ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

হারিয়ে গেছে আসল নাম

প্রকাশিত: ০৯:৫৪, ২৯ জুন ২০১৯

হারিয়ে গেছে আসল নাম

নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার ভালাইন গ্রাম। এ গ্রামটি এখন পাখা গ্রাম হিসেবে পরিচিত। এ গ্রামের প্রায় তিন শতাধিক দরিদ্র পরিবারের গৃহবধূরা হাত পাখা তৈরি করে সংসারে ফিরে এনেছেন সচ্ছলতা। সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছেন তারা। তাল পাতা দিয়ে তৈরি এ হাত পাখার চাহিদা বেশি থাকায় এখন রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে স্বল্পসুদে ঋণ এবং সরকারী সুযোগ-সুবিধা পেলে আরও এগিয়ে যাবেন বলে মনে করছেন এসব হাত পাখা তৈরির কারিগররা। জানা গেছে, মহাদেবপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে উত্তরগ্রাম ইউনিয়নে অবস্থিত এই ভালাইন গ্রাম। এ গ্রামে প্রায় ৬৫টি পরিবারের বসবাস। এ গ্রামের প্রায় তিন শতাধিক নারী-পুরুষ হাত পাখা তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত। দরিদ্র এসব পরিবার হাত পাখা তৈরিকেই এখন পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। প্রায় ২৫ বছর থেকে এ গ্রামে তালপাতা দিয়ে হাত পাখা তৈরি হয়ে আসছে। সময়ের পরিক্রমায় এ গ্রামটি এখন পাখা গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। গ্রীষ্মকালীন সময়ে বিশেষ করে বৈশাখ, জ্যেষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র ও চৈত্রসহ কয়েকটি মাস প্রচন্ড তাপদাহ থাকে। ফলে এ সময় ভ্যাপসা গরম হয়ে থাকে। এই সময় তাল পাতা দিয়ে তৈরি হাত পাখার চাহিদা বেড়ে যায়। প্রতি বছর এ গ্রাম থেকে ঢাকা, সৈয়দপুর, রাজশাহী, পঞ্চগড়, ফরিদপুর, দিনাজপুরসহ কয়েকটি জেলায় প্রায় পাঁচ লাখ পাখা সরবরাহ করা হয়ে থাকে। পাখা তৈরির উপকরণ তাল পাতা জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ এবং বিক্রির কাজ মূলত পুরুষরাই করে থাকেন। পাতা রোদে শুকিয়ে পানিতে ভেজানোর পর পরিষ্কার করে পাখার রূপ দেয়া হয়। এরপর রং মিশ্রিত বাঁশের কাঠি, সুঁই ও সুতা দিয়ে পাখা বাঁধার কাজটা করেন গৃহবধূরা। সংসারের কাজের পাশাপাশি তৈরি করা হয় এ তাল পাখা। পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা পাখা তৈরি করে বাবা-মাকে সহযোগিতা করে থাকে। তবে পাখা তৈরিতে যে পরিশ্রম ও খরচ সে তুলনায় দাম পান না কারিগররা। বিভিন্ন এনজিও (বেসরকারী সংস্থা) থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে কাজ করতে হয় কারিগরদের। তবে স্বল্প পরিশ্রমে টাকা বিনিয়োগ করে বেশি লাভে বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা। গৃহবধূ আনজুয়ারা বেগম বলেন, গত ২৫ বছর আগে ভালাইন গ্রামে বিয়ে হয়ে আসেন তিনি। এরপর দরিদ্র স্বামী মুক্তার হোসেনের কাছে এ পাখা তৈরির কাজ শিখেন। সেই থেকে এ পাখা তৈরি করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। আর এ পাখা তৈরি করে দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। দুই সন্তানকে পড়াশোনার খরচ বহন করছেন। এ পাখা তৈরি করেই সংসারে সচ্ছলতা ফিরেছে বলে জানান তিনি। গৃহবধূ ফাহিমা, খোরশেদা, কোহিনুরসহ কয়েকজন বলেন, পুরুষরা শুধু তাল পাতা নিয়ে এসে শুকানোর পর পরিষ্কার করে দেন। এরপর আমরা সাংসারিক কাজের পাশাপাশি পাখাকে সুঁই-সুতা দিয়ে সেলাই ও সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ করি। প্রতিদিন আমরা ৫০-১শ’ টা পর্যন্ত পাখা তৈরি করতে পারি। পাখার কারিগর সাইদুর রহমান বলেন, জেলার সাপাহার ও পোরশা উপজেলা এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের আড্ডা ও রহনপুর থেকে তাল পাতা সংগ্রহ করা হয়। প্রতিটি তাল পাতার দাম পড়ে ৫টাকা। এরসঙ্গে রঙিন বাঁশের কাঠি ও সুতা খরচ হয় দেড় টাকা। প্রতিটি পাখা তৈরিতে খরচ পড়ে সাড়ে ৬ টাকা করে। সেখানে আমরা পাইকারি বিক্রি করি প্রতি পিস ১০ থেকে ১২ টাকা। ঢাকা ও সৈয়দপুরসহ কয়েকটি জেলায় নিজে গিয়ে পাইকারি দিয়ে আসেন। কিন্তু ব্যবসায়ীরা প্রতিটি পাখা বিক্রি করেন ২৫ থেকে ৩০ টাকা করে। পাখা তৈরিতে যে পরিশ্রম হয়, সে তুলনায় আমরা দাম পাই না। আরেক কারিগর আনোয়ার হোসেন বলেন, এ গ্রামের তিন শতাধিক মানুষ পাখা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। বিভিন্ন এনজিও (বেসরকারী সংস্থা) থেকে উচ্চসুদে ঋণ নিয়ে পাখা তৈরি করতে হয়। ফলে লাভের একটি অংশ চলে যায় এনজিওতে। সরকার যদি স্বল্পসুদে আমাদের ঋণের ব্যবস্থা করে দিত তাহলে কিছুটা লাভ থাকত। মহাদেবপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোবারক হোসেন বলেন, পাখা তৈরির কারিগররা দেশের গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি নিজেদের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন করে চলেছেন। আর্থিক কারণে যেন এ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এজন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা প্রদান করা হবে বলে আশ্বাস দেন তিনি। -বিশ্বজিৎ মনি, নওগাঁ থেকে
×