ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ভ্যাট কর্মকর্তাদের জ্বালাতনের সংস্কৃতি বন্ধের তাগিদ খোদ বাণিজ্যমন্ত্রীর

হয়রানিমুক্ত ব্যবসার পরিবেশ চান ব্যবসায়ীরা

প্রকাশিত: ১০:৩৭, ২৮ জুন ২০১৯

  হয়রানিমুক্ত ব্যবসার পরিবেশ চান ব্যবসায়ীরা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ব্যবসায়ীরা হয়রানিমুক্ত ব্যবসার পরিবেশ চেয়েছেন। বৃহস্পতিবার প্রস্তাবিত বাজেটের পর্যালোচনা করতে গিয়ে তারা বলেন, ‘আমরা হয়রানিমুক্ত ব্যবসা করতে চাই। হয়রানির কারণে সৎ ব্যবসায়ীরা ব্যবসা-বাণিজ্যে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ছেন।’ ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) বৃহস্পতিবার স্থানীয় একটি অভিজাত হোটেলে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর এক পর্যালোচনা সভার আয়োজন করে। এতে দেশের বিভিন্ন চেম্বার ও এ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ আলোচনা করেন। আলোচনায় ভ্যাট আইনের প্রভাব, কর হ্রাসের দাবি ও ব্যবসায়ীদের হয়রানির বিষয়টি বেশ জোরালো হয়ে উঠে আসে। আলোচনার সূত্রপাত করতে গিয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, বিভিন্ন চেম্বার ও এ্যাসোসিয়েশন থেকে আমরা অবহিত হচ্ছি যে, মাঠ পর্যায়ে কর কর্মকর্তারা নানান কৌশল-অপকৌশলে ব্যবসায়ীদের হয়রানির চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। সুতরাং সব ধরনের হয়রানি বন্ধ করতে হবে। ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত কোন পদক্ষেপ গ্রহণের আগে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট চেম্বার বা এ্যাসোসিয়েশন এবং এফবিসিসিআইকে অবহিত করতে হবে। তার বক্তব্যের সূত্র ধরে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন হয়রানিমুক্ত ব্যবসার সুযোগ দাবি করে বলেন, ‘হয়রানি হলে ব্যবসায়ীরা অনেক কষ্ট পায়। ব্যবসা করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তাই শব্দ বসিয়ে আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে ব্যবসায়ীদের হয়রানি বন্ধ করতে হবে।’ তিনি বলেন, র‌্যাব-মিলিটারি দিয়ে ট্যাক্স আদায় করা যায় না। এটা জনগণের সরকার। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ট্যাক্স আদায় করতে হবে। মোটাদাগে যেসব সমস্যা উঠে এসেছে তা অর্থবিল পাসের আগেই সমাধান করতে হবে। বন্ডের অপব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কিছুসংখ্যক অসৎ ব্যবসায়ী ও ট্যাক্স কর্মকর্তার যোগসাজশে বন্ডের অপব্যবহার হচ্ছে। এজন্য ঢালাও ব্যবসায়ীদের দায়ী করা ঠিক নয়। তিনি টাকার অবমূল্যায়নের প্রস্তাবকে সমর্থন করে বলেন, টাকার অবমূল্যায়ন হলে প্রণোদনার দরকার হতো না। এর আগে অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদী সাত্তার টাকার অবমূল্যায়ন ইস্যুটি সামনে নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশী টাকার প্রায় ৩৫ শতাংশ মান কমে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে ডলার ছেড়ে তা ঠেকিয়ে রেখেছে। ৩ শতাংশ অবমূল্যায়ন করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংককে ২৫০ কোটি ডলার বাজারে বিক্রি করতে হবে। এতে রিজার্ভ বাড়বে। রফতানি আয় বৃদ্ধি পাবে। ফলে এ খাতে ভর্তুকি প্রদানের প্রয়োজন হবে না। ব্যাংকের তারল্য সঙ্কটও দূর হবে। এতে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমদানির ক্ষেত্রে কাস্টমস ডিউটি গত কয়েক বছর ধরেই ২৫ শতাংশে স্থির রয়েছে। এই শুল্ক এক শতাংশ কমিয়ে দিলে আমদানি খাতে ব্যয় বৃদ্ধির প্রভাব কমে যাবে। প্রবৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমানে বাণিজ্যভিত্তিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এটাকে রফতানিমুখী প্রবৃদ্ধিতে নিয়ে যেতে হবে। এজন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ভ্যাট কর্মকর্তাদের জ্বালাতনের সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। তারা এমন সব শব্দ ব্যবহার করে ফলে ব্যবসায়ীরা হয়রানির শিকার হয়। তিনি ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, বাজেটে কোন কারণে কোন ট্যাক্স কমানো না হলে তা নিয়ে হতাশ হবেন না। বাজেটের পর আমরা বসে ওগুলোর বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করব। মন্ত্রী বলেন, অর্থনৈতিক জোনগুলো যত দ্রুত সম্ভব প্রস্তুত করতে হবে। বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থান বাড়বে না। আর কর্মসংস্থানের জন্য কর সুবিধা থাকা দরকার। যে বেশি কর্মসংস্থান করবেন তার জন্য ট্যাক্স সুবিধা থাকা উচিত। তাহলে ব্যবসায়ীরা বেশি বেশি কর্মসংস্থানে উৎসাহিত হবেন। এ ছাড়া বাণিজ্যমন্ত্রী ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ রাখা হলেও বিনিয়োগের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে করের পরিমাণ নির্ধারণের প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, বিনিয়োগের মাধ্যমে ‘কালো টাকা সাদা’ করার ক্ষেত্রে আমার সাজেশন, ইপিজেডগুলোতে বেশি টাকা বিনিয়োগ করে বেশি কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারলে আরও কম ট্যাক্সে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া যেতে পারে। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, কালো টাকা নিয়ে আমার একটা সাজেশন আছে। সেটা হলো, বিনিয়োগের জন্য ১০ শতাংশ কর দিয়ে অর্থনৈতিক জোনগুলোতে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়েছে। এই সুযোগ আরও প্রসারিত হতে পারে। যে কোম্পানি এক শ’ কর্মীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে আর যে কোম্পানি ৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান করেছে, দু’জনের করের হার এক হওয়া উচিত না। মন্ত্রী প্রস্তাব রেখে বলেন, আমার মতে, যে প্রতিষ্ঠান বেশি লোকের কর্মসংস্থান করেছে তার ক্ষেত্রে করের হার আরও কমানো যেতে পারে। কারণ যিনি বেশি মানুষের কর্মসংস্থান করছেন, আর যিনি কম লোকের কর্মসংস্থান করছেন, তাদের দু’জনের জন্য সুযোগ এক হতে পারে না। টিপু মুনশি বলেন, সবসময় শুনি, কালো টাকা সাদা করা হয়েছে। আসলে আমরা এই টাকাকে কালো না বলে বলি অপ্রদর্শিত টাকাকে করের আওতায় নিয়ে আসা। অর্থাৎ যে টাকা এখনও দেখানো হয়নি, সেই অপ্রদর্শিত টাকাকে বিনিয়োগের একটা সুযোগ দেয়া। কালো কথাটা সবসময় ভাল লাগে না। তাই এটাকে কালো টাকা না বলে অপ্রদর্শিত টাকা বলি। তিনি আরও বলেন, আমরা চাই দেশের টাকা যেন দেশের বাইরে না যায়। যেভাবেই হোক টাকা দেশে থাকুক। এই সুযোগ দেয়ার পর যতটুকু টাকা বিনিয়োগ হবে, ততটুকুই লাভ। কম কর দিয়ে হলেও যদি কিছু টাকা মূল স্রোতে আসে, তাও ভাল। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ব্যবসায়ীদের যেন কোন ধরনের হয়রানির শিকার হতে না হয়, আমাদের সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পোশাক খাতে প্রণোদনার ওপর কর আরোপ করা হলে ঠিক হবে না। এটা হবে দাওয়াত দিয়ে কাঁটা চামচ দিয়ে স্যুপ খেতে দেয়ার মতো। আয়কর অফিসের জনবলের কারণে যেন ব্যবসায়ীদের হয়রানির শিকার হতে না হয়, সেদিকেও নজর দিতে হবে। সরকারের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ব্যবসার খরচ কমাতে দক্ষতা বাড়াতে হবে। প্রতিযোগী না হলে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা যাবে না। তিনি বলেন, এখন আমাদের বিনিয়োগের দিকে নজর দিতে হবে। বিনিয়োগ কি করে বাড়ানো যায় তা নিয়ে কাজ করতে হবে। আমদানির বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে বিনিয়োগমুখী অর্থনীতি করতে হবে। যাতে দেশ অধিক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যায়। এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিমের সভাপতিত্বে আরও বক্তব্য রাখেন এফবিসিসিআইর সহসভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, ব্যাংকার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান, বিজিএমইএস সভাপতি রুবানা হক, প্লাস্টিক ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জসিম উদ্দিন, বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন, ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কাজী বেলায়েত হোসেন প্রমুখ।
×