ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

বিচ্ছিন্নতার পথে বাংলাদেশ ॥ ১ জুলাই, ১৯৭১

প্রকাশিত: ১০:১৯, ১ জুলাই ২০১৯

বিচ্ছিন্নতার পথে বাংলাদেশ ॥ ১ জুলাই, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ১ জুলাই দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। এই দিন চট্টগ্রামে ক্যাপ্টেন শামসুল হুদার নেতৃত্বে এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা পাকবাহিনীর দেবীপুর অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। উভয়পক্ষের সংঘর্ষে পাকবাহিনীর ১২ জন সৈন্য নিহত হয় ও ৫ জন আহত হয়। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান শহীদ হন। হাবিলদার গিয়াসের নেতৃত্বে এক প্লাটুন যোদ্ধা মিয়া বাজার থেকে ফুলতলীতে টহলরত অবস্থায় কুমিল্লার দক্ষিণে পাকবাহিনীর ১টি জিপ ও দুটি ট্রাক বোঝাই সৈন্যদের এ্যামবুশ করে খুব কাছ থেকে আক্রমণ চালায়। এতে ৩ জন পাক অফিসারসহ ২১ জন সৈন্য নিহত হয়। কাকডাকা ভোরে পাক বাহিনী ও রাজাকাররা শৈলকুপা থানার বসন্তপুর, জয়ন্তিনগর ও ছোট বোয়ালিয়া গ্রাম ঘিরে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালায়। কাউকে না পেয়ে নারী ধর্ষণ শুরু করে। পরে তারা লোকজন ধরে এনে ব্রাশ ফায়ার করে। এতে ১৯ জন শহীদ হন। আহত হন আরও ২০-২৫ জন। বাংলাদেশে সরকারের অনুমতিক্রমে কাদেরিয়া বাহিনী জনগণের দৈনন্দিন জীবনের দুঃখ-দুর্দশা মোচনের জন্য সামগ্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করেন। এই বাহিনীর একটি সিকিউরিটি বা ইনটেলিজেন্স বিভাগ এবং সঙ্গে সঙ্গে কাউন্টার ইনটেলিজেন্স ব্যবস্থা চালু ছিল। বাহিনীর লোকজন সম্পর্কে খবরাখবর সংগ্রহ করে রিপোর্ট করা ছিল এদের কাজ। মুক্তিযোদ্ধাদের গতিবিধি ছিল কাঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। কাদেরিয়া বাহিনীর সিগন্যাল বা কুরিয়ার সার্ভিসের ব্যবস্থা ছিল অদ্ভুত। সর্বক্ষণ বিভিন্ন এলাকায় রুটিনমাফিক সিগন্যালম্যানের কাছে দ্রুত দৌড়ে গিয়ে খবর পৌঁছে দিত। সে পৌঁছে দিত পরের পয়েন্টে। এমনি করে পৌঁছানো হতো খবর এবং তা সব সময়ই (বিশেষ করে যা জরুরী গোপন আশু নির্দেশ) থাকত লিখিত। বিভিন্ন পয়েন্টের সিগন্যালম্যানের নাম তাতে স্বাক্ষরিত থাকত। কাদের সিদ্দিকীর ভাষায়, ‘এভাবে ১০ মাইল দূরবর্তী কোন স্থানে খবর পাঠাতে তাদের সময় লাগত বড়জোর ২৫ মিনিট।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পাকিস্তানে অস্ত্র বিক্রির প্রতিবাদে বাংলাদেশের কয়েক হাজার শরণার্থী কলকাতার মার্কিন দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। জেনেভায় জাতিসংঘের উদ্বাস্তু কমিশনার অফিস থেকে ঘোষণা করা হয়: বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের জন্য জাতিসংঘ, বিভিন্ন সরকার ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এ পর্যন্ত ভারতে নগদ অর্থ ও সামগ্রী বাবদ ১৬ কোটি ডলার সাহায্য দিয়েছে। কংগ্রেস সদস্য কর্নেলিয়াস গ্যালাঘার মার্কিন প্রতিনিধি সভায় পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ রাখার উদ্দেশ্যে বিধিনিষেধ জারির জন্য প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী লন্ডনে টাইমস পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে বলেন, ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নয়া পরিকল্পনা পূর্ববঙ্গের পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলবে। ঢাকায় সামরিক সরকার ঘোষণা করে, চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত এমপিএ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে শক্তিশালী পাকিস্তানের জন্য কাজ করার অঙ্গীকার ঘোষণা করেছেন। পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য না করার জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব উ’থান্ট, উদ্বাস্তু কমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান ও অন্যান্য বন্ধু সরকারের প্রতি ভারতের ওপর তাদের প্রভাব বিস্তার করার আহ্বান জানান। জাতিসংঘের উদ্বাস্তু সংক্রান্ত হাই কমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে ভারতের বাধা প্রদান সংক্রান্ত পাকিস্তানের অভিযোগ খন্ডন করে বলেন, স্বদেশ প্রত্যাবর্তনেচ্ছু শরণার্থীদের বাধাদানের পেছনে ভারতের কোন স্বার্থ রয়েছে এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর সাধারণ সম্পাদক এ. খালেক এক বিবৃতিতে পাকিস্তান-বিরোধী দুষ্কৃতকারীদের দুষ্কর্ম প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসার জন্য দেশের নাগরিকদের আহ্বান জানান। খুলনা জেলা শান্তি কমিটির আহ্বায়ক মওলানা এ. কে. এম ইউসুফ এক বিবৃতিতে পাকিস্তান রক্ষার জন্য প্রশংসনীয় উদ্যোগ নেয়ায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও গবর্নর টিক্কা খানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। আফ্রো-এশীয় সংস্থার বৈঠকে ভারত ‘বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান’ ও ‘পাকবাহিনীর বর্বরতার নিন্দা করার জন্য’ প্রস্তাব তুলেন। বিবিসির সংবাদে বলা হয়েছে, আজ সকালের প্রেস পূর্ব পাকিস্তানের দু’জন রিপোর্টারের রিপোর্ট ছাপিয়েছে। টাইমসের মাইকেল হর্ন্সবি পাকসেনাদের দ্বারা হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের কথা লিখেছেন। তিনি ঢাকার ৪০ মাইল উত্তর পশ্চিমে সিন্দুর গ্রামে যান। এটি অন্যতম হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। তিনি জানান, গত ৫ দিনে এখানে লুটতরাজ চলেছে। গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ডেইলি টেলিগ্রাফ এ ক্লেয়ার হলিংওর্থ ঢাকা থেকে রিপোর্ট করেছেন। তিনি অসম সীমান্তের চার শ’ গজের মধ্যে পাকিস্তানী সেনা সীমান্ত চৌকি পর্যন্ত ছিলেন। তিনি দেখেছেন গেরিলারা ভারতীয় বর্ডার অঞ্চল থেকে পূর্ব পাকিস্তানে কিছু ধ্বংসাত্মক কাজ করেছেন। তারা সেখানে ৫০০০ পাকিস্তানী উদ্বাস্তুকে আটক করেছেন। তিনি বলেছেন পাকসেনারা মনে করেন ভারতীয় বাহিনী তাদের দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে চায়। গেরিলারা চা বাগান ধ্বংস করে দিচ্ছে। প্রায় ১২-১৩টা বাগান তারা মর্টার দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। তিনি জানান, প্রতিদিন অনেক চা বাগান কর্মী ঢাকায় চলে যাচ্ছেন কারণ এখানকার পরিস্থিতি খুব বিপজ্জনক। কলকাতা থেকে ডেইলি টেলিগ্রাফ সংবাদদাতা পিটার গিল রিপোর্ট করেন যে জনাব টবি জেসেল, যিনি বর্তমানে ব্রিটিশ সরকারের স্পন্সরে পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশ পরিদর্শন করছেন- যিনি এখানে আসা চারজন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যদের একজন- তিনি গত রাতে বলেন যে তিনি বিশ্বাস করেছেন যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হিন্দু গ্রামে আক্রমণ পরিচালনা করেছে। মুক্তাঞ্চল থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র: স্বদেশ এর ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যায় ’বিচ্ছিন্নতার পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামে এক নিবন্ধে বলা হয়, চূড়ান্ত হতাশা বাঙালীদের আজ বিচ্ছিন্নতার পথে পরিচালিত করেছে অধিকাংশ লোক তাতে বিচলিত হয়ে পড়েছেন। পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসাররা স্বীকার করেন যে, পশ্চিমাঞ্চলে পাঁচ কোটি মানুষের তুলনায় পূর্বাঞ্চলের সাত কোটি জনসাধারণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিতান্ত সামান্যই হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানীরা দীর্ঘ বার বছর সামরিক একনায়কত্বের পর গত বছরের শেষভাগে দেশের প্রথম স্বাধীন সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের পুঞ্জীভূত রোষের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অগ্নিপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত আওয়ামী লীগ আশ্চর্যজনকভাবে শতকরা ৯৮ ভাগ ভোট লাভ করেন। মুজিব তার ছয় দফা কর্মসূচীর জোরেই নির্বাচনে জয়লাভ করেন। এই ছয় দফা কর্মসূচী মূলত পাকিস্তান রাষ্ট্রকে একটি শিথিল কনফেডারেশনে পরিণত করবে। এতে প্রদেশগুলোকে সত্যিকারের স্বায়ত্তশাসন দিয়ে কেন্দ্রের জন্য নিতান্ত সামান্য ক্ষমতাই অবশিষ্ট রাখা হয়েছে। কেন্দ্রের হাতে শুধু বৈদেশিক নীতি এবং জাতীয় প্রতিরক্ষার বিষয় ছাড়া আর কিছুই দেয়া হয়নি। আর নতুন জাতীয় পরিষদে নিশ্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে মুজিব তথা পূর্ব পাকিস্তান তাদের রাষ্ট্রের ইতিহাসে, সর্বপ্রথম মুক্তির পথ করে নেয়ার মতো রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করেছে। এই সমস্ত ঘটনা পশ্চিম পাকিস্তানে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এখানে উল্লেখ্য যে, গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে প্রভাবশালী বামপন্থী নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে পাকিস্তান পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে শীর্ষস্থান অধিকার করেছেন। কিন্তু তিনি আওয়ামী লীগের হাতে সংসদীয় পরাজয় মেনে নিতে রাজি হলেন না। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছে ১৬৭টি ও পাকিস্তান পিপলস পার্টি পেয়েছে ৮২টি আসন। জুলফিকার আলী ভুট্টো কেবল যে সংসদীয় পরাজয় পরাজয় মেনে নিতে রাজি হলেন না তা নয় তার দলের পরিষদ সদস্যদের বলে দিলেন কেউ যেন জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করে। অবশেষে ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন বাতিল করে এক সপ্তাহের মধ্যে পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদদের একটি সম্মেলন আহ্বান করেছেন। এই সম্মেলনই হয়তো অচলাবস্থার নিরসন ঘটানোর একটি শেষ ও দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা। কিন্তু ইয়াহিয়ার এই আমন্ত্রণ শেখ মুজিব প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং সপ্তাহ শেষের ঘটনাবলী দেখে মনে হয় তিনি অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। এই ঘটনার পর ইয়াহিয়া এক ঘোষণা মারফত মার্চ মাসের শেষের দিকে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন উদ্বোধনের ব্যাপারে তার মতামত দেশবাসীকে জানিয়ে দিলেন এবং সেই সঙ্গে এক হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বললেন যে, ‘পাকিস্তানের সংহতি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য সেনাবাহিনী এগিয়ে আসতে পারে। দেশকে রাজনৈতিক ভরাডুবির হাত থেকে রক্ষার জন্য ইয়াহিয়ার চেষ্টা সত্ত্বেও পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন যে, অবস্থা এখন পাকিস্তানী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আয়ত্তের বাইরে। হয়তো সীমাবদ্ধ অনুভূতিই ভবিষ্যত ঘটনাবলী নিয়ন্ত্রিত করবে। নিউজউইকের ঢাকায় অবস্থানরত লোরেন জেন কিনসকে পাশ্চাত্যের জনৈক কূটনীতিক বলেছেন, ‘পাকিস্তানের দুই অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে কি পড়বে না এটা এমন কোন প্রশ্ন নয়। এখন প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে স্বাধীনতা কবে হবে। কি আগামী সপ্তাহে, না কি আগামী মাসে অথবা এর জন্য আরও বছরখানেক কি বছর দুয়েক সময় লাগবে। দুর্ভাগ্যবশত মনে হয় পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান খুব তাড়াতাড়িই বিচ্ছিন্ন হবে; খুব বেশি দেরি হবে না।’ ক্যালিফোর্নিয়া থেকে প্রকাশিত পশ্চিম তীর নিউজ বুলেটিনের এক সম্পাদকীয় ও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবশেষে আমেরিকার হাত বাঙালীদের রক্তে রঞ্জিত হলো। দুঃখের বিষয় এই যে আমেরিকার মতো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র স্বাধীনতার ধারণাকে চূর্ণ করে পাকিস্তানী স্বৈরশাসকদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, যাদের কার্যকলাপ বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে যে কারণ দেখিয়ে আমেরিকা যুদ্ধ লড়ছে তার বিপরীত। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×