন্যাসেরও উপাদান। আবার এই শহরের কাঁচাবাজারের সবজি বিক্রেতা; তার যেমন এক ধরনের সমস্যা তেমনি বাজারের বাইরে রাস্তায় সকালে যে সবজি নিয়ে বসছে তার আরেক সমস্যা। বাজারের ভেতরের যে সবজি বিক্রেতা সে বলছে তার আগের মতো আর ক্রেতা আসে না। কারণ, এখন ক্রেতা তার হাতের কাছেই সবজি পাচ্ছে। রাস্তায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ বাজারে তার দোকানের ভাড়া বেড়ে গেছে। রাস্তার যে সবজি বিক্রেতা সেও সমস্যা মুক্ত নয়। কারণ, সে যে ফুটপাথে বা রাস্তায় বসতে পারছে এ জন্য সরকারী দলের স্থানীয় কর্মীদের চাঁদা দিতে হয় নিয়মিত। এমনিতে বাজারের থেকে তাকে কম দামে বিক্রি করতে হয়। তা ছাড়া স্থায়ী দোকান না হওয়ায়, সকাল দশটার আগে তাকে বিক্রি শেষ করতে গিয়ে শেষের দিকে বেশ সস্তায় বিক্রি করতে হয়। তার ওপরে সরকারী দলের স্থানীয় কর্মীদের চাঁদা সব মিলে তার লাভ থাকে খুবই কম। অন্যদিকে অন্য জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে প্রতিদিন। কষ্ট হচ্ছে তার জীবন চালাতে। আবার জীবন বদলে গেছে কোন কোন সবজি বিক্রেতার। বাজারের ভেতর একটি গ্রোসারি শপে কয়েক পদের সবজি নিয়ে এখন থেকে দশ বছর আগে ব্যবসা শুরু করেন এক সবজি বিক্রেতা। এখন ওই গ্রোসারি শপের মালিক সে। মালামালে পরিপূর্ণ তার দোকান। এমনকি মাল রাখার জন্য পাশে আরেকটি দোকানকে গুদাম হিসেবে ভাড়া নিয়েছে। তার দুই ছেলে আর একটি লোক রেখে সেই দোকান চালাচ্ছে। মেয়ে নার্সিং পড়ছে। আরও দুই ছেলে নসিমন, করিমন- এগুলো চালায় টঙ্গীর রাস্তায়। তার জীবনে এখন দিন বদলের গল্প, স্বপ্ন পূরণের গল্প। ফল বিক্রেতারাও বাদ যাচ্ছে না সরকারী দলের কর্মীদের চাঁদার হাত থেকে, বাদ যাচ্ছে না ফুচকা বিক্রেতারাও। তবে বিস্ময়কর তাদের পুরনো সখ্যতার মূল্য। দীর্ঘদিনের পরে তাদের কাছে ফিরে গিয়েও মিলছে তাদের সততার সাক্ষ্য। যেমন তারা থাই পেঁপে বিক্রি করছে ঠিকই তবে বলছে এটা রাঙ্গামাটির আর এটা কাপাসিয়ার। সত্যকে লুকাচ্ছে না। যেমন ফুচকাওয়ালার বয়স হয়ে গেছে। বয়স হয়েছে আমারও। তার পরেও চিনতে পেরে তিনি খুশি। তার খুশি দেখে বলি, আলু খাওয়া নিষেধ। আলু ছাড়া কি ফুচকা হবে? তিনি হেসে বলেন, আপনার কি খাওয়া উচিত হবে? তার কথা, কামরাঙ্গীরচরে যেখানে এগুলো তৈরি হচ্ছে সেগুলো খুবই নোংরা পরিবেশ। বাচ্চারা লোহা খেলেও হজম করে ফেলতে পারে। তার মতে তাই ওদের খাওয়ায় কোন দোষ নেই। আমাদের খাওয়া উচিত হবে না। মনে মনে ভাবি, হায়রে সময়! সময় কেবল বয়ে যায়। জীবন থেকে শুধু ফুচকার আলু চলে যায়নি। রাস্তার অস্বাস্থ্যকর খাবার হজম করার ক্ষমতাও চলে গেছে। অথচ এক সময়ে মজা করে বন্ধুবান্ধব মিলে রাস্তার পাশের ইটের খাবারের দোকানের (মজা করে বলতাম ইটালিয়ান রেস্টুরেন্ট) কালো মাংসের ভুনা খেয়েছি। হজম হয়ে গেছে। কোন অসুবিধা হয়নি। ফুচকাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করি, তাকে কোন চাঁদা দিতে হয় কি-না? তিনি হেসে বলেন, এটা তো এ দেশের নিয়ম। রাস্তায় বসে বিক্রি করতে হলে, যখন যারা সরকারী দলে থাকে তাদের লোকজনকে পয়সা দিতে হয়। যে পান-বিড়ি বিক্রি করে তাকেও পয়সা দিতে হয়। এ দেশের নিয়ম বলতে মনে পড়ে গেল ২০০৫ সালের দিকে গুলবাগের এক বৃদ্ধ ভদ্রলোকের কথা। তখন গুলবাগ, মালিবাগ বস্তির পাশের রাস্তায়, শাহজাহানপুর, খিলগাঁও প্রভৃতি জায়গায় বিকেল থেকে ওপেন ফেনসিডিল বিক্রি হতো। যারা বিক্রি করত তাদের সমীহ করে চলতে হতো। ওই সময়ে ওই বৃদ্ধ ভদ্রলোক একদিন বলেছিলেন- দেখ, সরকারের ঘনিষ্ঠ কয়েক পুলিশ অফিসার, কয়েক ওয়ার্ড কমিশনার আর জনাদুয়েক বড় নেতাকে ক্রসফায়ারে দিলে রাজধানীতে আর মাদক থাকত না। রাজধানীতে এখনও বহাল তবিয়তে মাদক আছে। ওই বৃদ্ধ ভদ্রলোক বেঁচে আছেন কি-না জানি না। তবে মাঝে মাঝে মনে হয়, মাদক বন্ধের পথ কি এটাই! যেমন নয়ন বন্ডকে ক্রস ফায়ারে দেয়ার পরে ফেসবুকে লেখা হচ্ছে- এটাই সঠিক পথ। [email protected]
×