ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অবৈধ বালু উত্তোলনে হুমকিতে গারো পাহাড়

প্রকাশিত: ০৯:৪১, ২ জুলাই ২০১৯

অবৈধ বালু উত্তোলনে হুমকিতে গারো পাহাড়

নিজস্ব সংবাদদাতা, শেরপুর, ২ জুলাই ॥ শেরপুর সীমান্তের গারো পাহাড়ের বালুমহাল বহির্ভূত বিভিন্ন এলাকায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। সীমান্তের শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলায় পাহাড়ি বিভিন্ন ঝোরা-ছড়া, খাল ও নদীর অন্তত ১০ স্থানে শ্যালো মেশিন বসিয়ে দিনরাত অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল। প্রতিদিন ট্রাক, ট্রলি ভর্তি করে ওই বালু দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করতে পাহাড় ও বনের গাছ কেটে তৈরি করতে হচ্ছে বালু পরিবহনের রাস্তা। এতে একদিকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বনাঞ্চল ও হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ছে ব্রিজ-কালভার্টসহ পরিবেশ। অন্যদিকে তুলনামূলক কম মূল্যে অবৈধভাবে উত্তোলিত বালু সরবরাহ হওয়ায় লোকসানের মুখে পড়ছে বালুমহালের বৈধ ইজারাদাররা। জানা যায়, গারো পাহাড়ের সোমেশ্বরী, মহারশি, ভোগাই, চেল্লাখালী নদীসহ বিভিন্ন নদী ও ঝোরায় প্রকাশ্যে তোলা হচ্ছে বালু। সরেজমিনে দেখা যায়, শ্রীবরদী উপজেলার কর্ণঝোরা, বাবলাকোনা, তাওয়াকুচা, ঝিনাইগাতী উপজেলার ছোটগজনী, রামেরকুড়া, বাকাকুড়া, ফুলহারী, ছোটগজনী, গান্ধিগাওসহ অন্তত ১০ স্পটে অবৈধভাবে ওই বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এভাবে দিনের পর দিন অবৈধভাবে বালু উত্তোলন অব্যাহত থাকায় নদীর তীরবর্তী এলাকার বসতি ও আবাদি জমি ভাঙ্গনের কবলে পড়ে বিলীন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। একই সঙ্গে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ও গ্রামীণ সড়ক হুমকির মুখে পড়েছে। এছাড়া উপজেলার সন্ধ্যাকুড়ায় মহারশি নদীর সেতু, বাকাকুড়া ব্রিজসহ বেশ কিছু ব্রিজ-কালভার্ট ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এদিকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন এবং ইরিবোরো মৌসুমে নদীর উজানে বাঁধ দেয়ায় বালু উত্তোলন করতে না পেরে লোকসানের মুখে পড়েছে গারো পাহাড়ের বালুমহালের বৈধ ইজারাদারগণ। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে কম দামে বিক্রি করছে অবৈধ বালু ব্যবসায়ীরা। আর বালুমহাল ইজারা নিয়ে সরকারকে ইজারার টাকা দিয়ে বেশি দামে বালু বিক্রি করতে হচ্ছে বালুমহাল ইজারাদারদের। এতে করে ক্রেতারা তাদের বালু নিতে চাচ্ছে না। ফলে অনেক বালু অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে। অপরদিকে ইরিবোরো মৌসুমে নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে পানি আটকানোর কারণে বালু ওঠাতে পারেননি ইজারাদাররা। এতে তারা লোকসানের মুখে পড়েছেন। গত বছর ঝিনাইগাতীর সোমেশ্বরী নদীর তাওয়াকুচা এলাকায় ৬.৫১ একর আয়তনের বালুমহাল ১ কোটি ২০ লাখ টাকা দিয়ে ইজারা নেয় সওদ বিল্ডার্স নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তারা মাত্র ৬০ লাখ টাকার বালু বিক্রি করতে পেরেছিল। বাকি ৬০ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে ওই প্রতিষ্ঠানকে। এবারও ঝিনাইগাতী উপজেলার মহারশি নদীর ফাখরাবাদ বালুমহাল ৩৮ লাখ ৬০ হাজার টাকায় ইজারা নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে এবারও তারা লোকসানের মুখে পড়ার আশঙ্কা করছে। বালুমহালটি ইতোপূর্বে ছামিউল ফকির নামে এক ব্যক্তি মাত্র ১ লাখ ৮৩ হাজার টাকায় লিজ নিয়ে উচ্চ আদালতে একটি রিটের দোহাই দিয়ে ১৪ বছর যাবত বালু উত্তোলন করে আসায় সরকার অন্তত ৫ থেকে ৭ কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে। সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে লেখালেখি হলে ছামিউল ফকিরের বিরুদ্ধে আদালতে একটি মামলা হয় এবং জেলহাজতেও যেতে হয় তাকে। ওই প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন রিট নিষ্পত্তির ভিত্তিতে সওদ বিল্ডার্সকে ৩৮ লাখ ৬০ টাকায় ইজারা দিলে সওদ বিল্ডার্সের মালিক আসাদুজ্জামান স্বপন হাইকোর্টে ছামিউল ফকিরের রিটের নিষ্পত্তি চাইলে শুনানি অন্তে তা নিষ্পত্তি হয়। এরপর বালুমহালটি নতুন ইজারাদারের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়। বালু মহালের ইজারাদার আসাদুজ্জামান স্বপন বলেন, গতবছর তাওয়াকুচা বালুমহালটি ১ কোটি ২০ লাখ টাকায় ইজারা নেয়ার পর বছরের ইরিবোরো মৌসুমে প্রায় ৪ মাস নদীতে বাঁধের কারণে বালু উত্তোলন ও পরিবহন বন্ধ থাকায় প্রায় ৬০ লাখ টাকা লোকসান দিতে হয়েছে। এ জন্য জেলা রাজস্ব বিভাগে আবেদন করেও প্রতিকার না পেয়ে মহামান্য হাইকোর্টে রিট করেছি, যা শুনানির অপেক্ষায় আছে। আর দীর্ঘ প্রায় ১৪ বছর একটি মহলের কব্জা থেকে উদ্ধার করে এবার মহারশি নদীর ফাখরাবাদ বালুমহাল ইজারা নিয়েছি। কিন্তু তারই রেশ ধরে স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় থাকা একটি সিন্ডিকেট যেভাবে যত্রতত্র অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে, তা অচিরেই বন্ধ না হলে আমাদের এবারও লোকসান গুনতে হবে। এতে করে ভবিষ্যতে কেউ বালুমহাল ইজারা নিতে আসবে না। অবৈধ বালু উত্তোলনের বিষয়ে বন বিভাগের রাংটিয়া রেঞ্জের ভারপ্রাপ্ত রেঞ্জ কর্মকর্তা ইলিছুর রহমান বলেন, রাতের আঁধারে অবৈধভাবে বালু ওঠায় বেশ কিছু লোক। আমাদের লোকবলের অভাবে তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারছি না। ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুবেল মাহমুদ জানান, আমরা অবৈধ বালু উত্তোলনের খবর পেলেই তা বন্ধ করে দিচ্ছি। এখন যদি কেউ করে তা বন্ধ করে দেব। এ ব্যাপারে শেরপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এবিএম এহছানুল মামুন জানান, আমরা অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করতে দেব না। এ বিষয়ে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।
×