ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

কোটি টাকা আত্মসাত

প্রকাশিত: ০৯:৩৩, ২৯ জুন ২০১৯

কোটি টাকা আত্মসাত

কৃষ্ণ ভৌমিক, পাবনা ॥ পাবনা মানসিক হাসপাতালে আউটসোর্সিং কর্মচারীদের ভাতা জালিয়াতির মাধ্যমে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। হাসপাতালটিতে আর্থিক বছর অনুযায়ী জুলাই থেকে পরবর্তী জুন পর্যন্ত অস্থায়ী কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮০ জন (রাজস্ব ) এবং ২৫ জন উন্নয়নখাতে কর্মী কাগজকলমে নিয়োগ দেয়া হয়। এদের জনপ্রতি সরকারী মাসিক ভাতা ১৪ হাজার ৪৫০ টাকা হলেও অভিনব উপায়ে ৬ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা সুপারিশ অনুসারে দেয়া হয়। অস্থায়ী এ কর্মচারীদের প্রতিমাসে ২টি চেক স্বাক্ষর করে নেয়া হয়। একটি চেকে তাদের প্রদেয় ৬ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা এবং অন্য চেকে ১৪ হাজার ৪৫০ টাকার বাদ বাকি টাকা ঠিকাদার তুলে নেয় । প্রথমে ডাচ বাংলা ব্যাংকের মাধ্যমে কর্মীদের ভাতা দেয়া হলেও ব্যাংক কর্মকর্তারা জালিয়াতি ধরে তাদের সুনামের প্রশ্নে কর্মচারীদের হিসাব পরিচালনায় আপত্তি জানায়। তারপর যমুনা ব্যাংকের পাবনা শাখায় কর্মীদের হিসাব খুলে এভাবে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। আর কাগজ-কলমে আউটসোর্সিং ১০৫ জন কর্মীর মধ্যে ১৭ জনের কোন অস্তিত্ব নেই। শুধু ভুয়া এ ১৭ কর্মীর ভাতা বাবদ ২৯ লাখ ৪৭ হাজার ৮০০ টাকা ভাগ বণ্টন করে নেয়া হয়েছে। আউটসোর্সিং কর্মীদের এ টাকা ঠিকাদার, হাসপাতাল পরিচালক ডাঃ তন্ময় প্রকাশ বিশ্বাস এবং ওয়ার্ডমাস্টার আঃ বারি সিন্ডিকেট ভাগাভাগি করেছে বলে আউটসোর্সিং কর্মচারীদের পক্ষে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সচিবের কাছে অভিযোগ করা হয়েছে। কর্মচারীদের বছরে ২টি বোনাস দেয়ার কথা থাকলেও তা আগের বছরগুলোতে দেয়া হয়নি। গত ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষে মুসলিম কর্মচারীদের বোনাস দেয়া হলেও তা পুরাপুরি নয়। হিন্দু কর্মচারীদের আর্থিক বছর শেষ হলেও তাদের বোনাস দেয়া হচ্ছে না। ঠিকাদারকে হিন্দু কর্মচারীরা বোনাসের কথা জিজ্ঞাসা করলে অক্টোবরে দুর্গা পূজার সময় তা দেয়া হবে বলে জানানো হয়। হিন্দু কর্মচারীরা প্রশ্ন তুলেছেন তাদের চাকরির মেয়াদ যেখানে জুনে শেষ সেখানে অক্টোবরে ঠিকাদার কিভাবে বোনাস দিবে। তার অর্থ হচ্ছে তাদের বোনাসের টাকাও হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে বলে কর্মচারীরা অভিযোগে উল্লেখ করেছেন। হাসপাতালের একটি সূত্র জানিয়েছে ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষে ১০৫ জন কর্মীর বোনাস ঠিকাদার উত্তোলন করেছে। অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়েছে হাসপাতাল পরিচালকের ঘনিষ্ঠ একজন অস্থায়ী কর্মচারী হাসপাতাল চত্বরে ২৫-৩০টি কুকুর-বিড়াল পোষেন। প্রতিদিন হাসপাতালের কিচেন থেকে ৩০ জনের খাবার নিয়ে এসব কুকুর-বিড়ালকে খাওয়াতে হয়। হাসপাতাল চত্বরে এ কুকুর-বিড়াল যেখানে সেখানে প্র¯্রাব-পায়খানা করায় অভ্যন্তরীণ পরিবেশ দূষিত হয়ে উঠলেও কারও প্রতিবাদ করার সাহস নেই। শুধু তাই নয় যেখানে সেখানে বিড়াল-কুকুর বিচরণের কারণে রোগীদের খাবারের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এলাকার একাধিক সূত্র দাবি করেছে হাসপাতাল পরিচালক তার নিজের দুর্নীতি সামাল দিতে শতাধিক বয়সী ওই কর্মীকে নিয়োগ দেন। তার দাপটে কর্মীদের তটস্থ থাকতে হয় যা নিয়ে হাসপাতালে ব্যাপক অসন্তোষ বিরাজ করছে। এদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছওে আউটসোর্সিং কর্মী নিয়োগে ৩০ হাজার টাকা জামানতের নাম করে ঘুষ দাবি করা হয়েছে। সরকারী এ ধরনের জামানতের নিয়ম না থাকায় কর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। অন্যদিকে হাসপাতালের রোগীদের খাদ্যসামগ্রী ও স্টেশনারি ক্রয়ের টেন্ডারে বাজার দরের সঙ্গে সামঞ্জস্য না রেখে দাম ধরায় সরকারের বছরে ১ কোটির ওপর অতিরিক্ত টাকা গচ্ছা দিতে হচ্ছে যা ঠিকাদার ও পরিচালকের পকেটে ঢুকে যাচ্ছে সংশ্লিষ্টরা দাবি করেছে। হাসপাতালের খাদ্যসামগ্রী ও বিভিন্ন পণ্য সরবরাহের টেন্ডার আহ্বানের পূর্বে বাজার দর যাচাই কমিটি করা হয়। এ কমিটি বাজার দরের রিপোর্ট জমা দেয়। বাজার-যাচাই কমিটির দরের রিপোর্টকে উপেক্ষা করে হাসপাতাল পরিচালক জেলা মার্কেটিং কর্মকর্তার দরকেই বেছে নেয় যা বাজার মূল্যের সঙ্গে আকাশ-পাতাল ফারাক রয়েছে। এ দরে প্রতিকেজি রুই কাতলার দাম ধরা হয়েছে ৫০০-৫৫০ টাকা। হাসপাতালে যে রুই কাতলা সরবরাহ করা হয় তার দাম বাজারে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। পাঙ্গাশ মাছের দর ধরা হয়েছে ৩৯০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা। বাজারে এ পাঙ্গাশের দাম লেজ মাথা নাড়িভুঁড়ি ছাড়া সর্বোচ্চ ২০০ টাকা পড়ার কথা। বাজারের ৫০ টাকার চিনি ধরা হয়েছে ৭৫- ৮০ টাকা। এককেজি খাসির মাংসের দাম ধরা হয়েছে ৮৭৫ টাকা। ব্রয়লার মুরগির কেজি ধরা হয়েছে ৪২০ টাকা। বাজারে ব্রয়লারের দাম নাড়িভুঁড়ি বাদে সর্বোচ্চ ২০০ টাকা। বাজারে যেখানে ৮০-৯০ টাকায় প্রতিকেজি ভাল মসুর ডাল পাওয়া যায় সেখানে দাম ধরা হয়েছে ১৫০ টাকা। ডিম প্রতি পিস ১৩ টাকা। ১ কেজি সবরি কলার দাম ধরা হয়েছে ১২০ টাকা যেখানে বাজার দর ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজি। ১ কেজি পাউরুটির দাম ধরা হয়েছে ১৫০ টাকা। প্রতি কেজি চিড়া ১০০ টাকা বাজারে যার সর্বোচ্চ মূল্য ৫৫ টাকা। খাবারসামগ্রী থেকে স্টেশনারি প্রত্যেকটি আইটেমই বাজার দরের চেয়ে অনেক বেশি ধরা হয়েছে যা অবিশ^াস্য। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে জেলা মার্কেটিং কর্মকর্তা প্রথমে যে বাজার দর দেন তা ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি রহস্যজনক কারণে পূর্বের বাজার দর পরিবর্তন করে পুনরায় দরের রিপোর্ট দেন যা বাজারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অভিযোগ উঠেছে সরকারের অতিরিক্ত কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে হাসপাতাল সিন্ডিকেট সমঝোতার মাধ্যমে জেলা মার্কেটিং কর্মকর্তার এ দর অনুসারে ঠিকাদারের ওয়ার্ক অর্ডার দেয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। জেলা মার্কেটিং অফিসারের সঙ্গে বারবার চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে মানসিক হাসপাতাল পরিচালক ডাঃ তন্ময় প্রকাশ বিশ^াসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আউটসোর্সিং কর্মীদের ভাতার টাকা কম দেয়ার ব্যাপার তার দেখার কিছু নেই, এটি ঠিকাদারের ব্যাপার। কর্মীদের বোনাস না দেয়ার বিষয়ে তিনি অবশ্য স্ববিরোধী বক্তব্য দিয়ে বলেন,যার যা প্রাপ্য তা তাদের দিতে হবে। তা না দিলে বিল দেয়া হবে না। যদিও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে কর্মীদের সব বিলই পাস করা হয়েছে। ১৭ জন ভুয়া কর্মচারীর নামে ভাতা উত্তোলনের কথা তিনি অস্বীকার করেন। তিনি জেলা মার্কেটিং কর্মকর্তার দরকে সঠিক বলে দাবি করেন। এ দরে পণ্য সামগ্রী কেনা হলে সরকারের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হবে এ প্রশ্নে করা হলে তিনি সদুত্তর দিতে পারেননি। হাসপাতাল চত্বরের কুকুর-বিড়াল পোষার বিষয়ে তিনি নিশ্চুপ থাকেন। মানসিক হাসপাতালে নিরপেক্ষ তদন্ত করা হলে শুধু ওষুধ ও যন্ত্রপাতি ক্রয় বাবদই কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির ঘটনা উদঘাটিত হবে বলে সংশ্লিষ্ট এক সূত্র দাবি করেছে।
×