ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রিফাত হত্যার সব আসামি শীঘ্রই গ্রেফতার হবে

প্রকাশিত: ১০:৩৮, ৩০ জুন ২০১৯

রিফাত হত্যার সব আসামি শীঘ্রই গ্রেফতার হবে

গাফফার খান চৌধুরী/মোস্তফা কাদের ॥ বরগুনায় রিফাত শরীফ হত্যা মামলার সব আসামি দু’ এক দিনের মধ্যেই গ্রেফতার হবে। আসামিদের পালানোর সব রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। গ্রেফতার হওয়া তিন আসামিকে রিমান্ডে পেয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এদিকে রিফাত হত্যাকারীদের গ্রেফতারসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে শনিবার রীতিমতো উত্তাল হয়ে উঠেছিল বরগুনা। ৃএছাড়া সাতক্ষীরা ও ঝিনাইদহেও রিফাত হত্যার প্রতিবাদে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচী পালিত হয়েছে। গত ২৬ জুন সকাল সাড়ে দশটার দিকে বরগুনা সরকারী কলেজের সামনে প্রকাশ্যে খুনী নয়ন বন্ড ও তার সহযোগীরা রিফাতকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করে। রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি খুনীদের হাত থেকে স্বামীকে বাঁচাতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। ওইদিন বিকেল চারটায় রিফাত বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ঘটনার পরপরই প্রধানমন্ত্রী আসামিদের গ্রেফতারে কড়া নির্দেশ দেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেশের প্রতিটি থানায় বিশেষ বার্তা পাঠায়। স্থল ও জল সীমান্ত, নদী বন্দর ও বিমানবন্দরে রেড এলার্ট জারি করে। এদিকে ঘটনার সময় আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন মোবাইল ফোন ঘটনার ভিডিও ধারণ করেন। পরে সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দিলে রীতিমতো ভাইরাল হয়ে পড়ে। পরদিন ১২ জনকে আসামি করে রিফাতের পিতা দুলাল শরীফ বরগুনা সদর থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় ঘটনার মূল হোতা হিসেবে অভিযুক্ত সাব্বির হোসেন নয়ন ওরফে নয়ন বন্ডকে। অপর আরেক খুনী রিফাত ফরাজী ও রিফাতের ভাই রিশান ফরাজীকে (২০)। অন্য আসামিরা হচ্ছে বরগুনা পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের মোঃ মুসা, সদর উপজেলার কেওড়াবুনিয়া এলাকার কালাম আকনের ছেলে রাব্বি আকন (১৯), বরগুনা পৌরসভার কলেজিয়েট স্কুল রোডের মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত (১৯), বরগুনা পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের কেজি স্কুল রোডের রায়হান (১৯), বরগুনা পৌরসভার কলেজ রোডের মোঃ হাসান (১৯), সদর উপজেলার গৌরিচন্না ইউনিয়নের সোনালি পাড়া এলাকার রিফাত (২০), একই এলাকার অলি (২২), এবং টিকটক হৃদয় (২১)। এছাড়াও মামলায় অজ্ঞাত আরও ৫/৬ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। মামলার সাক্ষী করা হয়েছে, রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি, রিফাত শরীফের চাচা আব্দুস সালাম শরীফ ও আজিজ শরীফ, বরগুনা পৌরসভার কাউন্সিলর মোঃ রইসুল আলম রিপনের ছেলে মঞ্জুরুল আলম জন, সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের উত্তর বড় লবণগোলা গ্রামের আলতাফ হোসেন হাওলাদারের ছেলে মোঃ লিটন, একই এলাকার মরহুম আজম আলী মৃধার ছেলে আনোয়ার হোসেন মৃধা, মরহুম আনসার আলী মৃধার ছেলে মোঃ জাকারিয়া বাবু, রুহুল আমিনের ছেলে হারুন ও মরহুম আলতাফ হোসেন হাওলাদারের ছেলে আবদুল হাই আল হাদিসহ বেশ কয়েকজনকে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ঘটনাস্থলটি নিরাপত্তার জন্য তাদের বসানো সিসি ক্যামেরার আওতায় পড়েছে। এজন্য ঘটনার পর পরই সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে খুনীদের শনাক্ত করা হয়। শনাক্ত হওয়া দৃশ্য বার বার যাচাই বাছাই ও পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, যারা ঘটনাস্থলের পাশে ছিল তাদের অধিকাংশই খুনীদের সহযোগী। তারা প্রকৃতপক্ষে দর্শক ছিল না। এজন্য তারা মিন্নি চিৎকার করে সহায়তা চাওয়ার পরও এগিয়ে যায়নি। শুধুমাত্র একজন এগিয়ে গিয়েছিল। তিনি নিতান্তই মানবিক কারণে সেটি করেছিলেন। তার জবানবন্দী নেয়া হয়েছে। মিন্নি ছাড়াও তার জবানবন্দীতেও নৃশংস হত্যাকান্ডের সেই ঘটনা ওঠে এসেছে। এখন পর্যন্ত হত্যাকান্ডের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে ১৩ জনের জড়িত থাকার তথ্য মিলেছে। শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা নাগাদ নতুন করে কোন আসামি গ্রেফতার হয়নি। এদিকে গ্রেফতারকৃত তিন জনকে শুক্রবার বিকেলে আদালতে হাজির করে চন্দন ও হাসানের ১০ দিন এবং নাজমুল আহসানের পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। আদালত শুনানি শেষে চন্দন ও হাসানকে সাতদিন এবং নাজমুল আহসানকে দুইদিনের রিমান্ডে পাঠায়। শনিবার নিজ কার্যালয়ে রিমান্ডে থাকা তিন আসামির দেয়া তথ্যের বরাত দিয়ে বরগুনার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সাংবাদিকদের জানান, পলাতক আসামিরা নজরদারিতে আছে। দু’ এক দিনের মধ্যেই তারা গ্রেফতার হবে। আসামিদের পালানোর সব রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আসামিদের গ্রেফতার করতে হয়তো আর দু’দিন সময় লাগতে পারে। এদিকে পটুয়াখালী থেকে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা মোঃ মোখলেছুর রহমান জানান, শুক্রবার গভীর রাতে পটুয়াখালী শহরের গার্লস স্কুল এলাকা থেকে সাইমুন (২২) নামে একজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারকৃত সাইমুন আলোচিত রিফাত হত্যায় জড়িত বলে পুলিশের দাবি। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ভিপি মান্নানের ছোট মেয়ে মিথিলা ফারজানার জামাতা সাইমুন। তবে ভিপি মান্নান সাইমুনকে মেয়ে জামাতা হিসেবে স্বীকার করেন না। বরগুনার হাজার বিঘা এলাকার বাসিন্দা কাওসার মিয়ার ছেলে সাইমুন। আমতলী থানার ওসি আবুল বাসার জানান, রিফাত হত্যা মামলার ৬ নম্বর আসামি রাব্বি আকন (১৯)। ০০৭ স্কপ ॥ বরগুনা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, জিরো জিরো সেভেন (০০৭) নামের একটি ফেসবুক গ্রুপ হত্যাকান্ডটি পরিচালনা করেছে। জেমস বন্ড সিরিজের নামের আদলে এই গ্রুপটি পরিচালনা করছিল নয়ন বন্ড। গ্রুপের সেকেন্ড কমান্ড রিফাত ফরাজী। ফেসবুক গ্রুপটির ম্যাসেঞ্জারে হত্যার আগের রাতে তাদের গ্রুপের সবাইকে কলেজ ক্যাম্পাসে থাকতে বলা হয়েছিল। নয়নের গ্রুপটি দীর্ঘদিন ধরে পুরো এলাকায় নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ড চালিয়ে আসছিল। এদিকে রিফাতের হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে শনিবার সকাল দশটার দিকে ‘বরগুনার সর্বস্তরের জনগণ’ এর ব্যানারে বিশাল মানববন্ধন ও প্রতিবাদ কর্মসূচী পালিত হয়। মানববন্ধন শেষে বরগুনা জেলা শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিলে নানা শ্রেণী পেশার অন্তত তিন হাজার মানুষ অংশ নিয়েছিলেন। সমাবেশে নিহত রিফাতের পিতা দুলাল শরীফ বলেন, আমি এতিম হয়ে গেছি। আমি এই হত্যাকান্ডের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই। এরপর তিনি আর বক্তব্য দিতে পারেননি। পুত্রশোকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। সমাবেশে জেলা যুবলীগের সভাপতি এ্যাডভোকেট কামরুল আহসান মহারাজ, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রইসুল আলম রিপন, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সাহাবুদ্দীন সাবু, জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক এ্যাডভোকেট সুনাম দেবনাথ, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এ্যাডভোকেট জুবায়ের আদনান অনিক বক্তব্য রাখেন। প্রত্যেকই হত্যাকা-ের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। পাশাপাশি বক্তারা এ ধরনের অপরাধীদের যারা আশ্রয়প্রশয় দিয়েছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনার দাবি জানান। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জুবায়ের আদনান অনিক বলেন, রিফাত হত্যাকা-ের প্রধান আসামি নয়ন বন্ডের মাদক ব্যবসা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম নিয়ে বরগুনা প্রেসক্লাবে গত বছরে ২৮ এপ্রিল দুুপুরে সংবাদ সম্মেলন করা হয় জেলা ছাত্রলীগের তরফ থেকে। ওই খবর দেশের প্রধান প্রধান গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পরেও নয়নের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি দায়িত্বশীলরা। বরিশাল থেকে আমাদের স্টাফ রিপোর্টার জানান, রিফাত হত্যা মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ড বরিশাল থেকে গ্রেফতার হয়েছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি বরিশাল মহানগর পুলিশের তরফ থেকে বলা হয়েছে, নয়ন বন্ডকে গ্রেফতারের কোন তথ্য তাদের কাছে নেই। গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর অনেকেই ফেসবুক স্ট্যাটাসে নয়নকে প্রকাশ্যে ক্রসফায়ার দেয়ার দাবি তুলেন। ঝিনাইদহে মানববন্ধন ॥ রিফাত হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে ঝিনাইদহে মানববন্ধন কর্মসূচী পালিত হয়েছে। ঝিনাইদহ থেকে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, শনিবার দুপুরে শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে এ কর্মসূচীর আয়োজন করে বিহঙ্গ সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র। এতে ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে ঝিনাইদহের প্রায় সকল সাংস্কৃতিক সংগঠন ও মানবাধিকার কর্মীসহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেন। মানববন্ধন চলাকালে বক্তৃতা করেন, ঝঙ্কার শিল্পী গোষ্ঠীর শান্ত জোয়ার্দ্দার, জাগরণ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর বাবুল আক্তার লাল্টু, ঝিনেদা থিয়েটারের শামীম আহমেদ, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর দিলীপ ঘোষ, মানবাধিকার নাট্য পরিষদের রুবেল পারভেজ, কিন্ডারগার্টেন সাংস্কৃতিক একাডেমির গোলাম মোস্তফা চঞ্চল, আওয়ামী সাংস্কৃতিক ফোরামের তরিকুল ইসলাম দিদার, অঙ্কুর নাট্য একাডেমির ইছাহাক আলী, ঝিনাইদহ দর্পণের অমিয় মজুমদার অপু প্রমুখ। মানববন্ধনে একত্মতা ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক ফোরাম, ত্রিতাল নৃত্য একাডেমি, বাউল সমিতি, জেলা শিশু কিশোর নাট্যদল, কে সি কলেজ থিয়েটার, কেতন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও বেদুঈন। মানববন্ধনে বক্তারা, রিফাত হত্যার সকল খুনীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন। সাতক্ষীরায় মানববন্ধন ॥ সাতক্ষীরা থেকে আমাদের স্টাফ রিপোর্টার জানান, রিফাত হত্যার প্রতিবাদে এবং সাতক্ষীরা উন্নয়নে ২১ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছে সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটি। পৃথক পৃথক ব্যানারে নাগরিক আন্দোলন মঞ্চ একই দাবিতে মাবনবন্ধন কর্মসূচী পালন করে। মানববন্ধনে সভাপতিত্ব করেন কমিটির আহ্বায়ক মোঃ আনিসুর রহিম। মানববন্ধনে বক্তারা বরগুনার ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। বক্তারা ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিসহ ভবিষ্যতে এ ধরনের নৃশংসতারোধে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য দাবি জানান। মানববন্ধনে নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে সাতক্ষীরার উন্নয়নে রেললাইন নির্মাণ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চালু, সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জে নিকটবর্তী এলাকাকে পর্যটন এলাকা ঘোষণা, ভোমরা স্থল বন্দরকে পূর্ণাঙ্গরূপে চালুসহ ২১ দফা দাবি তুলে ধরেন। সভায় বক্তব্য রাখনে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সভাপতি অধ্যক্ষ আবু আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক মমতাজ আহমেদ বাপী, প্রফেসর আবদুল হামিদ, অধ্যক্ষ আশেক-ই এলাহী, বাসদ নেতা এ্যাডভোকেট শেখ আজাদ হোসেন বেলাল, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল বারী ও এম কামরুজ্জামান, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের সদস্য সচিব লায়লা পারভীন সেঁজুতি, সিপিবি নেতা আবুল হোসেন, মাধব চন্দ্র দত্ত, আলী নুর খান বাবলু, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক প্রাণদত্ত দাস, এ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ।
×