ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাসের দায় ও মুক্তির গান

প্রকাশিত: ১০:১৯, ১ জুলাই ২০১৯

 ইতিহাসের দায় ও মুক্তির গান

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা আমাদের অস্তিত্ব। বাঙালী জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। স্বাধীনতা- এই একটি শব্দ জাতির শেকড়ের সন্ধান মেলায়, ঠিক করে দেয় চলার মসৃণ পথ। বাংলাদেশের ইতিহাস স্মরণ করতে গেলে হাজার বছরের স্বাধীনতার সংগ্রামের বিভিন্ন খন্ডিত ইতিহাস আমাদের কাছে স্মরণযোগ্য। বাঙালী জাতি জন্ম থেকেই কোন না কোন শাসক দ্বারা শোষিত হয়েছে, বিসর্জন দিতে হয়েছে তার সর্বস্ব। কখনও মোঘল-পাঠান-পর্তুগীজ, কখনও ব্রিটিশ এবং সবশেষ পাকিস্তানীদের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হয়েছে তাদের। মুক্তিযুদ্ধ উত্তর বাঙালীর ইতিহাস ছিল শুধুই শোষণ আর বঞ্চনার ইতিহাস, না পাওয়ার আর বেদনার ইতিহাস। কিন্তু প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন ঘটে ১৯৭১ সালের মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে আমাদের বিজয় অর্জিত হলেও এই মুক্তির লড়াইয়ের শুরু বহু আগে। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের পরেই এসেছে আমাদের কাক্সিক্ষত বিজয়। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পাকিস্তানীদের শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম, নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধ, ৩০ লাখ শহীদের বুকের তাজা রক্ত, লাখ লাখ মা-বোনের ওপর নির্মম নির্যাতন ও তাঁদের সীমাহীন আত্মত্যাগের বিনিময়ে ৯ মাস যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। আর এই পুরো সময়টিতে অগ্রভাগে নেতৃত্ব দিয়ে বাংলার স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করেছেন বাঙালীর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু এই সাফল্যমন্ডিত ইতিহাস আমরা কতটুকু জানি বা পরবর্তী প্রজন্ম এই ইতিহাস কিভাবে জানে। নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, শুনেছে গল্পের আকারে অথবা বই পড়ে। সেই শোনা বা পড়া কতটুকু সঠিক বা তার বিস্তৃতি কতটুকু, তা আমরা জানি না। তাই বেড়ে ওঠা এই তরুণ প্রজন্ম যদি ভুল ইতিহাস শিক্ষা নেয় সেই দায় একা তার না বরং আমাদের সবার। ভুল শিক্ষা নিলে ধরে নিতে হবে আমরা নতুন প্রজন্মর সামনে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারছি না। ইতিহাস বিকৃতির বাজারে তরুণদের সহজেই বিভ্রান্ত করে যাচ্ছে একদল কিন্তু আমরা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে আমাদের চেতনার জায়গা কতটুকু শাণিত করতে পেরেছি! আমাদের নতুন প্রজন্মর কাছে বিজয় দিবস বা দেশপ্রেমের ব্যাপারটি আনুষ্ঠানিকতায় যেন সীমাবদ্ধ না থাকে সে ব্যাপারে সবার সচেতন থাকা জরুরী। বিজয়ের মাস এলেই টিভির কোনায় বাংলাদেশের পতাকা বা বিজয়ের চিহ্ন দেয়া এবং পত্রিকাগুলো বিশেষ লেখা প্রকাশ করার মাধ্যমে যদি আমরা নিজেদের স্বাধীনতার মহান সংগ্রামকে আবদ্ধ করে ফেলি তবে সেটা শেখা বা জানার জায়গাকে সঙ্কুচিত করে ফেলবে। নিশ্চয়ই বিশেষ দিনগুলোতে অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে, স্মরণ করা হবে শ্রেষ্ঠ সন্তানদের কিন্তু তার কার্যপরিধির বিস্তার ঘটাতে হবে ব্যাপক আকারে, সারা বছর ধরে। তবেই তা আগামী প্রজন্মর শেখার ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা রাখবে। স্বাধীনতা বা বিজয় দিবস এলেই স্কুলে নানা ধরনের কর্মকান্ড হয়। শোকের দিনে ওরা বুকে কালো ব্যাজ ও মাথায় পতাকা বেঁধে আসে। এই শ্রদ্ধা ও সম্মানের জায়গা তখনই স্বার্থক হবে যদি এই শিশু-কিশোররা প্রকৃত অর্থেই মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ সম্পর্কে জানে। মুক্তিযুদ্ধ যেন বর্তমান প্রজন্মর প্রাত্যহিক জীবনের একটি অংশ হয় সে চিন্তার জায়গা থেকেই ‘মুক্তির গান’ নামক সংগঠনের যাত্রা। আমার রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়েছে, তš§ধ্যে শিক্ষার্থীদের মাঝে যখনই আমি গিয়েছি বা যাই তখন তাদের মাঝে আমার আমিকে হারিয়ে ফেলি। শিক্ষার্থীদের জন্য সর্বদা কিছু করার তাড়না কাজ করে। আর সেই চেতনাবোধের জায়গা থেকেই মুক্তির গান এর যাত্রা। যাদের চোখ দিয়ে আগামীর বাংলাদেশ দেখব আমরা তাদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধুকে ছড়িয়ে দেবার প্রত্যয় নিয়েই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং তরুণ প্রজন্মর কাছে সত্যিকারের ইতিহাস নিয়ে যাচ্ছি। দেশ স্বাধীনের ইতিহাস, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে জাতির জনকের হত্যা, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একের পর এক অপপ্রচারসহ বিভিন্ন বিষয়ের প্রকৃত সত্য নিয়ে স্কুল-কলেজে পাঠচক্র করছে মুক্তির গান। আমরা চাই, বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গড়ে উঠবে একটি করে মুক্তির কর্ণার যেখানে বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাস নিয়ে লেখা গুণীজনদের বই থাকবে, বঙ্গবন্ধুর জীবন ও সংগ্রাম নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে আলোচনা করা হবে, টুঙ্গিপাড়ার এক খোকা কিভাবে হয়ে উঠেছিলেন স্বাধীন বাংলার পিতা, কিভাবে এক তর্জনীর ইশারায় পাল্টে গিয়েছিল একটি জাতির ইতিহাস- এ সবকিছু শিক্ষার্থীরা জানবে ও শিখবে আনন্দ এবং উৎসাহের মাধ্যমে। ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একে অপরের পরিপূরক’- এই লাইনটি কেবল মুখস্থ বিদ্যা হিসেবে তারা না শিখুক। আমরা তাদের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার মাধ্যমে এই বাক্যকে উপলব্ধি করাতে চাই। তারুণ্যদীপ্ত শিক্ষার্থীরাই জাতির প্রাণশক্তি। তাদের ভাবনাগুলোই হবে বাংলাদেশের ভাবনা। তাই শিশু-কিশোর মনের ভাবনাগুলোকে প্রাথমিকভাবে আমরা বিবেচনায় এনে গত ফেব্রুয়ারি মাসে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করি ‘সেই অবিনাশী উচ্চারণ’ নামে। শিশুর কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ প্রতিযোগিতায় খুব অল্প সময়ে বিশাল সাড়া পাই। ‘মুক্তির গান’ টিম যখন আমাকে সেটা জানাল আমি নিজেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে মাত্র ১৫ দিনে প্রায় দশ হাজার শিশু কিশোর বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিজেদের কণ্ঠে ধারণ করে আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন। আমি তাদের আগ্রহ দেখে সত্যি অভিভূত হয়েছি, বেশি অবাক করেছে তাদের এই অল্প বয়সে দৃঢ় কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। আমি অবাক হয়ে দেখেছি ও শুনেছি তাদের ভরাট কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর উচ্চারণ। শব্দের ওঠানামা এবং দেহভঙ্গিতে বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করার প্রত্যয় আমার চোখে জল এনে দিয়েছে। আমি নতুনভাবে নিজেকে জেনেছি এবং তরুণদের নিয়ে ‘মুক্তির গান’ সামনে এগিয়ে নেবার রসদ পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে বছরব্যাপী নানা আয়োজন নিয়ে ‘মুক্তির গান’ থাকবে দেশের তরুণ সমাজের কাছে। ঘরে ঘরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পৌঁছে দেয়ার দায় আমাদের সবার। আমরা আহ্বান জানাব, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মর কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য পরিবারের অভিভাবকরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করুন, শিক্ষকরা মুক্তি বার্তা ছড়িয়ে দিক সর্বত্র। মনে রাখতে হবে, পরিবার হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষার প্রধান জায়গা। পরিবারের কাছে একটি শিশু বা কিশোর প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করে। পরিবার যদি তাকে যুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানায়, তাহলে তার বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম এবং বিকৃত ইতিহাস শিক্ষার সুযোগ কম। নাগরিক হিসেবে আমরা যেন আমাদের দায়িত্বটুকু পালন করি। আমরা চাই, টিম ‘মুক্তির গান’ ঘরে ঘরে গড়ে উঠুক। তরুণ সমাজের অস্তিত্বে থাকুক বাংলাদেশ, তরুণদের কাজগুলো হোক বাংলাদেশের কাজ, তাদের সব স্বপ্ন হোক বাংলাদেশকে নিয়ে। লেখক : সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা
×