ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রাস্তায় ফায়ার হাইড্রেন্ট না থাকায় আগুন নেভাতে ভোগান্তি

প্রকাশিত: ০৯:৫৯, ২৯ জুন ২০১৯

 রাস্তায় ফায়ার হাইড্রেন্ট না থাকায় আগুন  নেভাতে ভোগান্তি

মশিউর রহমান খান ॥ ভয়াবহ যানজট, সরু রাস্তা, পর্যাপ্ত পানির সংস্থান না থাকা ও অগ্নিনির্বাপণের অন্যতম উপকরণ ফায়ার হাইড্রেন্টে স্থাপন না করা ও জলাশয় কমে যাওয়ায় রাজধানীতে আগুন লাগলে সময়মতো তা নেভাতে পারছে না ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়ন, বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন নির্মাণ ও আবাসিক এলাকায় ইচ্ছামতো বাণিজ্যিক স্থাপনা তৈরির কারণে অগ্নিঝুঁকি নিয়েই বাস করছে রাজধানী ও এর আশপাশের কয়েক কোটি মানুষ। ছোটখাটো অথচ অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও কঠিন অবহেলায় ক্রমান্বয়ে অগ্নিগোলকে পরিণত হচ্ছে রাজধানী ঢাকা। এছাড়া রাজধানী ও বাইরের শহরগুলোতে নির্মিত সব বৃহত্তম ভবনে বাধ্যতামূলক ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপনের বিষয়টিও এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি সরকার। ফলে ঢাকায় বসবাসকারী কোটি কোটি নাগরিককে অগ্নিঝুঁকি নিয়েই রাতদিন কাটাতে হয়। অতি দ্রুততার সঙ্গে রাজধানীর সব নিম্নাঞ্চল অবৈধভাবে ভরাট করে ফেলা হচ্ছে। সরকারী হিসাব অনুযায়ী যেসব ডোবা ছিল তাও প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ভূমিদস্যুরা ভরাট করে গিলে খাচ্ছে। ফলে যে কোন দুর্ঘটনায় পানি মেলা অনেকটাই দুস্কর হয়ে পড়েছে। রাজধানীর বেশিরভাগ ভবনই একটির সঙ্গে আরেকটি গা-ঘেঁষে তৈরি। যে কোন সময় ঘটতেই পারে অগ্নিদুর্ঘটনা। প্রায় প্রতিদিনই ছোটবড় অগ্নিকান্ড ঘটছে। ছোট অগ্নিকান্ড নেভানো গেলেও বড় অগ্নিকা- নেভাতে লেগে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এর মধ্যেই কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে যায়। এ থেকে নাগরিকদের মুক্তি দিতে নেই কোন দায়বদ্ধতা, নেই কোন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। রাজধানীকে সম্পূর্ণ অগ্নিনির্বাপনমুক্ত করতে এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি কোন মাস্টারপ্ল্যান। অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলায় কোন নীতিমালা তৈরি হয়নি যাতে অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলা করা যায়। আগুন লাগার পরই কেবল কেন লাগল তা পরীক্ষায় নামেন অগ্নিবিশেষজ্ঞরা। কিন্তু আগুন থেকে বাঁচার জন্য পূর্বপ্রস্তুতি কতটুকু রয়েছে তা দেখতে কোন মাথাব্যথাই যেন নেই সংশ্লিষ্টদের। মাঝেমধ্যে ভবন পরিদর্শন করে কিছু উপদেশ-নির্দেশ আর শর্ত দিয়েই ক্ষান্ত ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ ও ভবন নির্মাণ তদারকি প্রতিষ্ঠান রাজউক। ভবন নির্মাণের সময় অগ্নিনির্বাপণের জন্য ফায়ার সার্ভিসের দেয়া শর্তাবলী ভবন মালিক বা ব্যবহারকারী আবাসিক বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা করছে কিনা তা দেখা হয় না। এসব কারণে সামান্য আগুনও ছড়িয়ে ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে। তবে এ চিত্র শুধু ঢাকায় নয় দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব বিভাগীয় ও জেলা শহরেও। অগ্নিকান্ডসহ অন্যান্য দুর্ঘটনায় কার্যক্রম পরিচালনা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। উন্নত বিশ্বে রাস্তার পাশে ও ফুটপাথে যথেষ্ট সংখ্যক ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপিত থাকে। ফলে যে কোন দুর্ঘটনায় সঙ্গে সঙ্গেই ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ওসব হাইড্রেন্টে পাইপ লাগিয়ে তাৎক্ষণিক পানি নিয়ে কাজে নেমে পড়েন। এতে অল্প সময়ের মধ্যেই আগুন নেভানো সম্ভব হয়। কিন্তু বাংলাদেশের কোন শহরেই এর প্রয়োগ দূরের কথা খোদ রাজধানীতেই নেই কোন ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করেনি সরকার। ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু ভবন ও বেসরকারী শিল্প প্রতিষ্ঠান ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করলেও তেমন প্রয়োগ নেই। এসব হাইড্রেন্টের ব্যবহার যেমন নেই তেমন কোন উন্নত প্রশিক্ষণ বা নির্দেশনাও নেই। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ মাঝে মধ্যে কিছু নির্দিষ্ট স্থানে অগ্নিদুর্ঘটনা মোকাবেলার মহড়া দিলেও ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা যে রয়েছে বা কতটুকু গুরুত্ব বহন করে তা বলেন না। এছাড়া নিজস্ব সরঞ্জাম দিয়েই এসব মহড়া দেয়া হয়। রাজধানীসহ দেশের যে কোন বিভাগীয় ও গুরুত্বপূর্ণ শহরে আগুন লাগলে সময়মতো তা নেভাতে পারছে না ফায়ার সার্ভিস। বেশিরভাগ সময়ই নিজস্ব সামান্য পানির ভান্ডার ফুরিয়ে যাওয়ার পর ওয়াসা বা সরকারী অন্যান্য সংস্থার পাশপাশি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের জলাধার থেকে পানি নিয়ে আগুন নেভাতে হচ্ছে ফায়ার সার্ভিসকে। সময় মতো পানি না পাওয়া ও হাইড্রেন্ট না থাকায় অল্প সময়ের মধ্যে সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। অথচ রাস্তার পাশে বা শহরের গুরুত্বপূর্ণ নির্দিষ্ট প্রতিটি স্থানে হাইড্রেন্ট না থাকায় আগুন নেভাতে দমকলকর্মীদের বেগ পেতে হচ্ছে। পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টা ও সর্বশেষ বনানীর এফআর টাওয়ারের আগুন নেভাতে দেরি হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল পানির স্বল্পতা। এমনকি ফায়ার সার্ভিসের একটি আধুনিক গাড়িও শুধু পানির সংস্থান করতে না পারায় এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে কাজ করতে পারেনি। ফায়ার হাইড্রেন্ট না থাকায় অসহায়ের মতোই চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া ফায়ার সার্ভিসের কিছুই করার ছিল না। তবে আগুন নেভাতে দেরি হওয়ার কারণ শুধু ফায়ার হাইড্রেন্টই নয় অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা যায় ভয়ানক যানজট সমস্যা। আগুন নেভাতে সহায়তাকারীর চেয়ে ঘটনাস্থলে উৎস্যুক মানুষের সংখ্যা বেশি হয়ে যায়। ফলে অগ্নিকান্ডের স্থলে পৌঁছাতে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের যানজট ঠেলে কাজ করতে ক্ষয়ক্ষতি মারাত্মক আকার ধারণ করে। গোটা এলাকা পরিণত হয় অগ্নিগোলকে। পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় অগ্নিকান্ডের খবর টেলিফোনে রাত দশটা ৩৮ মিনিটে জানতে পারে ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তারা। সেখান থেকে দুই মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলের দিকে রওনা হয় পাঁচটি ইউনিট। মাত্র দুই কিমিরও কম রাস্তা ভয়ানক যানজট আর উৎস্যুক মানুষের ভিড় ঠেলে পৌঁছাতে দমকল কর্মীদের সময় লাগে ২২ মিনিট। এরপর সেখানে পানির কোন উৎস না থাকায় ঘটনাস্থল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে নাজিমুদ্দীন রোডের কারা সদর দফতরের পুকুর থেকে পাইপ টেনে পানির জোগান নিশ্চিত করতে হয়। সব মিলিয়ে আগুনের ঘটনার খবর পাওয়ার পরও নির্বাপণ কাজ শুরু করতেই সময় লেগেছে আধাঘণ্টারও বেশি। পরে টানা ১৫ ঘণ্টারও বেশি সময় চেষ্টার পর চুড়িহাট্টার আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ততক্ষণে ঘটনাস্থলেই পুড়ে ভস্ম হয়ে যায় ৬৭ হতভাগ্য মানুষ। পরে আরও ৪ জন মারা যায়। চুড়িহাট্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর তৎকালীন ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক একেএম শাকিল নেওয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, চকবাজারের সরু রাস্তায় তীব্র যানজটের কারণে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে বেশি সময় লেগেছে। অকুস্থলের আশপাশে কোথাও পানির ব্যবস্থা না থাকায় কাজ শুরু করতে বিলম্ব হয়েছে। সময়মতো কাজ শুরু করা গেলে হয়তো হতাহতের সংখ্যা কিছুটা হলেও কম হতে পারত। রাস্তার যানজট ও পানির সংকুলান করতে গিয়ে শুধু চুড়িহাট্টাতেই নয়, ফায়ার সার্ভিসকে হিমশিম খেতে হয় রাজধানীসহ সব জেলা শহরেও। অপরদিকে ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে ঢাকাসহ সকল জেলা শহরে আগুন নেভাতে গিয়ে পদে পদে বাধা পাওয়ার তথ্যটি। সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শহর এলাকায় অগ্নিনির্বাপণের জন্য পর্যাপ্ত পানির অভাব, পর্যাপ্ত ফায়ার হাইড্রেন্ট না থাকা, যানজট ও অপ্রশস্ত রাস্তাঘাটের কারণে অগ্নিনির্বাপণ কষ্টকর। বহুমাত্রিক ঝুঁকিপূর্ণ অগ্নিকান্ড, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়ন এবং বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন নির্মাণ ও আবাসিক এলাকায় কেমিক্যালের দোকান ও গুদাম স্থাপনের ফলে অগ্নিদুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা অনেকটাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। জানা গেছে, জরুরী পানির প্রয়োজন মেটাতে ব্রিটিশ শাসনামলে নবাব পরিবারের পক্ষ থেকে পুরান ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় বেশকিছু ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করা হয়। কিন্তু যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তার অভাবে ওসব ফায়ার হাইড্রেন্ট এখন পুরোই বিলুপ্ত। অথচ উন্নত বিশ্বে আগুন নেভাতে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখে ফায়ার হাইড্রেন্ট। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও রয়েছে হাইড্রেন্টের ব্যাপক ব্যবহার। তারা আগুন নেভানোর পাশাপাশি জলাবদ্ধতা দূর করার জন্যও এই হাইড্রেন্ট ব্যবহার করে থাকে। ফায়ার হাইড্রেন্ট হচ্ছে রাস্তার ধারে স্থাপন করা এক ধরনের বিশেষ পানির কল। রাস্তা থেকে এই কলের উচ্চতা ২ থেকে ৩ ফুটের মতো। সব সময়ই এর মুখ বন্ধ থাকে। প্রয়োজনে তা খুলে ব্যবহার করা হয়। লাল বর্ণের বিশেষায়িত এই কলের নিচে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন পানির পাম্প সংযুক্ত থাকায় একটি ফায়ার হাইড্রেন্ট মিনিটে দেড় হাজার গ্যালন পানি সরবরাহ করতে পারে। একটি ফায়ার হাইড্রেন্টে ৩ থেকে ৪ মুখ থাকে। এসব মুখে থাকে প্লাস্টিকের ঢাকনা। ঢাকনা খুলে হাইড্রেন্টের মুখে হোসপাইপ লাগিয়ে খুব সহজেই ঘটনাস্থলে পানি নিতে পারে দমকলকর্মীরা। রাজধানী ঢাকার চেয়ে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে অগ্নিকান্ডের ঘটনা তুলনামূলক বেশি। অগ্নিকান্ডে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণও সেখানে অনেক বেশি। কিন্তু ঢাকার মতো এই বাণিজ্যিক শহরে নেই কোন ফায়ার হাইড্রেন্টের ব্যবস্থা। তবে গত মাসে চট্টগ্রাম ওয়াসার পক্ষ থেকে ৪১ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করা হয়েছে। এসব হাইড্রেন্টের সঙ্গে হোসপাইপ যুক্ত করে খুব সহজেই দমকলকর্মীরা অগ্নিকান্ডের স্থলে পানি পৌঁছতে পারবেন। ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, ঢাকার কোন এলাকায়ই আগুন নেভাতে গিয়ে দমকলকর্মীরা হাইড্রেন্টের দেখা পাননি। তবে ঢাকার বাইরে পুরনো কিছু জেলা শহরে এখনও কিছু কিছু ফায়ার হাইড্রেন্ট দেখা যায়, যা ব্রিটিশ শাসনামলে স্থাপিত একমুখী হাইড্রেন্ট। সেগুলোও জরুরী প্রয়োজনে ব্যবহার হয় না। বর্তমানে কিছু ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় এলাকাবাসীর বাড়তি পানির চাহিদা মেটাতে। মূলত হাইড্রেন্টের পাইপটি যুক্ত থাকে পানির প্রধান উৎসের সঙ্গে। এর মুখের দিকে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পাম্প থাকায় অল্পসময়ে অধিক মাত্রায় পানি সরবরাহ করতে পারে হাইড্রেন্টগুলো। এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদুল হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, রাজধানীসহ দেশের যে কোন শহরের যে কোন স্থানে আগুন নেভাতে বর্তমান পরিস্থিতিতে ফায়ার হাইড্রেন্ট অতি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হয়ে পড়েছে। এক সময় ঢাকায় সংখ্যক পরিমাণ পানির আঁধার ছিল। বর্তমানে রাজধানীতে আগুন লাগলেই বিকল্প পানির গাড়ি বা ড্রাম নিয়ে আগুন নেভাতে কাজ করি। শুধু পানির অভাবেই আগুন নেভানো অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ ছাড়াও অনিয়ম করে ভবন নির্মাণ, সরু রাস্তা ও ভয়াবহ যানজট সমস্যায়। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও পানির উৎস যেমন পুকুর ডোবা, জলাশয় ভয়াবহ মাত্রায় কমে যাওয়ায় হাইড্রেন্ট স্থাপন করা অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে। এর প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে সরকারের কাছে রাজধানীসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ শহরে অতি জরুরী ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপনের বিষয়ে চিঠি দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করি সরকার বিষয়টির প্রতি বিশেষ নজর দেবে।
×