ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বার্মিংহামে রোহিত ঝড়ের পর মুস্তাফিজ তাণ্ডব

প্রকাশিত: ১২:০২, ৩ জুলাই ২০১৯

বার্মিংহামে রোহিত ঝড়ের পর মুস্তাফিজ তাণ্ডব

মিথুন আশরাফ ॥ ‘ক্যাচ মিস, ম্যাচ মিস।’ এই কথার সত্যতা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে মিলেছিল। ডেভিড ওয়ার্নারের ক্যাচ ধরতে পারেননি সাব্বির রহমান রুম্মন। তাতে ওয়ার্নার দেড় শ’ রানের বেশি করেন। ব্যাটসম্যানদের শত চেষ্টার পরও তাই বাংলাদেশও হেরে যায়। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচেও একই কাজ হলো। ক্যাচ মিস হলো। এবার বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি করা রোহিত শর্মার ক্যাচ ধরতে পারলেন না তামিম ইকবাল। সেই রোহিত ১০৪ রান করলেন। ভারতও ৩১৪ রান করল। বার্মিংহ্যামের এজবাস্টনে বাংলাদেশের সামনে জিততে ৩১৫ রানের টার্গেট দাঁড় হয়। বড় টার্গেটের সামনে পড়ে বাংলাদেশ। টস ভাগ্য ভারতের কপালে জুটল। রোহিত ব্যাটিং ঝড় তুলতেন। কিন্তু এরপর সেই পথে আর কেউ এগিয়ে যেতে পারলেন না। বাংলাদেশ পেসার মুস্তাফিজুর রহমান এগিয়ে যেতে দেননি। তিনি একাই ১০ ওভারে ১ মেডেনসহ ৫৯ রান দিয়ে ৫ উইকেট শিকার করে নিলেন। বাংলাদেশের প্রথম পেসার হিসেবে বিশ্বকাপে ৫ উইকেট শিকার করেন। ভারত যে আকাশচুম্বী রান করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, শেষদিকে মুস্তাফিজই তা থামান। অসাধারণ বোলিং করেন। রোহিতের ব্যাটিং ঝড়ের পর মুস্তাফিজ বোলিং তা-ব দেখান। তখন রোহিত শর্মা মাত্র ৯ রানে। দল ১৮ রানে। খেলা পঞ্চম ওভারের চলছে। ওভারের চতুর্থ বলে মুস্তাফিজুর রহমানের করা শর্ট বলটি ছক্কা হাঁকাতে চান রোহিত। কিন্তু সঠিক টাইমিং হয়নি। তাতে ক্যাচ আউট হওয়ার সম্ভাবনা জোরালো হয়। তামিম ডিপ স্কয়ার লেগ দিয়ে একটু দৌড়ে বলটি নিজের তালুবন্দী করার মতো পরিস্থিতিও তৈরি করেন। বলটি তার বুক উচ্চতায়ও থাকে। কিন্তু মুঠোয় জমা করতে পারেননি। তামিমের মতো ফিল্ডার যিনি এরচেয়েও অনেক কঠিন ক্যাচ ধরেন। তিনি কিনা এমন সহজ ক্যাচটি হাতছাড়া করে ফেললেন! তাতে বাংলাদেশেরও বারোটা বেজে গেল। রোহিতের মতো ব্যাটসম্যানকে এমন সুযোগ দিলে কী আর রক্ষা আছে? রক্ষা পায়নি বাংলাদেশ। যে ভারত দলটি নিজেদের সর্বশেষ ম্যাচটিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এবার বিশ্বকাপে প্রথম পাওয়ার প্লেতে সবচেয়ে কম রান (২৮/১) করে, সেই দলটিই বিশ্বকাপে প্রথম পাওয়ার প্লেতে নিজেদের সর্বোচ্চ (৬৯/০) রান করে। ক্যাচ হওয়া থেকে মুক্তি পেয়ে যেন আরও বিধ্বংসী হয়ে ওঠেন ওপেনার রোহিত। তার সঙ্গে তাল দিয়ে যান ওপেনার লোকেশ রাহুল। দুইজন মিলে দলকে ১৮তম ওভারে গিয়ে ১০০ রানে নিয়ে যান। এর মধ্যে রোহিত ৪৫ বলে ৫০ রান করে ফেলেন। ১০০ রান হওয়ার কিছুক্ষণ পর রাহুলও ৫৭ বলে ৫০ রান করেন। দুইজনই দুর্বার গতিতে এগিয়ে যেতে থাকেন। মুহূর্তেই ২৩ ওভার যেতেই ১৫০ রানও হয়ে যায়। রাহুল একদিকে বুঝে এগিয়ে যেতে থাকেন। আরেকদিকে রোহিত ব্যাটিং ঝড় তুলতে থাকেন। ৯০ বলে ৬ চার ও ৫ ছক্কায় সেঞ্চুরি করেন রোহিত। বিশ্বকাপে টানা দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি করেন। বিশ্বকাপের এক আসরে শ্রীলঙ্কার সাবেক ব্যাটসম্যান কুমার সাঙ্গাকারার পর ভারতের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে চার সেঞ্চুরি করে ফেলেন রোহিত। বিশ্বকাপের এক আসরে এর আগে সৌরভ গাঙ্গুলীই শুধু ভারত ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তিন সেঞ্চুরি করতে পারেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচেই রোহিত তা স্পর্শ করেন। এবার সবাইকে ছাপিয়ে যান রোহিত। সৌরভ গাঙ্গুলী, শচীন টেন্ডুলকর যা করতে পারেননি, টানা দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি করে দেখিয়েছেন রোহিত। যেন ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচটির স্মৃতিই সামনে চলে আসে। সেই ম্যাচে বিতর্কিত ‘নো’ বলের সুবাদে সেঞ্চুরি পান রোহিত। এবার তামিমের ক্যাচ ফেলার সুবাদে সেঞ্চুরি পান। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে প্রথমবার বিশ্বমঞ্চে খেলতে নেমে একটি সেঞ্চুরিই পেয়েছিলেন। এবার চারটি সেঞ্চুরি পাওয়াতে বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ব্যাটসম্যান রিকি পন্টিং ও সাঙ্গাকারার পর ৫টি সেঞ্চুরি হয়ে গেল রোহিতের। বিশ্বকাপে সেঞ্চুরি করার দিক দিয়ে রোহিতের সামনে আছেন শুধু শচীন টেন্ডুলকর। তিনি ৬টি সেঞ্চুরি করে এক নম্বরে আছেন। রোহিত আরেকটি সেঞ্চুরি করলেই টেন্ডুলকরকেও ছুঁয়ে ফেলবেন। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়েই চার সেঞ্চুরির যাত্রা শুরু করেছিলেন সাঙ্গাকারা। টানা চারটি সেঞ্চুরি করে বিশ্বকাপের এক আসরে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে চার সেঞ্চুরির মাইলফলক অর্জন করে দেখান সাঙ্গাকারা। বাংলাদেশের বিপক্ষে সেঞ্চুরি দিয়ে বিশ্বকাপের এক আসরে প্রথম ভারতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে চার সেঞ্চুরির মাইলফলক স্পর্শ করলেন রোহিতও। এরপর আর খুব বেশিদূর এগিয়ে যেতে পারেননি। সৌম্য সরকার ‘ব্রেক থ্রু’ এনে দেন। অবশেষে স্বস্তি খুঁজে পায় বাংলাদেশ। সৌম্য সরকারের বলে লিটন কুমার দাসের হাতে ধরা পড়ে সাজঘরে ফেরেন রোহিত (৯২ বলে ৭ চার ও ৫ ছক্কায় ১০৪)। কিন্তু ততক্ষণে ভারত ৩০তম ওভারেই ১৮০ রান করে ফেলে। রাহুলের সঙ্গে রোহিতের এই জুটি আবার বিশ্বকাপের এক আসরে ভারতের সর্বোচ্চ রানের উদ্বোধনী জুটি হয়ে যায়। রান যে পাহাড়সম হবে তখনই বোঝা যায়। যে রোহিত ৯ রানে ফিরতে পারতেন। সেই তিনিই ১০৪ রান করে আউট হন। ৯৫টি রান বেশি করেন রোহিত। একটা সময়তো মনে হচ্ছিল ৪০০ রান অনায়াসেই হবে। সৌম্য তাতে ব্যাঘাত ঘটান। বাংলাদেশকে প্রাণ ফিরিয়ে দেন। রোহিতের আউটের পর ভারতের রানের চাকা দুর্বল হয়ে পড়ে। যখন আর ১৫ রান স্কোরবোর্ডে যোগ হতে রাহুলকেও (৯২ বলে ৭৭ রান) সাজঘরে ফেরান রুবেল, তখন একটু চাপেও পড়ে ভারত। তবে ৩৪তম ওভারে গিয়ে ২০০ রান স্কোরবোর্ডে যোগ হয়ে যায়। বিরাট কোহলি উইকেটে থাকেন। ঋষভ পন্থও এগিয়ে যেতে থাকেন। দুইজন মিলে রানের গতি যখনই বাড়াতে চান ঠিক তখনই আবার মুস্তাফিজ গর্জে ওঠেন। কোহলিকে (২৬) আউট করে দেন। ভারতকে চাপে ফেলে দেয় বাংলাদেশ। ৩৯তম ওভারের দ্বিতীয় বলে কোহলিকে ফেরানোর পর চতুর্থ বলে স্লোয়ার দিয়ে হার্দিক পা-িয়াকেও সাজঘরে ফেরান মুস্তাফিজ। ম্যাচেও ফেরে বাংলাদেশ। যেখানে ১৮০ রান পর্যন্ত কোন উইকেট পড়েনি। সেখানে এই অবস্থা থেকে ২৩৭ রান পর্যন্ত ৫৭ রানে ৪টি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট হারায় ভারত। দিশেহারাও হয়ে পড়ে। মুস্তাফিজ কি দুর্দান্ত বোলিং করলেন। কিন্তু পরের ওভারেই সাইফউদ্দিনের তিন বলে তিনটি চার হাঁকান পন্থ। তাতে ভারত যেন একটু আশ্বাসও পায়। ২৫০ রানেও চলে যায় ভারত। রোহিতের ক্যাচ মিসেতো ডুবেছেই বাংলাদেশ। আবার একের পর এক ফিল্ডিং মিসও ভারতকে সুবিধা এনে দিয়েছে। তবে ভারতের ২৭৭ রানের সময় পন্থকে (৪১ বলে ৪৮ রান) আউট করে দেন সাকিব। মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত ক্যাচ মিস করতে থেকে দ্বিতীয় সুযোগে ধরেন। তাতে করে শেষ ওভারে বোলিং করতে এসে উইকেট শিকার করেন সাকিব। সময়মতোই কাজের কাজটি করেন। কিন্তু সেই ধারাবাহিকতাতো বাকি বোলারদের মাঝেও থাকতে হবে। মুস্তাফিজ সেই ধারাবাহিকতা দেখান। মহেন্দ্র সিং ধোনি ও দীনেশ কার্তিক মিলে টুকটুক করে রান তুলতে থাকেন আবার সুযোগ বুঝে বাউন্ডারিও হাঁকাতে থাকেন। তখন কার্তিককে (৮) আটকে দেন মুস্তাফিজ। ৪৮তম ওভারে গিয়ে ৩০০ রানও করে ভারত। শেষ ওভারে ধোনিকেও (৩৩ বলে ৩৫ রান) আউট করে দেন মুস্তাফিজ। একই ওভারের শেষ বলে জাসপ্রিত বুমরাকেও বোল্ড করে দিয়ে ৫ উইকেট শিকার করেন মুস্তাফিজ। ক্যারিয়ারের প্রথম ওয়ানডেতে ৫ উইকেট শিকার করে ২০১৫ সালে ভারতকে ডুবিয়েছিলেন মুস্তাফিজ। এবার বিশ্বকাপে প্রথমবার খেলতে নেমে প্রথমবার ভারতকে সামনে পেয়ে গর্জে ওঠেন মুস্তাফিজ। বোলিং তা-ব দেখান। প্রথমবার বিশ্বকাপে খেলতে নেমেই ৭ ম্যাচে ১৫ উইকেট নেন। বিশ্বকাপে এক আসরে বাংলাদেশের হয়ে যা সর্বোচ্চ উইকেট শিকার। শেষ ১০ ওভারে ভারতকে চাপে রাখে বাংলাদেশ বোলাররা। তাতে করে শেষ ১০ ওভারে ৬৩ রানের বেশি করতে পারেনি ভারত। ৩১৪ রানের বেশি করতে পারেনি। বাংলাদেশের সামনে জিততে টার্গেট দাঁড় হয় ৩১৫ রান।
×