ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বৃষ্টি ভেজা সাদা ফুল পাতার বাহার, চোখ ফেরানো যায় না

প্রকাশিত: ১০:২৭, ১ জুলাই ২০১৯

বৃষ্টি ভেজা সাদা ফুল পাতার বাহার, চোখ   ফেরানো যায় না

মোরসালিন মিজান ॥ শুধু বৃষ্টি দিয়ে বর্ষা চেনা যায় না, এমন নয়। গাছের দিকে তাকান। ফুলের দিকে তাকান। কিছু গাছ কিছু ফুল আপনাকে ঠিক মনে করিয়ে দেবে- বর্ষা এসেছে। চালতা তেমনই একটি ফুল। খুব চেনা। ভীষণ প্রিয়। বর্ষায় ফুটে। এবারও আষাঢ়ের প্রথমভাগে ফুলটি দৃশ্যমান হয়েছে। একসময় অধিকাংশ গ্রামে গাছটি দেখা যেত। বাড়ির পেছনে জঙ্গলের মতো জায়গায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা চালতা গাছ এখন স্মৃতি। বেশ দুর্লভ হয়ে গেছে। তবে একটু কৌতূহলী হলে গাছটি এখনও দেখা যায়। এমনকি রাজধানী শহর ঢাকায় আছে। অল্পস্বল্প। তাতে কী? বৃক্ষশোভিত উদ্যানের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় একটু থামুন। চোখ মেলে তাকান। কী যে সুন্দর এই ফুল! দেখে মুগ্ধ হয়ে যাবেন। বিশেষ করে বৃষ্টির জলে ধোয়া ফুল দারুণ স্নিগ্ধ একটা অনুভূতি দেয়। জীবনানন্দ দাশ তাই লিখেছেন: আমি চ’লে যাব ব’লে/চালতা ফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে...। কবির অবর্তমানে বৃষ্টির ফোটায়, শিশিরের জলে ভিজে চলেছে চালতা ফুল। এমন অপরূপ দৃশ্য দেখতে না পারার বেদনা ফুটে ওঠেছে তার কবিতায়। গত কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে ঢাকায়। রবিবারের কথাই ধরা যাক, দুপুরের দিকে আকাশ খুব কাঁদলো। এর কিছু পর সার্কিট হাউস রোড দিয়ে আসার সময় চোখ আপনি চলে গেল চালতা গাছটার দিকে। পিআইবি ভবনের সীমনা প্রাচীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা এই গাছ আগেও বহুবার দেখা হয়েছে। এর পরও নতুনের মতো মনে হয়। গাছের লম্বা সবুজ পাতা। খাজকাটা আউটলাইন। করাতের দাঁতের মতো দেখতে। ভয়ঙ্কর নয় মোটেও। মনে হয়, কেউ কাঁচি দিয়ে কেটে চমৎকার নক্সা করে দিয়েছে। পাতার শিরা উঁচু। সমান্তরাল। ঘন পাতার আড়ালে চোখ জোড়ানো সৌন্দর্য নিয়ে ফুটে আছে চালতা ফুল। ফুলটিকে চারদিক থেকে ঘিরে আছে মাংসল বৃতি। বৃতির গায়ে তখনও বৃষ্টির ফোটা গড়াগড়ি খাচ্ছিল। অসংখ্য পরাগকেশর এই ফুলকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও আছে চালতা গাছ। জাতীয় জাদুঘরের পেছনের অংশে আছে কয়েকটি। নগরীর উদ্যানগুলোতে আছে। গত কয়েকদিন এসব এলাকা ঘুরে মনে হয়েছে, ফুল প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আগামী কিছুদিনের মধ্যেই সব ফুল ফলে পরিণত হবে। এ পর্যায়ে কিছু তথ্য জেনে নেয়া যাক, চালতার আদি নিবাস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। শ্রীলঙ্কা, চীন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বেশ কিছু দেশে হয়। বিশেষত এটি ভারতবর্র্র্র্ষীয় উদ্ভিদ হিসেবে পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম ডিলেনিয়া ইন্ডিকা। ইন্ডিকা শব্দটি ইন্ডিয়া থেকে নেয়া। আর ডিলেনিয়া নামটি নেয়া হয়েছে অক্সফোর্ডের বিখ্যাত তরুবিদ জে. জে. ডিলেনিয়াসের নাম থেকে। চালতার ইংরেজী নাম এলিফ্যান্ট আপেল। বাংলাদেশে চালতাকে চালিতা চাইলতে ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়। গাছটি আপনি বেঁচে থাকে। বড় হয়। গাছে পাকা ফল বেশি দিন থাকলে তা এক সময় ঝরে পড়ে। সেই বীজ থেকে গাছের নিচে আরও গাছ জন্ম নেয়। উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মার বর্ণনা থেকে জানা যায়, মধ্যমাকৃতি চিরহরিৎ বৃক্ষ চালতা। গাছের উচ্চতা ১৫ মিটার পর্যন্ত হয়। শাখা-প্রশাখা এলোমেল। বাকল লালচে মসৃণ। গাছের আয়ু মোটামুটি ২৫ থেকে ৩০ বছর। পাতা ৮ থেকে ১৪ ইঞ্চি দীর্ঘ হয়। বছরের মে থেকে জুন মাসের মধ্যে ফুল ফোটে। ফুলের ব্যাস হয় ১৫ থেকে ১৮ সেন্টিমিটার। বৃতির সবুজ, দলের শুভ্রতা, পরাগের হলুদ ও তারকাবৃতি গর্ভমু-Ñ সব মিলিয়ে চালতা ফুলের গড়ন অত্যন্ত আকর্ষণীয়। চালতা ফুলের বৃতিই এক সময় ফলে রূপান্তরিত হয়। টক স্বাদের ফল গ্রামীণ নারীরা ভীষণ পছন্দ করেন। লবণে মেখে নিয়ে গল্প করতে করতে খান। শরত ও হেমন্ত ফল পাকার সময়। শীতকাল পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। চালতা ফল হয় টক মিষ্টি। আচার, চাটনি, টক ডাল রান্নায় ব্যবহৃত হয়। পাকা ফল পিষে নিয়ে লবণ কাঁচামরিচ দিয়ে মেখে খাওয়া যায়। চালতার শাঁশ নানা খাদ্যে ব্যবহার করা হয়। জেলি ও শরবত তৈরির হয় চালতা ফল থেকে। গাছটি থেকে শক্ত কাঠ হয়। নৌকা তৈরিতে ব্যবহার করা হয় এ কাঠ। ব্যবহৃত হয় বন্দুকের বাঁট তৈরিতেও। তবে বাঙালী ফুলেই বেশি মুগ্ধ। সেই মুগ্ধতার কথা জানিয়ে কবি বিষ্ণু দে লিখেছিলেন: আকাশ নীলের তারাখচা পথে বৃষ্টি পড়ে/চালতা ফুলে ফলের বাগান মদির করে...।
×