ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রেজা সেলিম

ক্যান্সার মোটেই ভয়ের অসুখ নয়

প্রকাশিত: ০৯:১৫, ৩০ জুন ২০১৯

 ক্যান্সার মোটেই ভয়ের অসুখ নয়

তথ্যপ্রযুক্তি ও চিকিৎসায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে রকম অগ্রগতি হয়েছে তা দেখে ও জেনে আজকাল অনেকেই জানতে চান ক্যান্সার রোগ হিসেবে এখন কতটা ভয়াবহ? এই রোগ চিকিৎসাযোগ্য কি-না বা নিরাময়যোগ্য কি-না। এই লেখায় আমরা এ রকম ভাবনার কিছু উত্তর খুঁজে দেখব, কিন্তু তার আগে আমাদের জানা দরকার ক্যান্সার কি? আমরা সবাই জানি, যে কোন প্রাণীর শরীর অসংখ্য ছোট ছোট কোষের মাধ্যমে তৈরি। কোষগুলো একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর মারা যায়। এই পুরনো কোষগুলোর জায়গায় নতুন কোষ এসে জায়গা করে নেয়। সাধারণভাবে কোষগুলো নিয়ন্ত্রিতভাবে এবং নিয়মমতো বিভাজিত হয়ে নতুন কোষের জন্ম দেয়। যখন এই কোষগুলো ‘কোন কারণে’ অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে থাকে তখনই ত্বকের নিচে মাংসের দলা অথবা চাকা দেখা যায়। একেই টিউমার বলে। এই টিউমার বেনাইন (নির্দোষ) বা ম্যালিগন্যান্ট (ক্ষতিকর) হতে পারে। খুব সাধারণভাবে যদি কেউ বুঝতে চান তাহলে এই রোগ কিছুতেই আর দশটা রোগের চাইতে আলাদা কিছু নয়। শরীরের যে কোন অসুখ ক্রমান্বয়ে একজন মানুষ, প্রাণী বা উদ্ভিদকে মৃত্যুর দিকে টেনে নিতেই পারে। ক্যান্সার রোগকে আমরা যেদিন থেকে বুঝতে শুরু করেছি, সেই শুরু থেকেই, আমরা এখনও তার কারণ পুরোপুরি হদিস করতে পারিনি, যে রকম হয়েছে অন্য আর সব রোগের বেলায়ও। অজানা কারণ হয়ত একে দুর্বিষহ করেছে বিশেষ করে পরিবারের জন্য, যেহেতু এর চিকিৎসায় খরচ তুলনামূলকভাবে বেশিই পড়ে। কিন্তু আমাদের জানা দরকার প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে অনেক ক্যান্সারই ভাল হয়। এ ক্ষেত্রে অসংক্রামক রোগ (প্রধানত ক্যান্সার, কিডনি রোগ, হৃদরোগ, মস্তিষ্কের স্ট্রোক, ডায়াবেটিস ইত্যাদি) নিয়ন্ত্রণ বুঝতে আমাদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানো দরকার। আমাদের জানা দরকার যে, চিকিৎসা বিজ্ঞানে ক্যান্সারকে আজকাল অন্য আর সব রোগের মতোই বিবেচনা করা হয়। উন্নত বিশ্বে ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষের শতকরা ৫০ ভাগই এখন নিরাময় লাভ করেন বা ক্যান্সার হয়নি এমন মানুষদের মতোই গড় আয়ু পেয়ে থাকেন। আমাদের মতো গরিব দেশগুলোর অসুবিধা হলো, আমরা চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি নিয়ে বেশি একটা খবর রাখি না বা পাইও না। যাদের পাওয়া উচিত (যেমন চিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী) তারা এই নিয়ে বেশি একটা খোঁজ করেন না বলে তাদের কাছে অনেক খবর ঠিকমতো পৌঁছায় না। ক্ষেত্রবিশেষে পৌঁছালেও ধারাবাহিক মেডিক্যাল জ্ঞানের অভাবে এসবের অগ্রগতির তাৎপর্য তারা ঠিকমতো বুঝতে পারেন না। ফলে ক্যান্সার রোগের মতো যে রোগগুলো অসংক্রামক তা নিয়ে আমাদের দেশে চিকিৎসা জগতের তেমন কোন প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। আর এই সুযোগে ওষুধ কোম্পানিগুলো জেঁকে বসে আমাদের বেশি দামের ওষুধ কিনে নিতে বাধ্য করছে। উন্নত বিশ্বে যা হয়, আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় একটি পরিপূর্ণ নিরীক্ষণ পরিকল্পনা নিয়ে রোগ নির্ণয় করা হয়। এর জন্য অনুসরণ করা হয় চিকিৎসার ভেদ অনুযায়ী নির্ধারিত অনুসরণিকা বা গাইডলাইন। আমাদের দেশে সে রকম উপযোগী গাইডলাইন না থাকায় বা নিয়মিত ব্যবহার না থাকায় ও স্থানীয় পর্যায়ের গবেষণার সুযোগ কম থাকায় নানা রকম পরীক্ষায় পাঠানো হয় রোগীদের। এর ফলে প্রচুর টাকা খরচ হয় শুধু রোগ নির্ণয় করতেই। তার সঙ্গে হয়রানি তো আছেই। ক্যান্সার সঠিকভাবে শনাক্ত করা গেলে এই রোগ মোটেই ভয়ের কোন অসুখ নয়। এই রোগ শনাক্তকরণই হলো বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। চিকিৎসা পদ্ধতি ক্যান্সারের মাত্রাভেদে ভিন্ন হবে কিন্তু আমরা যদি পরিপূর্ণ নিশ্চিত হয়ে মানবদেহে এর অবস্থান নির্ণয় করতে না পারি তাহলে চিকিৎসা পদ্ধতি যতই উন্নত হোক এতে আমাদের কোন উপকার হবে না। স্তনের ক্যান্সারসহ অনেক ক্যান্সারই প্রাথমিক চিকিৎসায় ভাল হয়। জরায়ুর ক্যান্সার প্রতিরোধে এখন টিকা আবিষ্কার হয়েছে এবং বাংলাদেশেও তা পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের জন্য জরুরী হলো, ক্যান্সারের উপসর্গ বুঝে এর মাত্রা নির্ণয়ে তৎপর হওয়া। দেশে দেশে তথ্যপ্রযুক্তি এই ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে। আমরা অনেকেই হয়ত জানি সার্জারি বা টিউমার অপসারণে এখন ‘সাইবার নাইফ’ ব্যবস্থা চালু হয়েছে যা কোন রক্তপাত ছাড়াই চিকিৎসা পদ্ধতিতে অনেক জনপ্রিয় হয়েছে। ‘সাইবার নাইফ’ এক প্রকারের রেডিয়েশন চিকিৎসা পদ্ধতি। এ হলো বিশ্বের প্রথম ও একমাত্র রোবোটিক রেডিও সার্জারি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে শরীরের যে কোন অংশে থাকা টিউমার রোগের চিকিৎসা করা যায়। এ চিকিৎসায় কোন ব্যথা, যন্ত্রণা অনুভূত হয় না। এছাড়া রোগীকে অচেতনও করতে হয় না। চিকিৎসা বিজ্ঞানীগণ এখন পরীক্ষা করে দেখছেন- এসব আধুনিক পদ্ধতিতে কত কম খরচে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ক্যান্সার চিকিৎসায় প্রযুক্তি-সেবা দেয়া যায়। বাংলাদেশের সেই প্রস্তুতি নেয়া দরকার। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পাবার ফলে বেশি বয়সের অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবও বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা বেড়েছে। বিশেষত স্বাস্থ্য সচেতনতা ও রোগ নির্ণয়ের আধুনিক ব্যবস্থাগুলো জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সম্প্রসারণের ফলে রোগ ধরা পড়ছে বেশি। যদিও ক্যান্সার নির্ণয়ে নানারকম বিভ্রান্তি ও জটিল পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা বলা হয়- যা প্রাথমিক রোগ নির্ণয়ের জন্য মোটেই সঙ্গত নয়। শরীরে কোন অস্বাভাবিক কিছু দেখলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া ভাল। কিন্তু আমরা যখন যাই তখন রোগ শরীরে ছড়িয়ে পড়ে ও চিকিৎসকের সেবা দেয়ার ক্ষমতা কমে আসে। আমাদের বুঝতে হবে, ভয় পেয়ে এই রোগ নিয়ে দুশ্চিন্তা করে নিজের ও পরিবারের দুর্ভোগ বাড়ানো উচিত নয়। আমাদের দেশে এখন অনেক চিকিৎসা কেন্দ্র সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে তৈরি হয়েছে- যেখানে মোটামুটি ক্যান্সার নির্ণয়ের ও চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ক্যান্সার এমন কোন রোগ নয় যে এর ফলেই কারও মৃত্যু অনিবার্য আর অন্য কোন রোগে মৃত্যু হবে না বা জীবন দীর্ঘস্থায়ী হবে। বরং ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষ নিজের মৃত্যু আসন্ন জেনেও বাকি জীবনের অনেক পরিকল্পনা গুছিয়ে নিতে পারেন যা হৃদরোগ, মস্তিষ্কের স্ট্রোক বা আরও কিছু কিছু রোগের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ে সম্ভব হয় না। ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষের শেষ জীবনে যেসব শারীরিক উপসর্গ হয় তাতে কোন কোন ক্ষেত্রে রোগী বেশ কষ্ট পেয়ে থাকেন। বিজ্ঞানীগণ এই ব্যথার মাত্রা নির্ণয় করে এখন সঠিক চিকিৎসা দিতে সক্ষম এমন ওষুধ মাত্রাভেদে প্রয়োগের ব্যবস্থা আবিষ্কার করেছেন। ‘প্রশমন যত্ন’ হিসেবে এই সেবা এখন মোবাইল ফোনেও দেয়া হচ্ছে যাতে বাড়ি থেকেই রোগী তার ডাক্তারের কাছে ব্যথা ও অবসাদের মাত্রা জানাতে পারেন। আমাদের দেশেও এই সেবা কিছু কিছু ক্ষেত্রে চালু হয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও সমাজ বিজ্ঞানীগণ মিলে এখন উপায় বের করেছেন কী করে একজন ক্যান্সার রোগীকে বাড়ি রেখেই (পরিবারের অন্যসব সদস্যকে বিরক্ত না করেই) উপযুক্ত চিকিৎসা দেয়া যায়। এছাড়া এখন বিজ্ঞানীগণ ক্যান্সারের জন্য যথাযথ চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ণয় করেছেন যার ফলে ওষুধের মাত্রা (কেমোথেরাপি নামে পরিচিত) সঠিকভাবে অনুসরণ করে প্রয়োগ করা হলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় খুব সামান্যই (যেমন চুল পড়ে যাওয়া, বমি বা অবসাদের উপসর্গ হওয়া)। শুধু আমাদের এসব বিষয়ে কিছুটা সতর্ক জ্ঞানের দরকার। অনেক পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণায় দেখা গেছে, মানসিক অবসাদ ও দুর্ভাবনায় ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষের একটি বড় অংশ মারা যায়। যা কখনও কাম্য হতে পারে না। পরিবারের একজন সদস্যের শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকা খুব জরুরী হয় যেখানে তিনি একইসঙ্গে সমাজে ও জাতীয় জীবনে ভূমিকা পালন করে থাকেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানীগণ এই নিয়ে অনেক কাজ করছেন এবং আশা করছি এর সুফল ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীরা শীঘ্রই পাবেন। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়ন প্রকল্প [email protected]
×