ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাঁশ উদ্ভিদের মর্যাদা না পেলেও ঘাস পরিচয়েই ছড়ি ঘোরাচ্ছে বিশ্বে

প্রকাশিত: ১০:৩১, ১ জুলাই ২০১৯

 বাঁশ উদ্ভিদের মর্যাদা না পেলেও ঘাস পরিচয়েই ছড়ি ঘোরাচ্ছে বিশ্বে

সমুদ্র হক ॥ ‘বাঁশ’ শব্দ দিয়ে যতই গালি দেয়া হোক বাঁশ জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। বাঁশ আজও গাছের (উদ্ভিদ) মর্যাদা পায়নি। বাঁশ এক ধরনের ঘাস। বাঁশ ঘাসের পরিচিতি নিয়েই বিশ্বে মোড়লদের ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে। বাঁশকে বলা হয় গরিবের কাঠ। নিশুতি রাতে মোহন বাঁশির সুর মানবহৃদয়ে স্বর্গীয় অনভূতি এনে দেয়। পৌরণিক উপাখ্যানে আছে: নীপবনে কৃষ্ণের বাঁশির সুর রাধাকে ঘর থেকে বের করে আনত। ছড়া গান ‘বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ঐ মাগো আমার শোলক বলার কাজলা দিদি কই’.. কিংবদন্তি হয়ে ওঠা। সেই বাঁশ বাগানের মাথার ওপর এখন চাঁদ দেখা যায় কালেভদ্রে। বাঁশ বাগান উজাড় করে নির্মিত হচ্ছে অবকাঠামো। অতীতে গাঁও-গেরামে বাঁশঝাড় ছিল কোন বাড়ির পরিচিতির সূচক। যেমন- ওই বাঁশঝাড়ের কাছে তার বাড়ি। ছেলেবেলায় বাঁশঝাড় নিয়ে নানি দাদিদের কাছে কত যে মজার গল্প শোনা যেত: কোন গল্প ভীতিকর, কোনটি প্রীতিকর। বাঁশ বাগানের বা বাঁশ ঝাড়ের আরেক পরিচিতি বাঁশের আড়া। গায়ের লোকজন আজও বাঁশের আড়া বলে। রাতে বাঁশঝাড়ের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় গা ছম ছম করে উঠত। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে বাঁশের ঠোকাঠুকিতে এক ধরনের ধ্বনি হয় তখন নানি-দাদিদের ভীতিকর গল্পের ভূত মনে ভয় ধরায়-গা দব দব করে ওঠে। বাড়ি ফেরার পর ওই গল্পগুজবের শাখা প্রশাখার বিস্তার ঘটতে থাকে: কে যে কত ভাবে গল্প বানায়! মন্দ গালি দিতে বাঁশের কোন জুড়ি নেই। ইংরেজি শব্দ ব্যাম্বো। জীবনের সব অধ্যায়ে বাঁশ মানুষের বন্ধু হয়ে আসে। বলা হয় জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বাঁশের প্রয়োজন। দুর্যোগ মোকাবেলা, ভূমিক্ষয় রোধ, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বড় ভূমিকা রাখে বাঁশ। বাঁশ অন্যান্য গাছগাছালির চেয়ে বেশি বেশি অক্সিজেন উৎপাদন করে আর বেশি মাত্রায় কার্বনডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে। নব্বইয়ের দশকে কুড়িগ্রামের উলিপুরে বাঁশে তৈরি পাইপে পায়ে চালিত (ট্রেডল) সেচ নলকূপ উদ্ভাবিত হয়। বাঁশের ভেতরের গিঁটগুলো ফেলে নলকূপের পাইপ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। গ্রামের লোকজন ছোট খাল পার হতে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁশ দিয়ে সেতু বানায়। বাড়ির বহিঃআঙ্গিনায় খুলি মাচা, বন্যার সময় আশ্রয়ের জন্য বাঁশ লাগে। অবকাঠামো নির্মাণ, পাকা বাড়ির ছাদ ঢালাইয়ের আগে সাটারিংয়ে, নির্মাণের পর বাইরে প্লাস্টার ও রং করতে বাঁশ লাগবেই। গ্রামে কাঁচাঘর নির্মাণ, তোরণ, প্যান্ডেল তৈরি, কোন কিছু ঠেকান দিতে, ঘরের খুঁটি, বেড়া, চাঁটাই, ঘর গেরস্থালি কুলো, ডালা, ঝুড়িসহ, কুটিরশিল্প সামগ্রী বানাতে বাঁশ দরকার হয়ই। বাঁশে তৈরি হস্তশিল্প পরিবেশবান্ধব, যা বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। বর্তমানে রফতানি হচ্ছে। বাঁশের ম- থেকে বস্ত্র শিল্পের তুলা ও সুতা তৈরি হচ্ছে। কাগজকলের ম- তৈরির কাঁচামাল বাঁশ। দেশের বেদে সম্প্রদায় ও বিদেশে প্রাকৃতিক চিকিৎসায় ‘ব্যাম্বো ম্যাসাজ’ থেরাপি সেন্টার গড়ে উঠছে। হালে বিভিন্ন ধরনের ভেষজ ওষুধেও ব্যবহৃত হচ্ছে বাঁশ। খাদ্য হিসেবেও বাঁশ এগিয়ে এসেছে। পুষ্টি বিজ্ঞানীরা বলছেন, কচি বাঁশের নরম কান্ড (বাঁশ কড়াল) খাদ্যগুণ ও মুখরোচক স্বাদের জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় খাদ্যতালিকায় সবজি হিসেবে বড় আসন করে নিয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলে লোকজনের কাছে বর্ষা মৌসুমের স্বাদের খাবার বাঁশের কান্ড। হাতি ও বিভিন্ন প্রজাতির পান্ডা ও কয়েকটি স্তন্যপায়ী প্রাণীর প্রিয় খাবার বাঁশ পাতা। দুধের মধ্যে বাঁশপাতা রাখলে অনেকক্ষণ টাটকা থাকে। বিশ্ব এগিয়ে যাওয়ার পালায় বর্তমানে বড় ভূমিকা রাখছে বাঁশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (GdGI) এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাঁশের প্রজাতি ও বৈচিত্র্যের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে অষ্টম। প্রথম স্থানে চীন। বাংলাদেশে বাঁশের প্রজাতি ৩৩। তবে কারও কারও মতে ২৭। দেশী বাঁশের মধ্যে, মুলি, তল্লা, বরাক, ভুদুম, বেথুয়া, বাইজ্জা, লতা, ফারুয়া, করজবা, মাকলা ইত্যাদি। কোন কোন বাঁশের কান্ড পুরু, কোনটির লতানো, কোনটি ঘন আচ্ছাদন। তল্লা মাকলা ভুদুম বাঁশের কান্ড পুরু ও কাষ্ঠল হওয়ায় নলকূপের পাইপ, গ্রামীণ সাঁকো, ইমারত তৈরিতে ছাদ দেয়ার আগে ব্যবহৃত হয়। দেশে বছরে শুকনো বাঁশের চাহিদা অন্তত ১০ লাখ টন। বর্তমানে বাঁশ বাগান উজাড় হতে চলেছে। অপরিকল্পিত চাষাবাদ হওয়ায় গ্রাম ও বনাঞ্চল থেকে খুব বেশি বাঁশ মিলছে না। বঁশা প্রজাতিকে রক্ষা এবং বৈচিত্র্য সংরক্ষণে চট্টগ্রামের ষোলশহরে ’৭৩ সালে বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) সিলভি কালচার জেনিটিক্স বিভাগের অধীনে ‘বাঁশ উদ্যান’ গড়ে তোলা হয়। সেখানে দেশী বাঁশের পাশাপশি বিদেশ থেকে আনা কয়েকটি জাতের রেপ্লিকা হয়েছে। ’১০ সালে চীনের বাঁশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশের মুলি বাঁশ সংরক্ষণ করে ওদের একটি প্রজাতি দেয়। ’৮ সালে চট্টগ্রামের ওই কেন্দ্র মধুপুর অঞ্চলে ১০ হাজার বাঁশের চারা দিয়েছে। বিএফআরআই ৩৩ জাতের বাঁশ সংরক্ষণ করেছে। জলবায়ুসহিষ্ণু ছয়টি নতুন জাতের বাঁশ উদ্ভাবন করেছে তারা। এর মধ্যে দুটি জাতের বাঁশের কান্ড সবজি হিসেবে খাওয়া যাবে। জলবায়ুসহিষ্ণু দেশের আবহাওয়া উপযোগী আরও নতুন কয়েকটি জাত শীঘ্রই উন্মুক্ত করা হবে, যা পাহাড় ধস, ভূমিক্ষয়, নদী ভাঙন রোধে ভূমিকা রাখবে। হারিয়ে যাওয়া বাঁশের বীজের একটি জার্মপ্লাজম সংরক্ষণাগার নির্মিত হয়েছে। বিএফআরআইর বাঁশ উদ্যানে টিস্যু কালচারেও চারা তৈরি হচ্ছে। বাঁশ দ্রুত বর্ধণশীল। ২০ থেকে ৫০ ফুট লম্বা বাঁশের সংখ্যা বেশি। চারা রোপণের পর ৫ বছরেই পূর্ণাঙ্গ বাগানে পরিণত হয়। বাঁশের বৃদ্ধি হয় দুইভাবেÑ এক. বীজ, দুই. অঙ্গজ। ঝাড়ের বাঁশে ২৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ফুল ধরে। এ সময় অনেক বীজ মাটিতে পড়ে। সেখান থেকে চারা গজায়। প্রাকৃতিক নিয়মেই বাঁশের গোড়া বা মাথা থেকে চারা বের হয়ে ঝাড়বৃষ্টি হয়, একে বলা হয় অঙ্গজ বাঁশ তৈরি। এই পদ্ধতিতে বাঁশঝাড় বেড়ে ওঠে। লোকজন বলে মোথা পদ্ধতি। সব প্রজাতির বাঁশে শুরুতে কঞ্চি গজানো শুরু হয়। প্রতিটি বাঁশেই থাকে অনেকগুলো গিট। বাঁশ ব্যবহারের আগে ওপরের গিটে ছেঁটে ফেলতে হয়। না হলে বাঁশ অঝারা রয়ে যায়। বাঁশ, অঝারা বাঁশ বলে যত গালি দেয়াই হোক বাঁশের তাতে কিছুই যায় আসে না। বাঁশের কঞ্চি যত চিকনই হোক এর আঘাত কম নয়। বাঁশ উদ্ভিদের পরিচয় পাক আর নাই পাক এই বাঁশ দিয়ে কি না হেনস্তা করা হয়। তখন অপর পক্ষ খুশি হয়ে বলে: যাক বাঁশ ভালই দিয়েছি।
×