ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

লড়াকু মাশরাফিকে দেখে উজ্জীবিত সতীর্থরা

স্বপ্নের কাছে বাধা নয় ইনজুরির ব্যথা!

প্রকাশিত: ১১:৩২, ১ জুলাই ২০১৯

 স্বপ্নের কাছে বাধা নয় ইনজুরির ব্যথা!

মোঃ মামুন রশীদ ॥ স্বপ্নটা অনেক বড়। ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার আগে সেই স্বপ্নের কথা জানিয়েছিলেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। বাংলাদেশ দলকে নিয়ে সেমিফাইনাল খেলার আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। সেই আশাটা এখন পর্যন্ত বেঁচে আছে। সে কারণেই শারীরিক সমস্যা, ব্যথাগুলোকে পাত্তাই দিচ্ছেন না মাশরাফি। হামাগুড়ি দিয়ে হলেও স্বপ্নটাকে ছুঁতে চাইছেন। গত ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৭ ওভার বোলিং করেছেন খাটো রানআপ নিয়ে। তার আগে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও শেষদিকে ছোট রানআপে বোলিং করেছেন এবং ফিল্ডিংয়ের সময় একটি বল ঠেকাতে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর কিছুটা হামাগুড়ি দিয়ে তবেই উঠে দাঁড়াতে পেরেছেন। কারণ স্বপ্নটাকে ছুঁতে হবে। সেই স্বপ্নের কাছে এই ব্যথা, এই ইনজুরি কিছুই নয়। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই ইনজুরির সঙ্গে, ব্যথার সঙ্গে লড়াই করে এখন পর্যন্ত টিকে গেছেন মাশরাফি। আর তাই অধিনায়ককে দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন সতীর্থরাও। অন্যরাও ইনজুরিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দেশের জন্য, দলের জন্য সর্বোচ্চ সামর্থ্য প্রয়োগ করে যাচ্ছেন নির্বিকারে। সে জন্য দলগত নৈপুণ্যে এখন পর্যন্ত চলতি বিশ্বকাপে অন্যতম আলোচিত একটি দল বাংলাদেশ। বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফির চলতি বিশ্বকাপে বলার মতো কোন পারফর্মেন্সই নেই। এরপরও অধিনায়ক হিসেবে সবগুলো ম্যাচেই তিনি দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার নেতৃত্বে দলও দারুণভাবে এগিয়ে চলেছে। বিশেষ করে টাইগারদের শুরুটা হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ক্রিকেট পরাশক্তিকে পরাভূত করে। সেটি আবার ঘোষণা দিয়েই করেছিলেন মাশরাফি। কোন প্রতিপক্ষকেই ছোট করে দেখার মনোভাব কোন সময় না থাকলেও অন্যদের খুব বেশি সমীহ করে আগেভাগে নিজেদের দুর্বল ভাবার কোন মানসিকতাই দেখাননি তিনি। তবে বিশ্বকাপের আগেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক ফাফ ডু প্লেসিসকে। অধিনায়কদের আড্ডা আয়োজনে টাইগার অধিনায়ক মাশরাফি বলেছিলেন, ‘আমাদের যেহেতু দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ, তাই আমরা ফাফ ডু প্লেসিসদের হারিয়েই ভালভাবে শুরু করতে চাই।’ কিন্তু কথাটি শুনে দৃঢ়তার সঙ্গেই প্রোটিয়া অধিনায়ক প্লেসিস বলেছিলেন ,‘সে সুযোগ তোমরা পাবে না!’ বাস্তবে প্লেসিস ভুল প্রমাণিত হয়েছেন আর মাশরাফি সঠিক। দারুণ জয় পেয়েছে বাংলাদেশ দল। সেই জয়ের পর আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও আফগানিস্তানকে হারিয়ে সেমির যে স্বপ্ন নিয়ে এবার বিশ্বকাপে এসেছিলেন মাশরাফি তা টিকিয়ে রেখেছেন। এমনকি দারুণ ফর্মে থাকা শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও দল দুর্দান্ত খেলেছে, নিউজিল্যান্ডকে কম রান নিয়েও সহজে জিততে দেয়নি। দলগতভাবে এতটা দুর্বার টাইগারদের নেতা মাশরাফি কিন্তু নিজে কিছুই করতে পারেননি। এখন পর্যন্ত ৬ ম্যাচে মাত্র ১টি উইকেট নিতে পেরেছেন। তাই অনেকেই মাশরাফির সমালোচনায় হয়েছেন সোচ্চার। তবে মাশরাফি ঠিকই দলকে অনুপ্রাণিত রেখেছেন, আত্মবিশ্বাসী রেখেছেন। বাস্তবে তার যে শারীরিক পরিস্থিতি তা জানলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। মাশরাফির বাঁ হ্যামস্ট্রিংয়ে ইনজুরিটা বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডের ত্রিদেশীয় সিরিজে হয়েছিল। স্ক্যান করাতেও রাজি হননি। কারণ স্ক্যান করালে যে রিপোর্ট পাওয়া যাবে সেখান থেকে হতোদ্যম হয়ে পড়তে পারেন এবং খেলার সুযোগটা না-ও পেতে পারেন। তবে গ্রেড ২ টিয়ার আছে এমনটাই আশঙ্কা বাংলাদেশের ফিজিও থিহান চন্দ্রমোহনের। আক্রান্ত স্থানটি ফুলে লালচে হয়ে গেছে, নরম তুলতুলে জায়গায় আঙ্গুল দিলেও ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। এমন অবস্থা নিয়েও মাশরাফি এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের সবগুলো ম্যাচেই খেলেছেন। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বিশ্বকাপ ইতিহাসে ম্যাচে সর্বাধিক রানের রেকর্ডের দিনে তিনি ফিল্ডিংয়ের সময় হামাগুড়ি দিয়েছেন। বল ঠেকাতে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর উঠে দাঁড়াতে করতে হয়েছে কসরত। প্রতিনিয়ত মাশরাফির শতভাগ প্রচেষ্টা আর দলের জন্য নিবেদনটা সতীর্থদের মানসিক শক্তি ও দৃঢ়তাকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে। প্রচ- ব্যথা নিয়েও তার এ সংগ্রাম অবশ্যই যে কোন দলের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। এই বিষয়টিই মাশরাফিকে সতীর্থদের কাছে ‘গ্রেট’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই মাশরাফির ব্যথা সহ্য করার যে ক্ষমতা সেটি সাহসী করেছে বাকিদের। বিশ্বকাপে প্রোটিয়াদের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচের মাত্র দু’দিন আগে বাঁ হাতে আঘাত পেয়েছিলেন তামিম ইকবাল। তাকে নিয়ে শঙ্কা থাকলেও তামিম নিজেই ওই ব্যথাটাকে পাত্তা দেননি এবং ঠিকই খেলেছেন। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ দীর্ঘদিন ধরেই কাঁধের ইনজুরি নিয়ে ভুগছেন। এখন আবার ডান হাঁটুতে দেখা দিয়েছে গ্রেড ১ পর্যায়ের টিয়ার। ক্রাচে ভর দিয়েও হাঁটতে দেখা গেছে তাকে। কিন্তু আফগানদের বিপক্ষে ম্যাচটির পর ৭ দিনের বিরতি, তাই রিয়াদ এই ইনজুরিটাকে পাত্তা দিচ্ছেন না। অন্যতম ব্যাটিং স্তম্ভ মুশফিকুর রহীমকে পাঁজরের ইনজুরি নিয়েও গত বছর এশিয়া কাপের পুরোটাই খেলতে দেখা গেছে। তামিম এক হাতে ব্যাটিং করে বিশ্বব্যাপীই বিস্ময়ের ঝড় তুলেছিলেন! এখনও মুশফিকের পাঁজরটা পুরোপুরি স্বচ্ছন্দে ফেরেনি। টন্টনের নেটে ব্যাটিংয়ের সময় আঙ্গুলে আঘাত পেয়েছিলেন, মেহেদী হাসান মিরাজ মাথায় বলের আঘাত পেয়েছিলেন। কিন্তু তারা টাইগারদের একাদশে অপরিহার্য, তাই একটা ম্যাচেও একাদশের বাইরে থাকেননি তারা কেউ। ইনজুরি বয়ে নিয়ে খেলে যাওয়াটা হয়তো তাদের ক্যারিয়ারের জন্যই হুমকি হতে পারে। কিন্তু মাশরাফির মনোভাব সবাইকে একটি উপলব্ধি এনে দিয়েছে যে সবকিছুকেই তারা পাত্তা না দিয়ে দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হয়ে উঠেছেন। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান এবার বিশ্বকাপে আছেন ফর্মের তুঙ্গে। ৬ ম্যাচে ৪৭৬ রান করে তালিকায় তৃতীয় সেরা ব্যাটসম্যান সাকিব বল হাতেও নিয়েছেন ১০ উইকেট। কিন্তু তিনিও সম্প্রতি পিঠের ইনজুরি থেকে সেরে উঠেছেন। বিশ্বকাপের মাঝেও উরুর ইনজুরি সমস্যায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচটি খেলা হতো না তার। এর আগেও আঙ্গুলের ভয়াবহ ইনজুরি নিয়ে খেলা চালিয়ে যাওয়ায় ক্যারিয়ারটাই হুমকির মুখে পড়তে বসেছিল। কিন্তু সবকিছু পেছনে ফেলে দলের জন্য অবদান রেখে চলেছেন। অনেক আগেই হাঁটুতে ৭টি বড় ধরনের অস্ত্রোপচার এবং একটি কৃত্রিম কাফ নিয়ে খেলা চালিয়ে যাচ্ছেন মাশরাফি। অথচ অস্ট্রেলীয় শৈল্যবিদ ডেভিড ইয়াং জানিয়েছিলেন, আর ক্রিকেট না খেলাটাই ঠিক হবে তারজন্য। এই বিশ্বকাপে দারুণ বোলিং করছেন তরুণ পেস অলরাউন্ডার মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। তিনিও পিঠের দীর্ঘ ইনজুরি নিয়ে ব্যথানাশক দিয়ে খেলতে খেলতে শেষ পর্যন্ত একটি ম্যাচে নামতে পারেননি। কিন্তু স্বপ্ন পূরণের আশা থেমে থাকেনি। এগিয়ে চলেছেন টাইগাররা। এ বিষয়ে একজন ক্রিকেটার বলেছেন, ‘আমরা বিশ্বকাপের জন্য ৪ বছর অপেক্ষা করেছি। তাই সবাই এই অভিযানে নিজেকে যুক্ত রাখতে মরিয়া। এই পর্যায়ে এসে এখন তো আর কেউ হাল ছাড়তেও নারাজ। যদি এটা অন্য কোন সিরিজ হতো আমাদের অনেকেই বিশ্রামে যেত ইনজুরি থেকে সেরে ওঠার জন্য। কিন্তু এখানে সবাই উপলব্ধি করছে যে আমাদের এগিয়ে যেতেই হবে। সবাই পরস্পর সম্পর্কে জানে যে অন্যজন ইনজুরি বয়ে বেড়াচ্ছে, কিন্তু কেউ সেটা নিয়ে কথা পর্যন্ত বলছে না।’ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) একজন কর্মকর্তাও এই ক্রিকেটারদের নিয়ে বলেছেন, ‘কেউ তাদের ইনজুরি নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করছে না। তারা শুধু যা প্রয়োজন সেটিই করে যাচ্ছে। এটা বিশ্বকাপ এবং সে জন্যই সব ম্যাচ সামর্থ্যরে সবটুকু দিয়ে খেলতে সচেষ্ট সবাই। ইনজুরিগুলো হয়তো তাদের ক্যারিয়ারই শেষ করে দিতে পারে, কিন্তু সে সবকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। মাশরাফি, রিয়াদ, তামিম ও মুশফিককে দেখবেন তারা শরীরের কোথাও না কোথাও টেপ পেঁচিয়ে, ব্যান্ডেজ বেঁধে নেমেছে, ওষুধ সেবন করে নেমেছে কিংবা ব্যথানাশক ইঞ্জেকশন গ্রহণ করেছে।’
×