ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

যে কারণে পিছু হটলেন ট্রাম্প

প্রকাশিত: ১২:৩২, ৩ জুলাই ২০১৯

যে কারণে পিছু হটলেন ট্রাম্প

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০ জুন ইরান আক্রমণের নির্দেশ দিয়ে ওই দিনই তিনি নির্দেশটি প্রত্যাহার করে নেন। পারস্য উপসাগরে একটি মার্কিন টহল ড্রোন ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ফেলে দেয়া কেন্দ্র দু’দেশের মধ্যে উত্তেজনা চরমে পৌঁছে। প্রায় যুদ্ধ লাগার মতো অবস্থা তৈরি হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ যাত্রা রক্ষা পায় তেহরান। ট্রাম্প কেন প্রথম আক্রমণের নির্দেশ দিয়ে পরে সেটি প্রত্যাহার করে নেন শুক্রবার একটি টুইটে এর কারণ তিনি ব্যাখ্যা দেন। তিনি লেখেন, ‘ইরান একটি মনুষ্যবিহীন ড্রোন ফেলে দিয়েছে। এর জবাবে বিমান হামলা চালালে প্রথম আঘাতেই ১৫০ জন নিহত হতো। বিষয়টি যথাযথ হতো না।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টনের মতো অবশ্য তেহরানের বিরুদ্ধে কিছু একটা করার পক্ষেই ছিল। সিনিয়র নিরাপত্তা বিশ্লেষক ফ্রেড ফ্লিৎজ মনে করেন, ট্রাম্প প্রকৃত প্রস্তাবে যুদ্ধ চান না। তিনি চান চাপে রেখে ইরানের প্রভাব খর্ব করতে। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ইরান বিষয়ক বিশেষজ্ঞ সুজান ম্যালোনি বলছেন, ‘এক্ষেত্রে ট্রাম্পের লক্ষ্য ছিল সর্বোচ্চ ক্ষতি এড়ানো। ইরানকে নিষেধাজ্ঞার নিষ্পেষণে রেখেই ট্রাম্প প্রশাসন কাক্সিক্ষত ফল পেতে আগ্রহী।’ ট্রাম্প যেমন একদিকে ইরাক যুদ্ধের বিরোধী ছিলেন তেমনি তিনি ইরানের সঙ্গে করা পরমাণু চুক্তিরও ঘোর বিরোধী। নির্বাচনের আগের থেকেই তিনি ইরানের সঙ্গে করা ছয়টি দেশের পরমাণু চুক্তির বিরোধিতা করেছেন। নির্বাচিত হওয়ার পর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ওই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে এনেছেন। তিনি ইরানের ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দেশটি অর্থনীতিকে প্রায় মন্দাবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছেন। বিবিসির বিশ্লেষক জোনাথন মার্কাস মনে করেন ট্রাম্প যদি আক্রমণের নির্দেশ থেকে সরে নাও আসতেন তাহলেও সর্বাত্মক যুদ্ধ হতো না। মার্কিন বাহিনীর আঘাত হতো সীমিত। হতে পারে সে হামলা চালানো হতো ইরানের কিছু রাডার বা ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনার ওপর। এরপর শুরু হতো কূটনৈতিক দৌড়-ঝাঁপ। শনিবার ট্রাম্প আবার বলেন যে, ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপের সুযোগ এখনও আছে। ওয়াশিংটনের নীতি-নির্ধারক মহলের একটি অংশ সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে হলের ইরানের শাসক গোষ্ঠীকে উৎখাতের পক্ষে। কারণ সামরিক এবং রাজনৈতিক দিক দিয়ে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য জটিল এক চ্যালেঞ্জ। বিষয়টি সাদ্দাম হোসেনের ইরাকের মতো নয়। পারস্য উপসাগরকে মূল ঘাঁটি করে ইরাকের ওপর হামলা চালিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। উপসাগরের ওপর ইরাকের নিয়ন্ত্রণ তেমন ছিল না। কিন্তু পুরো পারস্য উপসাগর এলাকা ইরানের নাগালের মধ্যেই রয়েছে। আক্রান্ত হলে ইরান অবশ্যই পাল্টা আঘাত হানবে। এতে মার্কিন জাহাজ বা বিমান আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এ ছাড়া ইরান উপসাগরে জাহাজ বা তেলবাহী ট্যাঙ্কারের চলাচল বিঘিœত করতে মাইন, ছোট নৌযান বা সাবমেরিন দিয়ে আক্রমণ চালাতে পারে। ইরান যে মার্কিন ড্রোন ভূপাতিত করেছে তা উচ্চ প্রযুক্তির এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল। শক্তিমত্তার পাশাপাশি এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতাও আছে। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে ইরান এ রকম আরেকটি মার্কিন ড্রোন ইলেকট্রনিক উপায়ে হ্যাক করে নিজের ভূখ-ে নামিয়েছিল। ইরান যদি কয়েকটা মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ডুবিয়ে দিতে পারে তখন ট্রাম্প প্রশাসনকে পশ্চাদ প্রসরণের কথা ভাবতে হতে পারে। বলাই বাহুল্য এ যুদ্ধ হবে অসম। একটি পক্ষ খুবই শক্তিশালী অন্য পক্ষ অপেক্ষাকৃত দুর্বল। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করতে পারে। অন্যদিকে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের যতটুকু ক্ষতি করবে তার পরিমাণ কম হলেও এর বিশাল রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক গুরুত্ব থাকবে। ইরান আমেরিকার জনমতকে যুদ্ধের বিরুদ্ধে ঘুরিয়ে দিতে পারে। ইসরাইলে হামলা করে যুদ্ধ বড় অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে দিতে পারে। উদ্দেশ্য হবে ওয়াশিংটনকে এটা দেখানো যে ইরানের বিরুদ্ধে ছোটখাটো আক্রমণও পুরো মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে দিতে পারে। আফগানিস্তান ও ইরাকের অভিজ্ঞতা থেকে যুক্তরাষ্ট্র এটি উপলব্ধি করতে পেরেছে যে বর্তমান যুগে কোন যুদ্ধে প্রচলিত অর্থে জয়ী হওয়া যায় না। ইরানও এটি ভাল করেই জানে যে যুক্তরাষ্ট্রকে পরাস্ত করার সাধ্য তাদের নেই। যুক্তরাষ্ট্র চায় বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইরানকে একটা সীমার মধ্যে ধরে রাখতে চায়। যার অন্যতম দিক দেশটির সামরিক ক্ষমতার রাশ টেনে ধরা। তবে এটি করতে গিয়ে ইরানের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর প্রতি জনসমর্থন বেড়ে যায় কি না সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হচ্ছে। ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ হলে তা হবে তার ফল কী হবে তা আগে থেকে বলা কঠিন। হতে পারে এতে ইরানের পরমাণু কর্মসূচীও বন্ধ হলো না অপরদিকে মধ্যপ্রাচ্যে দেশটির প্রভাব বেড়ে গেল। মধ্যপ্রাচ্যের অংশ বিশেষ এখন ইরানের প্রভাব বলয়ের মধ্যে আছে। বিশেষ করে ইরাক, সিরিয়া ও লেবাবন। গত মাসে হরমুজ প্রণালী দুটি তেলবাহী ট্যাঙ্কারে হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে ওয়াশিংটন তেহরানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেয়। চলতি সপ্তাহে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালানোর খবর প্রকাশের পর দু’দেশের সম্পর্কে এখন টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে। ট্রাম্প আক্রমণ চালানোর অবস্থান থেকে সরে এলেও দু’দেশের মধ্যকার উত্তেজনা তাই সহসা প্রশমিত হবে না বলেই ধারণা করা যায়।
×