ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন

হারিয়ে যাচ্ছে বর্ষাকাল

প্রকাশিত: ০৮:৪৭, ১ জুলাই ২০১৯

 হারিয়ে যাচ্ছে বর্ষাকাল

কবি গুরুর বর্ষা কবিতা পড়লে মন খুবই আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে। তিনি বাংলার বর্ষার রূপ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে লিখেছিলেন, ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে, তিল ঠাঁই আর নাহিরে, ওগো! আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।’ কবি গুরুর বর্ষা কবিতাটি পড়লে গ্রাম বাংলার বর্ষার আসল রূপ জানা যায়। আমি ছোটবেলা থেকেই বর্ষা ঋতুকে খুব বেশি অনুভব করছি। কারণ, তখন প্রায় সারা বছর বৃষ্টিপাত ছিল এবং বাড়ির চার পাশে পানি ছিল। আমরা সেই বৃষ্টির পানিতে, খালে, বিলে, পুকুরে সারা বছরই নেচে, গেয়ে হেসে, খেলাধুলা করেছি এবং মাছ ধরেছি। আগে যে ক্ষেতে মাঠে গলা পানি, কমর পানি এবং হাঁটু পানি ছিল এখন সে ক্ষেতে কোন পানি নেই, শুকিয়ে ধু-ধু করছে। বাড়িতে চার পাশের খাল বিল গুলি শুকিয়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। যে মাঠে সারা বছর অর্থাৎ শীত আসার আগ পর্যন্ত নৌকা চলত ছোট, ছোট, ছেলে মেয়েরা, কৃষকরা মাছ ধরতো সেই ক্ষেত এবং মাঠ এখন পানি ও ফসল শূন্য। এই রূপসী বাংলার ৬টি ঋতুর মধ্যে বর্ষা ঋতুকে গ্রাম বাংলার মানুষ বেশি উপলব্ধি করত, আর শীত ঋতু ছিল কিছু দিনের অতিথির মতো। কখন আসে, কখন যে শেষ হয়ে আবার বর্ষা, গ্রীষ্ম ঋতু এসে যেত কেউ বলতে পারত না। এই বর্ষা ঋতু নিয়ে আমার অসংখ্য স্মৃতি কথা আছে। পাঠক মহলের উদ্দেশে সে সব স্মৃতি কথা কিছু লিখছি। আমি যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম যাই তখন আমার আব্বা বাজার থেকে একটি বাল্য শিক্ষা কিনে এনে দিয়েছিলেন। আমি সেই বই নিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তে যাই। তারপর আব্বা একটি বাংলা বই বাজার থেকে কিনে এনেছিলেন যতটুকু মনে পড়ে তার নাম ছিল ‘সবুজ সাথী’। এই বইগুলো নিয়ে আসা যাওয়া করছি। গ্রীষ্ম-বর্ষাকালে আমিসহ অন্যান্য বন্ধুরা প্রায়ই স্কুল ছুটি হলে বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি এসেছি। কিন্তু বই খাতাগুলো এমনভাবে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছি যেন বৃষ্টির পানিতে না ভিজে। বাইরে তখন প্রচুর বৃষ্টিপাত হতো বাড়ি আসতে অসুবিধা হতো। অনেকক্ষণ মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ার পর যখন একটি সুযোগ পেলাম তখন দৌড়ে বাড়ি আসতেছি। বাড়ির আঙ্গিনায় পৌঁছার আগে আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন মা দৌড়ে এসে আমাকে কোলে তুলে নিলেন এবং বললেন, বাবা তোমার কিছু হয় নাই তো? আমি বললাম না আম্মা কিছুই হয় নাই। মা পুলকিত নয়নে আমার দিকে চেয়ে শরীর মুছে আমাকে খাবার দিলেন। আমি তৃপ্তি সহকারে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে উঠে দেখছি সে যে ভর-দুপুর বৃষ্টি শুরু হয়েছিল এখনও হচ্ছে। বাড়ির চারদিকে পানি, পুকুরের পানি ভরাট হয়ে গেছে। পুকুরের মাছগুলো পারের কিনারায় এসে বলে দিচ্ছে যে কোন সময় পুকুরের পাড় ভেদ করে চলে যেতে পারে। এই পুকুরের মাছ ধরে রাখার জন্য বাঁশের চাটাই দিয়ে প্রত্যেক মানুষ ভেড়া দিত। এখন আর সেই দৃশ্যগুলো চোখে পড়ে না। কারণ কোথাও পানি নেই। আমার জন্ম ষাটের দশকে। এরপর থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রচুর বৃষ্টিপাত হতো। জেলেরা মাঠ খাল-বিল থেকে প্রচুর মাছ ধরত। তবে ষাট, সত্তর, আশির দশক পর্যন্ত যে সব দেশীয় মাছ পাওয়া যেত, এখন আর সে সব মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। দেশী মাছ এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৪ সালের প্রথম বন্যা আমি দেখতে পাই। সে বছর পাহাড়ি এলাকা ছাড়া দেশের সব জায়গায় বন্যার পানি ছিল। আমাদের বাড়িতে পানি উঠেছিল। আমরা বাড়ি ছেড়ে অন্য বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। তখন সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশ। পাকবাহিনী আমাদের দেশটাকে অন্তঃসারশূন্য করে ফেলেছিল তবুও বঙ্গবন্ধু সরকার অনেক সাহায্য সহযোগিতা করেছে। সদ্য স্বাধীনপ্রাপ্ত দেশ হওয়ার কারণে ১৯৭৪ সালের বন্যা মানুষ বেশি অনুভব করেছে। এরপর থেকে বাংলাদেশে প্রতি বছরই বন্যা হতো। বাড়ি-ঘর পানিতে তলিযে যেত। খেতের ফসলগুলোও বন্যার পানিতে এসে তলিয়ে যেত। এভাবে কৃষকরা দুই তিনবার ফসল লাগানোর পরও আবার বন্যার পানি তলিয়ে নিয়ে যেত। দেশে ১৯৭৪ সালের বন্যার চেয়েও আরও ভয়াবহ বন্যা হয়েছে, যতটুকু মনে পড়ে ১৯৮৮ এবং ১৯৯৮ সালের বন্যা তৎকালীন সরকার তা সফলভাবে মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছিল। দেশের বিভিন্ন স্থানে নদী ভাঙ্গনের কারণে এবং ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলী রাষ্ট্র অসম ও অন্যান্য প্রদেশ থেকে পানি আসার কারণে আমাদের দেশে বন্যার অন্যতম কারণ ছিল। ৫/৬ বছর হবে আমাদের বৃহত্তর কুমিল্লা এলাকাসহ দেশের অন্যান্য এলাকায় তেমন বর্ষাকাল পরিলক্ষিত হয় না। এখন কেউ নৌবিহারে বের হয় না। যেই খালগুলো নদীর সঙ্গে সংযোগ ছিল তা এখন ভরাট হয়ে যাচ্ছে। গ্রামবাংলা এখন নগরায়ণ হয়ে আবহমান গ্রাম বাংলার প্রকৃত চেহারা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমার বয়স ৫ বছর থেকে শুরু করে আমি যখন স্নাতক শ্রেণীতে পড়ছি তখন পর্যন্ত আমি নৌকায় করে বেড়াতে গিয়েছি, নৌকায় রেল স্টেশনে গিয়ে রেল গাড়িতে উঠে কলেজ করেছি আবার বিকালে বাড়ি ফিরে এসেছি। এই যে আসা-যাওয়ার পথে বাংলার বর্ষার প্রকৃতি রূপ দেখতে পেয়েছি, আবার নৌকা থেকে খাল-বিল এবং মাঠ থেকে শাপলা শালুক তুলে ঐ নৌকার মধ্যে খেয়ে খুব তৃপ্তি অনুভব করেছি। এখন সেই খাল, বিল এবং মাঠের দিকে তাকালে আর পানি দেখি না। নৌকা চলা তো দূরের কথা একহাত পানিও নেই। আগে অতিরিক্ত বর্ষণের ফলে পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যার পানিতে ফসল তলিয়ে যেত। এখন পানির অভাবে কৃষক সেই মাঠে ফসল ফলাতে পারছে না। এখন আর ডিঙি নৌকা এবং পাল তোলা নৌকা দেখা যায় না। নতুন প্রজন্ম বাস্তবে ডিঙি নৌকা কি তা বুঝবে না। তাদেরকে বুঝাতে হলে ইন্টারনেট থেকে ছবি এনে বুঝাতে হবে। নচেৎ ভাটি অঞ্চলে গিয়ে নৌকা দেখিয়ে আনতে হবে। এখন নিচু এবং ভাটি অঞ্চল ছাড়া সাধারণত: বর্ষাকাল তেমন পরিলক্ষিত হয় না। আগে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস থেকে আশ্বিন, কার্তিক মাস পর্যন্ত খাল এবং বিল দিয়ে নৌকা চলত এবং জমিতে পানি থাকত। বিশ্বায়ন এবং বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে এরূপ অবস্থা হবে তা তেমন কখনও চিন্তা করিনি। আমি ১৯৮৬ সালে যখন দশম শ্রেণীতে পড়ি তখন আমার শ্রদ্ধাভাজন প্রধান শিক্ষক ইংরেজী প্রথম পত্র পড়াতেন। স্যার একদিন ইংরেজী ১ম পত্রের একটি অধ্যায় পড়াচ্ছিলেন। স্যার আলোচনা করছিল পৃথিবীতে গাছপালা হ্রাস পেলে বা কমে গেলে বৃষ্টিপাত হবে না এবং জলবায়ু পরিবর্তন হয়ে ধীরে ধীরে পৃথিবী মরুভূমিতে পরিণত হয়ে যেতে পারে। এক সময় যে বর্ষাকালের দৃশ্য হারিয়ে যাবে এবং জলবায়ু পরিবর্তন হবে তা বিশ্বাসই হচ্ছিল না। আগে বাড়ির রাস্তা বা উঁচু জায়গা থেকে মাঠের দিকে তাকালে শুধু পানি দেখা যেত, মনে হতো যেন বঙ্গোপসাগরের পারে দাঁড়িয়ে পানি দেখছি। পানির ঢেউ এসে রাস্তার পারে বাড়ির আঙ্গিনায় মিশে যেত তখন নদী বা সাগর দেখায় আর ইচ্ছা থাকত না। তখন আমরা কলা গাছের ভেলা বানিয়ে পানিতে নৌকার মতো করে ভেসে বেড়িয়েছি এবং সাঁতার কেটেছি। এখন মাঠের ফসলগুলো যেন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। কোন পানি নেই। বাঙালী সমাজে একটি প্রবাদ আছে আশ্বিনে নাকি শীতের জন্ম, আশ্বিন কার্তিক মাসে মাঠের খাল, বিলের পানি কমে আসত। তখন গ্রাম বাংলার মাছ ধরার ধুম পড়ে যেত। গ্রামের মানুষরা বিভিন্ন জাল অর্থাৎ ঠেলা জাল, পেলুন জাল, কোনি জাল, দর্মজাল, পল ইত্যাদি সারঞ্জাম দিয়ে মাছ ধরত। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে তখন প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। বিভিন্ন দেশী পুঁটি, টাকি, পাবদা, টেংড়া, শিং, মাগুর কৈ ইত্যাদি মাছ কেটে রোদে শুকিয়ে শুঁটকিতে পরিণত করত। তখন সেই শুঁটকি মাছের গন্ধ প্রতিবাড়ি থেকে আসত। তখন কুনি জাল দিয়ে মানুষ বেশি মাছ ধরত। মাঠের ধান ক্ষেতের পানি কমে যখন খালের মধ্যে পড়ত তখন বড়, বড় দেশী মাছ বোয়াল, শইল, গজার ইত্যাদি রাক্ষুসেসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বেশি ধরা পড়ত। এখন আর সেই বর্ষার পানিও নেই এবং মাছও নেই। বর্ষার পানি আরও কমে আসার পর খাল, বিল, পুকুরে বিভিন্ন ধরনের পুঁটি, টেংরা মাছগুলো যখন কিলবিল করত তখন খুবই চমৎকার লাগত। মনে হতো যেন পুকুরে খালে, বিলে সাদা রুপালি ইলিশ ঝিলিক মারছে। আমরা মাছে-ভাতে বাঙালী। ভাতের মতো আমরা প্রচুর মাছ খেয়ে আমিষের চাহিদা মিটিয়ে তৃপ্তি অনুভব করছি। এখন বাজারে তেমন দেশী মাছ পাওয়া যায় না। সব মাছ এখন হাইব্রিড এবং চাষের। ছোটবেলায় সেসব মাছ খেয়ে তৃপ্তি অনুভব করছি সে মাছগুলো এখন চোখের অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এখন আর মাছ খেয়ে সেই রকম তৃপ্তি অনুভব মনে হয় না। মনে হয় জেনে-শুনে রোগ কিনে খেলাম। ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি ঋতুরাজ বসন্ত শেষ হওয়ার পর পহেলা বৈশাখ যেদিন শুরু হতো সেদিন আমাদের স্থানীয় বাজারে মেলা বসত এবং বিকাল বেলা খুব ঝড়, তুফান এবং বৃষ্টিপাত হতো। পহেলা বৈশাখ থেকে বৃষ্টি শুরু হতো তা থেমে থেমে চলত শরৎ ঋতু শেষ হওয়া পর্যন্ত। বিশেষ করে, এই ৬/৭ মাস দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হতো। ফলে, আমাদের দেশে তখন প্রায়ই বন্যা হতো। মাঠে তখন প্রচুর পানি থাকত। এই ফসলের মাঠ থেকে মানুষ হরেক রকমের মাছ ধরত। মাঠের আউশ ধানগুলোকে মনে হতো তারা যেন পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে আছে। এই আউশ ধানের ক্ষেত থেকে গ্রামের মানুষ বিভিন্ন বড়শি দিয়ে বিশেষ করে কৈ মাছের জাল পেতে কৈ মাছসহ বিভিন্ন রকমের মাছ ধরত। আমন ধান ওঠার আগ পর্যন্ত এই মাছ ধরা চলত। জমিতে বিভিন্ন কীটনাশক ব্যবহারের কারণে দেশী মাছের সংখ্যা প্রায় বিলুপ্তির পথে। যখন মাঠ শুকিয়ে যেত এবং হেমন্ত ঋতু আসত তখন মাঠে সোনালী ধানের ঢেউ খেলত। তখন বাংলাকে চিরসবুজ মনে হতো। ক্ষেতের ধান দেখে মনে হতো বাংলার মানুষের কোন অভাব অনটন নেই। একদিকে কৃষক মাঠ থেকে ধান কেটে বাড়ি আনত অন্যদিকে বাংলার ঘরে ঘরে নবান্নের উৎসব চলত। যে বছর বেশি বন্যা হতো তখন ফসলশূন্য হতো এবং তা দেখে মনে কষ্ট লাগত। আবহমান বাংলায় ১২ মাসে ছয়টি ঋতু হওয়ার কারণে বাংলার চিররূপ বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। বিশ্বায়নের যুগে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলার ছয়টি ঋতুর বৈশিষ্ট্য কি হারিয়ে যাবে? বর্ষা আমাদের প্রধান ঋতু। এই বর্ষা ঋতুসহ সব ঋতু যেন হুমকির মুখে না পড়ে সে দিকে খেয়াল রেখে আমাদের সকলের কাজ করে যেতে হবে। এই ছয়টি ঋতুর বৈশিষ্ট্য অটুট থাকলে আমাদের রূপসী বাংলার রূপ দিন দিন আরও বেশি বৃদ্ধি পাবে এবং বাংলা চিরদিনই বর্ষা এবং কবিতার দেশ হয়ে থাকবে। লেখক : শিক্ষাবিদ
×