ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

২৯ জুন, ১৯৭১

মার্কিন সাহায্য অব্যাহত থাকবে!

প্রকাশিত: ০৯:৫০, ২৯ জুন ২০১৯

 মার্কিন সাহায্য অব্যাহত থাকবে!

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ ১৯৭১ সালের ২৯ জুন দিনটি ছিল মঙ্গলবার। এই দিন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঘোষিত আওয়ামী লীগ দলীয় জাতীয় পরিষদ সদস্যদের আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, অখন্ড পাকিস্তান এখন মৃত এবং ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে ঠাঁই নিয়েছে। বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খান সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি। স্বঘোষিত একনায়ক ইয়াহিয়ার বাংলাদেশ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার নেই। ইয়াহিয়া নয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারই বাংলাদেশের জনগণের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি। আমরাই বৈধ রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ।... জনগণ আওয়ামী লীগের পেছনে রয়েছে। মুক্তাঞ্চল বাংলাদেশ সরকারের কেবল পূর্ণ নিয়ন্ত্রণেই নেই, সেখানে বেসামরিক প্রশাসন স্বাভাবিক কাজকর্ম পরিচালনা করছে। এদিন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে কোন আপোস হতে পারে না। বাংলাদেশের জনগণ রাজনৈতিক মীমাংসার নামে কোন আপোস করবে না। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করছি এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই আমাদের স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনব। বিজয় আমাদের হবেই। এদিন কালিয়াকৈর থানার সূত্রাপুর অবস্থানকারী পাকবাহিনীর ওপর মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার গফুর, ঘাটাইলের খোরশেদ আলম, মির্জাপুরের পুলক সরকার ও মনীন্দ্র ঘোষের দল দু’তিন ভাগ হয়ে ঝটিকা আক্রমণ চালায়। এতে মুক্তিযোদ্ধারা সূত্রাপুর এলাকা মুক্ত করে। পাক সেনারা শিবালয় উপজেলার মালুচী বাজারসহ আশপাশের গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে এবং ঘোনাপাড়া আঃ মজিদ খান সাহেবের বাড়ি সম্পূর্ণরূপে জ্বালিয়ে দেয় ও বহু লোককে হত্যা করে। এই দিন দ্য স্টেটসম্যান চারজন ব্রিটিশ এমপির বরাত দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে, সোমবার দুপুরের প্লেনে কলকাতা থেকে ৪ জন ব্রিটিশ এমপি ঢাকায় অবতরণ করেন। তাদের চারজনের পূর্ববাংলা পর্যবেক্ষণের রিপোর্ট থেকে এই উপসংহারে পৌঁছানো যায় যে, সেখানে আতঙ্কের পরিবেশ বিরাজ করছে। পূর্ব বাংলায় সেনাশাসন চলছে, মানুষ এখনও একটি জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে, বুলেটে আহত হয়ে হাত কেটে ফেলা হয়েছে, এমন মানুষেরও দেখা পাওয়া গেছে সেখানে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকা ভারি গোলাগুলি বর্ষণের সাক্ষ্য বহন করছে। সব মিলিয়ে পূর্ব বাংলার চলমান পরিস্থিতিকে কোনভাবেই স্বাভাবিক বলা যায় না। এই চারজন ঢাকায় একটি স্পেশাল আরএএফ প্লেনে এ অবতরণ করেন। এই চারজন হলেন, মি. আরথার বটমলি, মি. রেগ প্রেন্টিস, মি. জেমস রামসডেন, মি. টোবি জেসেল। ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলন এ মি. টোবি জেসেল বলেন যে তার কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে যে, পূর্ববাংলার হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর চরম নিপীড়ন ও নির্যাতন চালানো হয়েছে। একই সঙ্গে তিনি বলেন, কোন দেশের পক্ষে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। কনজারভেটিভ পার্টির এই এমপি আরও বলেন, একের পর এক গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া এবং স্থানীয় লোকদের অন্তর্ধান হয়ে যাওয়া আরও বেশি ভয়ের কারণ। পাকিস্তানী আর্মিদের অবশ্যই অবাধে এবং বিধিবহির্ভূতভাবে গুলি চালানো বন্ধ করতে হবে। মি. রেগ প্রেন্টিস জানান, পূর্ব বাংলার শরণার্থীদের এখনই ফিরে যাওয়া সমীচীন হবে বলে তিনি মনে করেন না, সেখানে এখনও ত্রাসের রাজত্ব বিরাজ করছে। পূর্ববাংলায় চারদিন অবস্থানকারী এই দলটি চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, ঢাকা, ময়মনসিংহ ইত্যাদি জেলাসমূহ প্লেন এবং হেলিকপ্টারযোগে ঘুরে দেখেন। যাত্রার সময় বিধ্বস্ত মানুষজন, বাড়িঘর এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রাম দেখতে পান। এ সময় মি. রামসডেনকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে- তিনি আদৌ মনে করেন কি-না পূর্ববাংলার এই পরিস্থিতি রাজনৈতিকভাবে নিরসন করা সম্ভব? উত্তরে তিনি বলেন, যে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে তা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া, একটি রাজনৈতিক সমাধানের চেয়ে বেশি জরুরী। এই দিন নিউইয়র্ক টাইমস ‘অন্যান্য জাতি কর্তৃক আহ্বান জানানো সত্ত্বেও মার্কিন সরকার পাকিস্তানে সাহায্যদান অব্যাহত রাখবে’ শিরোনামে বিশেষ বার্তা প্রকাশ করে, নিক্সন প্রশাসন আজ পুনর্ব্যক্ত করেন যে, বিদেশী সহায়তা বন্ধে আন্তর্জাতিক চাপ থাকা সত্ত্বেও যতদিন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় না পৌঁছাবে ততদিন পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান করা হবে। এগারোটি জাতি নিয়ে গঠিত পাকিস্তান সাহায্য সংস্থার অধিকাংশই মনে করেন বছরে ৫০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা বন্ধ করলে গণহত্যায় দুই লাখ পূর্ব পাকিস্তানীর মৃত্যু হয় এবং প্রায় ছয় মিলিয়ন উদ্বাস্তু ভারতে পালিয়ে যায় সেই সঙ্কটের একটা রাজনৈতিক সুরাহা হবে। বিশ্বব্যাংকসহ সংস্থার অন্য সদস্যদের মধ্যে ব্রিটেন, কানাডা এবং বেলজিয়াম পরবর্তী সাহায্যের বিরুদ্ধে সুপারিশ করেছে। বিশ্বব্যাংকের পাকিস্তান সফরের প্রতিবেদন পর্যালোচনার জন্য গত সোমবারে প্যারিসে সংস্থার এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, সেখানেই তাদের অবস্থান পরিষ্কার হয়। গত বৃহস্পতিবার ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট এস ম্যাকনামারাকে এই নীতি অনুমোদন করতে বলা হয়েছিল। একটি রাজনৈতিক চাপের হাতিয়ার হিসেবে পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধের নীতিতে যুক্তরাষ্ট্র আপত্তি জানিয়েছে। পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্র সচিব ক্রিস্টোফার ভ্যান হোলেন বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্য হলো স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ‘রাজনৈতিক সমঝোতা’ তৈরি করা এবং শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন করার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করা। এছাড়া মি. ভ্যান হোলেন ঘোষণা করেন যে, পাকিস্তানে সামরিক সরঞ্জাম চালানে একটি পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা স্থাপনের ব্যাপারে প্রশাসনের কোন পরিকল্পনা ছিল না। ম্যাসাচুসেটস ডেমোক্র্যাট সিনেটর এ্যাডওয়ার্ড এম কেনেডির নেতৃত্বে তিনি উপকমিটিকে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধবিগ্রহ শুরুর পর গত ২৪ মার্চ প্রশাসন তার চার বছর মেয়াদী ঋণ ও নগদ বিক্রয় কর্মসূচীর আওতাধীন সামরিক সরঞ্জামের রফতানি লাইসেন্স স্থগিত করেছিল, সেই তারিখের আগে দেয়া অনুমতি প্রত্যাহার করা হবে না। পরবর্তী সময়ে একটি সংশোধনী জারি করে জানানো হয়, মার্চের পূর্বে পাকিস্তান কর্তৃক ক্রয়কৃত সরঞ্জামের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি। কর্মকর্তারা এক প্রতিবেদনে নিশ্চিত করেন, নিউইয়র্কে থাকা পাকিস্তানী জাহাজ কাপ্তাই যুদ্ধোপকরণ নিয়ন্ত্রণ তালিকায় থাকা সরঞ্জাম নিয়ে ২ জুলাই করাচীর উদ্দেশে যাত্রা করবে এবং অন্য চার-পাঁচটা জাহাজ অনুরূপ পণ্য নিয়ে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি রওনা হবে। শেষ বিকেলের দিকে এই তথ্য সিনেটর কেনেডিকে নতুন চালানের প্রতিবাদে পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ জে সিস্কোকে টেলিফোন করেন। আমি প্রশাসনকে পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানো নীতি বন্ধ করতে বলেছি। জনাব ভন হোলেন পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান চালিয়ে যাওয়া এবং সামরিক ক্ষেত্রে রফতানি লাইসেন্সের বৈধতা বজায় রাখার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন। তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে ‘প্রাণঘাতী নয় এমন’ সামরিক জিনিস বিক্রি করা অব্যাহত রাখছে যাতে করে প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান কমিউনিস্ট চীনের মতো অন্য কোন উৎসের দিকে ফিরে না তাকায়। তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন, চীন এ যাবতকাল ধরে পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ করে আসছিল। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×