ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাতিল জনমত যাচাই বিধি

প্রকাশিত: ০৮:৫৩, ২ জুলাই ২০১৯

বাতিল জনমত যাচাই বিধি

চলমান জাতীয় সংসদে অর্থবিল-২০১৯ পাসের মাধ্যমে দীর্ঘদিন পর হলেও বাতিল হয়ে গেল তথাকথিত জনমত যাচাইয়ে গণভোটের বিধান। উল্লেখ্য, জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে অবৈধভাবে ক্ষমতা গ্রহণকে বৈধ করার জন্য প্রণীত হয় তথাকথিত জনমত যাচাইয়ের নামে গণভোটের বিধান। ১৯৭২ নালের সংবিধানে এটি আদৌ ছিল না। থাকার কথাও নয়। কেননা, গণতন্ত্র তথা সংসদীয় শাসন পদ্ধতিতে গণভোট কখনও জনমত যাচাইয়ের পথ ও পন্থা হতে পারে না। এই বিধান বাতিলের বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে উচ্চ আদালতেরও। স্মর্তব্য যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পর মেজর জিয়া নিজে শাসনভার গ্রহণের নিমিত্ত বিচারপতি সায়েমকে সরিয়ে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণার জন্য অদ্যাদেশ জারির মাধ্যমে চালু করেন এই বিধান। মূলত সামরিক শাসকরা নিজেদের রাষ্ট্রপতি তথা একচ্ছত্র ক্ষমতা কুক্ষিগত করার অভিপ্রায়ে হ্যাঁ-না ভোটের প্রচলনের নিমিত্ত চালু করেন গণভোটের বিধান। এতে একদিকে যেমন শত শত কোটি টাকার অপচয় হয়, তেমনি তথাকথিত নির্বাচনের নামে শুরু হয় চূড়ান্ত প্রহসন। উল্লেখ্য, জিয়া পরবর্তী সামরিক একনায়ক প্রেসিডেন্ট এরশাদও এই ধারা অক্ষুণ্ণ রাখেন ক্ষমতা কুক্ষিগত করার অভিপ্রায়ে। দীর্ঘদিন পর হলেও একটি নির্বাচিত জাতীয় সংসদের সর্বসম্মত অভিপ্রায়ে শেষ পর্যন্ত বাতিল হলো তথাকথিত জনমত যাচাইয়ের নামে গণধিকৃত গণভোটের বিধানটি। এর ফলে দেশ এবং জাতি অতীতের দায় ও কলঙ্ক মোচনের পথে আরও এক ধাপ অগ্রসর হলো বৈকি। এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক যে, জিয়াউর রহমান সংবিধানে শুধু হ্যাঁ-না ভোটের বিধান যুক্ত করেই ক্ষান্ত হননি, প্রকৃতপক্ষে তিনি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রণীত গণতান্ত্রিক সংবিধানের চরিত্রই সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছিলেন। সংবিধানের মূল স্তম্ভ বাঙালী জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে চালু করেছিলেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিসর্জন দিয়ে চালু করেছিলেন রাষ্ট্রধর্ম। সমাজতন্ত্রকে বর্জন করে প্রচলন করেছিলেন তথাকথিত সামাজিক ন্যায়বিচার, যা প্রকারান্তরে প্রকট করে তোলে সামাজিক বৈষম্যকে। ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’-এর অপরাজনীতি ও অপসংস্কৃতি, যা প্রকারান্তরে ঘুষ ও দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, তা মূলত শুরু হয় জিয়ার শাসনামলেই। তদুপরি সংবিধানে ইনডেমনিটি বিল সংযুক্ত করে তিনি সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করেছিলেন। যার জের জাতিকে বহন করতে হয় দীর্ঘদিন। এর পাশাপাশি পাকিস্তানী জেনারেল তথা স্বৈশাসকদের সন্তুষ্টি লাভের জন্য একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধী মানবতাবিরোধীদের বিচার প্রক্রিয়াও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে মুক্ত করে দিয়েছিলেন একাত্তরের যুদ্ধবন্ধী রাজাকার-আলবদর-আলশামসসহ খুনী, ধর্ষক ও লুটেরাদের। পরবর্তীতে ক্যান্টনমেন্টে বসে তথাকথিত রাজনৈতিক দল বিএনপি গঠন করে স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসনসহ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়া এবং পদ-পদবি দিয়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা ওড়ানোর পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিলেন, যা বাস্তবায়ন করেন তারই সহধর্মিণী খালেদা জিয়া। উল্লেখ্য, বর্তমানে খালেদা জিয়া ঘুষ-দুর্নীতি, এতিমের টাকা আত্মসাতজনিত কারণে একাধিক মামলায় দেশে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে দন্ডিত হয়ে দিনযাপন করছেন কারান্তরালে। এক শ্রেণীর তথাকথিত ভুঁইফোঁড় রাজনীতিবিদ, যে বা যারা জিয়াউর রহমানকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক বলেন, তাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে হ্যাঁ-না ভোটের প্রবর্তন আদৌ গণতন্ত্র নয়। বরং এটি একচ্ছত্র ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ষড়যন্ত্র, যা ইতিহাসে ধিকৃত ও পরিত্যক্ত। বিলম্বে হলেও সেটি বাতিল করে দেশ ও জাতি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধী হত্যাকান্ডের বিচারের মতো জাতীয় কলঙ্ক মুক্তির পথে অগ্রসর হলো আরও এক ধাপ।
×