ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুহম্মদ-র-ই-শামীম

টেকসই অর্থনীতির স্বার্থেই ধানের ন্যায্যমূল্য প্রয়োজন

প্রকাশিত: ০৭:৩০, ৩০ জুন ২০১৯

টেকসই অর্থনীতির স্বার্থেই  ধানের ন্যায্যমূল্য প্রয়োজন

পণ্য উৎপাদনকারী সকল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান উৎপাদন খরচের সঙ্গে লাভ যোগ করেই পণ্য বিক্রি করেন। কোন উৎপাদনকারীই উৎপাদন মূল্যে পণ্য বিক্রি করেন না। এমনকি কোন প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর লোকসানের পরও ভোক্তাদের জন্য পণ্য উৎপাদন করে এমন নজিরও নেই। আমরা যারা ভোক্তা তারাও এমন আশা করি না যে, কোন উৎপাদনকারী লাভ ছাড়া শুধু আসল মূল্যে আমাদের ভোগ্যপণ্য খাওয়াবে। লোকসানে তো নয়ই। কিন্তু ব্যতিক্রম হলো চাল, তা আমরা সস্তায় খেতে চাই। আসল মূল্যের চেয়েও কমে খেতে চাই, এমন মানসিকতার লোকের অভাব নেই। চালের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটি ধনী-গরিব সবাই যেন আমরা সস্তায় খেতে চাই। কিন্তু কেন? এক্ষেত্রে উৎপাদনকারী কৃষকের কথা আমরা বেমালুম ভুলে যাই বা ভুলে থাকতে চাই। অন্যান্য উৎপাদনকারীর মতো কৃষকের সঠিক মূল্য পাওয়ার যে অধিকার আছে, অনেকেই আমরা সে ব্যাপারে নীরব থাকি। ফলে দেখা যায়, কৃষক সমাজ বছরের পর বছর উৎপাদিত কৃষিপণ্য লোকসানে বিক্রি করেন। অথচ কথায় কথায় আমরা বলি, কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। বস্তুত আমাদের সমাজে চাল তথা ধান উৎপাদনকারী কৃষকদের প্রতি এক ধরনের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য আগেইও ছিল, এখনও যে নেই তা বলা যাবে না। কৃষকদের প্রতি অনেকেরই মন মানসিকতা সামন্তবাদী বা প্রভুত্ববাদী। এরা হয়ত মনে করেন, এসব চাষা-ভুষারা আমাদের জন্য ধান চাষ করতে বাধ্য। এটাই তাদের কর্তব্যকাজ। এরা রোদে পুড়ে ঘাম ঝরিয়ে কায়িক শ্রমে আমাদের জন্য সস্তায় লোকসানে চাল উৎপাদন না করে কি করবে? অথচ আমরা কি ভেবেছি, সঠিক দামে ধান-চাল বেচতে না পারা মানে কৃষকের ঘাম শ্রমের প্রতি অবজ্ঞা করা, যা তাদের অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। আবার তাকে সস্তায় পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য করা কতটুকু নৈতিকতার কাজ? অথচ আমাদের এসব কৃষকরা ধানের লাভ চায় না, চায় শুধু আসল মূল্য। ঘাম-শ্রমের মূল্যও চায় না। ন্যায্যমূল্যও চায় না। তবুও শুধু উৎপাদন খরচটুকু দিতে আমরা বার বার ব্যর্থ হই। এই ব্যর্থতা তাদের পেশার প্রতি আমাদের যথার্থ মূল্যায়নের অভাবেরই বহির্প্রকাশ। অথচ এখনও কৃষি আমাদের অর্থনীতির ভিত্তি। জনসংখ্যার ৭০ ভাগই এখনও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কৃষিনির্ভর। শতকরা প্রায় ৪৮ ভাগ শ্রমশক্তি এখনও এখাতে নিয়োজিত। গ্রামীণ অর্থনীতি পুরোটাই এখনও কৃষিনির্ভর। অন্যান্য পণ্যের বাজারের প্রধান ক্রেতা গ্রামীণ এসব কৃষক পরিবার। তাদের ক্রয়ক্ষমতার বিষয়টিও তাদের সঠিক মূল্যপ্রাপ্তির সঙ্গে সম্পর্কিত। কৃষিনির্ভর এই সিংহভাগ জনগোষ্ঠীর ক্রয় ক্ষমতা না থাকলে তার নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতির অন্যান্য ক্ষেত্রেও পড়তে বাধ্য। এ বছর কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ধান বিক্রি করতে না পেরে ক্ষোভে ধান ক্ষেতে আগুন দিয়েছে, এমন ঘটনাও ঘটেছে। কৃষকের খেতের প্রতিটি সোনালি শীষে তার শ্রম-ঘামের বিন্দু মিশে আছে। এই সোনালি ফসল এবার উৎপাদিত খরচের অর্ধেক দামেও বিক্রি করতে পারছে না। ফলে ধানকাটা মাড়াইয়ের শ্রমিকের মূল্য পরিশোধও করতে পারছে না। এসব দুর্দশার চিত্র, খবর প্রতিদিন দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত হচ্ছে কিন্তু তাতেও তো তাদের ধানের ক্রেতা মিলছে না। সরকার প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ধান চালের ক্রয় মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। কৃষক উৎপাদন করে ধান, আর সরকার সিংহভাগই ক্রয় করে চাল। ফলে একটি মধ্যস্বত্বভোগী ক্ষমতাধর সিন্ডিকেটের পকেটেই যায় এর পুরো সুফল। কৃষক পর্যায়ে এর সুফল পৌঁছে না। এটা আমরা সবাই জানি। তবুও সরাসরি কৃষকের নিকট থেকে ধান ক্রয় নিশ্চিত করা যায়নি। এখানেই বড় গলদ রয়ে গেছে। এর প্রধান কারণ প্রভাবশালী মিলার, দালাল মধ্যস্বত্বভোগী চক্র। মূলত এরাই নিয়ন্ত্রণ করে ধান-চালের বাজার। আবার নীতি নির্ধারণী বিষয়েও কার্যকর ভূমিকার অভাব লক্ষ্য করা যায়। যেমনÑ পত্রপত্রিকায় দেখা যাচ্ছে, ভরা বোরো মৌসুমেও চাল আমদানি অব্যাহত আছে। অবশ্য লেখালেখির পর আমদানি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। ততক্ষণে আমদানি করা শেষ। গত ২৬ মে একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, চালকল মালিকদের কাছে এখনও আমন চালই অবিক্রীত রয়ে গেছে। অর্থাৎ সর্বত্রই এক প্রকার উদাসীনতা, সমন্বয়হীনতা লক্ষণীয়। তবে কৃষকের উৎপাদিত ধান নিয়ে এ রকম সমস্যা অবশ্য নতুন নয়। যুগ যুগ ধরেই এ রকম সমস্যার পরও কৃষকরা পণ্য উৎপাদন করছে বিকল্প উপায় না পেয়ে। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, শতকরা ৬৫ ভাগ কৃষকই এ পেশায় থাকতে ইচ্ছুক নয়। থাকার কথাও নয়। একটি জনবহুল কৃষিপ্রধান দেশের জন্য এ তথ্যটি অবশ্যই উদ্বেগজনক। অথচ ১৭ কোটি মানুষের মুখে অন্ন যোগানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ পেশাটি টিকে না থাকলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো বিকল্প কোন পন্থা বা সামর্থ্য কোনটাই আমাদের নেই। এ সমস্যা উত্তোরণে অনেকেই ধান তথা কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির কথাটি বলে থাকেন। কৃষি অর্থনীতিবিদ যারা আছেন, তারা কি দয়া করে গবেষণা করে বলবেন, এক মণ ধানের প্রকৃত পক্ষে ন্যায্যমূল্য কত? সরকার যা নির্ধারণ করে তাই কি ন্যায্যমূল্য? এ প্রশ্ন অবশ্য আমার নয়। এক্ষেত্রে একজন কৃষকের কথায় ন্যায্যমূল্য বলতে কী বুঝি উল্লেখ করতে চাই। গত বছর ট্রেনে যাওয়ার পথে একদিন যাত্রীদের মধ্যে ধানের ন্যায্যমূল্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। এমন সময় গ্রামের একজন কৃষক অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গে আলোচনায় যোগ দিয়ে বললেন- ন্যায্যমূল্য কাকে বলে জানেন? ন্যায্যমূল্য দিতে হলে ধানের দাম হবে মণপ্রতি পনের’শ থেকে দু’হাজার টাকা। তিনি বুঝিয়ে বললেন, অন্য পণ্য উৎপাদনকারীরা পণ্যের আসলের সঙ্গে মুনাফা যোগকরে ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করে। ধানের ক্ষেত্রে কি তা ধরা হয়? যেমন- কৃষক যে ধান উৎপাদন করে, উৎপাদন খরচ বাদে তা বিক্রি করে শুধু লাভ দিয়ে সংসারের খরচ, বাচ্চার লেখাপড়া, চিকিৎসা, মাছ-মাংস খাওয়ার খরচ যদি মিটাতে পারে তবেই তা হবে ন্যায্যমূল্য। কিন্তু কৃষকেরা ধান বেচে কি তা পারে? পারে না। অর্থাৎ কৃষকেরা মাংস খাবে না, বাচ্চার লেখাপড়া করাবে না, চিকিৎসার খরচ জোটাতে পারবে না। শুধু লোকসান দিয়ে ১৭ কোটি মানুষের জন্য ধান উৎপাদন করে যাবে। কৃষকেরা অনেকটা যেন ব্রিটিশ আমলের নীল চাষী। ওই কৃষকের এসব প্রশ্নের জবাব দেয়া সত্যি কঠিন। তবে পাটের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি সঠিক মূল্য না পেতে পেতে কৃষকরা পাট চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। অথচ পাট এক সময় আমাদের প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল। কিন্তু পাটের অবস্থায় ধান ফসলের অবস্থা হলে আমদানিনির্ভর হওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। তখন খাদ্য নিরাপত্তা বিঘিœত হবে। উচ্চমূল্যে শতকরা কতভাগ লোক খেয়েপড়ে তখন বাঁচতে পারবে? তাছাড়া প্রধান খাদ্যশস্য আমদানিনির্ভরতার ঝুঁকি নেয়ার মতো অর্থনৈতিক ভিত্তি আমাদের এখনো তৈরি হয়নি। অর্থাৎ কৃষি, কৃষককে বাঁচানো ছাড়া আমাদের হাতে কোন বিকল্প নেই। সঠিকমূল্য নিশ্চিত করে আমাদের কৃষি, কৃষক বাঁচানো যতটকুু না বড় চ্যালেঞ্জ আমরা মনে করছি, তার চেয়ে আরও বড় চ্যালেঞ্জও কিন্তু কৃষিখাতের সামনে আছে। সেগুলোকেও আমাদের বিবেচনায় নিয়ে এখনই কৃষি, কৃষকদের বাঁচাতে হবে। টিকিয়ে রাখতে হবে তাদের এ পেশায়। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে আমাদের দেশের অবস্থান সর্বাগ্রে। বোরো ফসলের মতো এক ফসল নির্ভরতার ঝুঁকিও আমাদের কমাতে হবে। ধান বেশি উৎপাদনের কথাটিও কেউ কেউ বলছেন। তাদের উদ্দেশ্যে বলা যেতে পারে এজন্য কি কৃষক দায়ী? সরকারের কৃষি বিভাগের মাঠপর্যায়ে ব্লকভিত্তিক ডিপ্লোমাধারী কৃষিবিদ কর্মরত আছেন। তারা তাহলে আগে থেকেই কোন কৃষক কতটুকু জমিতে ধান উৎপাদন করবে বা করতে পারবে- তা নির্ধারণ করে দিল না কেন? প্রকৃতপক্ষে কৃষকের দুর্দশায় আমাদের সহমর্মিতার অভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। তাঁদের দুর্দশা, দুঃখ-কষ্ট শুধু গ্রামে সরেজমিনে গেলেই বোঝা যায়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, কৃষকের ধান নিয়ে আজকে যে দুর্দশা, কষ্ট, তা শুধু একা কৃষকের নয়। এর মাসুল আমাদের অর্থনীতির জন্য সুদূরপ্রসারী। এই ক্ষতির প্রভাব গ্রামীণ অর্থনীতিসহ সর্বত্রই পড়তে বাধ্য। এবং নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে অন্যান্য ক্ষেত্রেও যে পড়ছে তার চিত্রও ২৬ মে, ২০১৯ তারিখের একটি জাতীয় দৈনিকের নওগাঁ জেলার কৃষকদের নিয়ে এক প্রতিবেদনে ফুটে ওঠেছে। তাই পরিশেষে বলতে চাই- কৃষকের ধান নিয়ে এ সর্বনাশ কোনদিনই শুধু কৃষকের একার নয়। আমাদের অর্থনীতির জন্যও এই সঙ্কট দীর্ঘমেয়াদি নানা ক্ষতি ডেকে আনবে। বর্তমান সরকারের সময় কৃষিতে স্থবিরতা কাটিয়ে যে উন্নয়নধারার সূচক হয়েছে- তার সুফল থেকে কৃষকেরা যেন বঞ্চিত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই। তাই টেকসই অর্থনীতি এবং ১৭ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে কৃষকের ধানের সঠিক মূল্য নিশ্চিত না করার কোন বিকল্প নেই। আশার কথা, সরকার ইতোমধ্যে সরাসরি কৃষকের নিকট থেকে ধান ক্রয়ের নির্দেশনা দিয়েছেন এবং নির্ধারিত মূল্যে ধান কেনা শুরু হয়েছে। এখন দেখার পালা কৃষকরা এর সুফল কতটুকু পায়।
×