ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভূমি সমস্যায় পাহাড়ী জনপদের পরিস্থিতি অশান্ত

প্রকাশিত: ০৯:৪৩, ২৮ জুন ২০১৯

  ভূমি সমস্যায় পাহাড়ী জনপদের পরিস্থিতি অশান্ত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ী জনগণের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা ভূমি সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান না হওয়ায় সেখানে বসবাসকারী বাঙালী এবং উপজাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রীতি ও সহবস্থান প্রতিষ্ঠা কঠিন হয়ে পড়ছে। এ কারণে শান্তিচুক্তির ২১ বছর পেরিয়ে গেলেও পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। বসবাসকারী পাহাড়ী-বাঙালীর মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ফাটল দেখা দিচ্ছে। এছাড়াও পাহাড়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী কর্মকা- এবং চাঁদাবাজির ঘটনায় মানুষ আতঙ্কে রয়েছে। এই পরিস্থিতি উন্নয়নে সেখানে শান্তি চুক্তির আলোকে জরুরী ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে আয়োজিত পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক উন্নয়ন সম্প্রীতি ও সহবস্থানের গুরুত্ব শীর্ষক এক আলোচনা সভায় পাহাড়ের পরিস্থিতি তুলে ধরে এই আহ্বান জানানো হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সহিংসতা দূর করতে হলে সংবিধানের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন এবং স্থানীয় সব শ্রেণীর জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আর্থ- সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। সবাই উদার মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে আসলে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তির সুবাতাস ফিরে আসবে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং বলেন, পার্বত্য শান্তি চুক্তির আলোকে পার্বত্য এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় সরকার কাজ করে যাচ্ছে। পাহাড়ের জনগণের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং জানমাল রক্ষায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কোন চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীদের প্রশয় দেয়া হবে না। পাহাড়ে যারা বসবাস করে সবাই শান্তির পক্ষে। কিছু গ্রুপ রয়েছে যারা সন্ত্রাস চাঁদাবাজির মাধ্যমে পরিস্থিতি অশান্ত করার চেষ্টা করছে। তারা মনে করছে কিছু অস্ত্র হাতে ঘুরে বেড়ালে পাহাড়ে সবাই তাদের সমর্থক হয়ে যাবে। এটা ভাবার কোন কারণ নেই। বঙ্গবন্ধুই প্রথম পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর পাহাড়ে উন্নয়ন অগ্রগতি থেমে যায়। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ে আবার শান্তি প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছেন। তিনি পাহাড়ে উন্নয়নে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছেন। এখন সবার আর্থিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। পাহাড়জুড়ে উন্নয়নের ছোয়া লেগেছে। শিক্ষার হার বাড়ছে। এই অবস্থায় পাহাড়ে এখনও যারা অশান্তির কথা ভাবছেন সেখান থেকে তাদের এখনি সরে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ভূমি সমস্যা যেটা রয়েছে সেটাই নিরসনে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে ভূমি কমিশন আইন চূড়ান্ত হওয়ার পথে। এটি চূড়ান্ত হলে ভূমি সমস্যা নিরসনে কাজ শুরু করা হবে। যারা পাহাড়ে শান্তি চান তাদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থাবোধও তৈরি করতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে চুক্তির কোন ধারা ধীর গতিতে বাস্তবায়ন হলেও এ নিয়ে হতাশ হওয়ার কোন কারণ নেই। আলোচনার পথ খোলা রয়েছে। সন্ত্রাস চাঁদাবাজি করে শান্তি আসবে না। চাঁদা নিয়ে কোনদিন মানুষের উন্নতি ও কল্যাণ সম্ভব নয়। যারা এ কাজ করে জনগণ তাদের বন্ধু হতে পারে না। কারণ পাহাড়ের মানুষ অধিকাংশ শান্তির পক্ষে, উন্নয়নের পক্ষে। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সমন্বয়ের কিছুটা ঘাটতি আছে। তবে চুক্তি বাস্তবায়নে আবার গতি ফিরেছে। সবক্ষেত্রে নেতিবাচক ধারনা নিয়ে থাকলে সামনে অগ্রসর হওয়া যাবে না। আমরা একত্রে থাকলে সামনে এগিয়ে যাবই। চুক্তি বাস্তবায়নে দেরি হলেই যে সহিংসতা ঘটাতে হবে, চাঁদাবাজি করতে হবে তা চুক্তির কোথাও উল্লেখ নেই। চাঁদার কোটি কোটি টাকা কোথায় যায়? শান্তি চুক্তির পর সব অস্ত্র জমা দেয়া হয়েছে। তাহলে পাহাড়ে এত অস্ত্রের ঝনঝনানি কেন? অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মোঃ মেসবাহুল ইসলাম বলেন, ভূমি সমস্যা সমাধানে ২০১৬ সালে কমিশন গঠন করা হয়েছিল। এটি সংশোধন করে চূড়ান্ত হওয়ার পথে। চূড়ান্ত হলেই ভূমি সমস্যা সমাধানে সরকার কাজ শুরু করবে। শান্তি চুক্তির ৪৮ ধারা ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ১৫টি ধারা বাস্তবায়নাধীন। সরকার চেষ্টা করছে শান্তিচুক্তির পুরো বাস্তবায়নের। তবে তিনি বলেন, পাহাড়ে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে এখনও কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। এমডিজি এবং এসডিজি বাস্তবায়নে পাহাড়ে এখনও সমস্যা রয়েছে। সরকার পাহাড়কে অন্তর্ভুক্ত করে ডেল্টাপ্ল্যান করেছে। এগুলোর আলোকে পাহাড়ের উন্নয়নের বৃহৎ পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে পাহাড়ে বসবাসকারী সবার সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। পাহাড়ে অনেক এলাকায় গ্রিড লাইনের মাধ্যমে বিদ্যুত পৌঁছানোয় এখনও সমস্যা রয়েছে। সেসব এলাকায় সৌর বিদ্যুত পৌঁছে দেয়ার কাজ করছে সরকার। ইতোমধ্যে ১০ হাজার পরিবারে সৌরবিদ্যুত দেয়া হয়েছে। এর বাইরে ২৭শ’ প্রতিষ্ঠানে সৌরবিদ্যুত দেয়া হয়েছে। অফুরন্ত সম্ভাবনার পাহাড়ে পর্যটন শিল্প বিকাশে বিভিন্ন ধরনের সরকারী উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন তিনি। অনুষ্ঠানে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও কূটনীতিক সিএম শফি সামি তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, পার্বত্য শান্তি চুক্তি সম্প্রীতি ও সহবস্থানের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এখন স্থায়ী শান্তির জন্য সরকারকে রাজনৈতিক সদিচ্ছার বাস্তবায়ন করতে হবে। সামাজিক শান্তি ও সংহতি না থাকলে কোন অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভব নয়। উন্নয়নের সুফল পেতে হলে পাহাড়ের সব জনগোষ্ঠীকে সহাবস্থানে আসতে হবে। শান্তি চুক্তির সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে- সেখানে রক্তক্ষয়ী সহিংসতার অবসান হয়েছে, সন্ত্রাসী হামলা বন্ধ হয়েছে, যারা সহিংসতার পথে গিয়েছিল তাদের প্রত্যাবাসন ও পুর্নবাসন করা হয়েছে। তবে দুইযুগেরও বেশি সময় পার হলেও চুক্তির বাস্তবায়ন আশানুরূপ না হওয়ায় যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। আদিবাসীদের অনেকেই জমিজমা ফেরত পায়নি। কয়েকটি উপাদান যথাযথভাবে মানা হলে পার্বত্য এলাকায় সহিংসতা কমবে। সাবেক কূটনীতিক শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর সেখানে দুর্বৃত্তায়ন বেড়ে যাওয়া খুবই দুর্ভাগ্যজনক। তবে পার্বত্য এলাকায় শান্তি আসছে। এ বিষয়ে আমি আশাবাদী। শান্তি চুক্তির ভিত্তিতে পার্বত্য এলাকার উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এবং উন্নয়ন কর্মকা- চালাতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মেজবাহ কামাল বলেন, শান্তি চুক্তির ২২ বছর পার হয়েছে। এখন আর এটা নিয়ে কোথাও কোন আলোচনা নেই। বাস্তবতা হচ্ছে পার্বত্য শান্তিচুক্তি এখন হিমাগারে চলে গেছে। শুধু উন্নয়ন দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধান করা যাবে না। জাতিগত, ধর্মীয়, ও ভূমি সমস্যার সমাধান দিয়ে তাদের আশ্বস্ত করতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী না করা হলে পার্বত্য শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন সম্ভব না। পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা তারা প্রবন্ধে তিন জেলার উন্নয়ন কার্যক্রম ও তুলে ধরে বলেন, পার্বত্য এলাকায় শিক্ষা, যোগাযোগ, কৃষিসহ সবক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে পার্বত্য তিন জেলার ২৬টি উপজেলায় সরকারী-বেসরকারী ৪৪টি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এক সময় ৫০ কিলোমিটার সড়ক যোগাযোগ ছিল। এখন তা ১ হাজার কিলোমিটার হয়েছে। ভবিষ্যতে তা ২ হাজার কিলোমিটার ছাড়িয়ে যাবে। চাষযোগ্য ভূমির পরিমাণ কম হলেও কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে দুর্গম এলাকার ফসল দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে যাচ্ছে। তবে আরও অনেক উন্নয়ন প্রয়োজন। অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন তার প্রবন্ধে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভূমি ব্যবস্থাপনা ও রাষ্ট্রের সুনজর না থাকায় গুজবের সৃষ্টি হয়। এ কারণে বড় ধরনের সহিংসতা ঘটে। গুজব স্থানীয় পাহাড়ী ও বাঙালীরা নিজ নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে। ফলে সম্প্রীতি ও সহাবস্থান দুর্বল হয়ে পড়েছে। টেকসই উন্নয়ন ও বৈরিতা দূর করতে না পারলে সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব হবে না। অধ্যাপক আমেনা মহসিন বলেন, পাহাড়িরা তাদের অধিকারগুলো পাচ্ছে কি না তা দেখা জরুরী। সামাজিক বিচার ও উন্নয়নের বিষয়টিও দেখতে হবে। ভূমি কমিশন কেন কাজ করতে পারছে না তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। চুক্তির পর চাঁদাবাজি বেড়েছে। মানুষের মধ্যে সহিংসতা বেড়েছে। বিশেষ করে নারীর ওপর সহিংসতা নিয়েও চিন্তা করতে হবে। জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন সাবেক কূটনীতিক ও আইসিএলডিএস এর চেয়ারম্যান মোঃ জমির। স্বাগত বক্তব্য রাখেন আইসিএলডিএস এর নির্বাহী পরিচালক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব) আবদুর রশীদ। দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন। অনুষ্ঠানের মিডিয়া পার্টনার ছিল ভোরের কাগজ ও ৭১ টেলিভিশন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন, আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা চেয়ারম্যান সহিদুজ্জামান মহসিন রুমান, বাঘাইছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমা, লক্ষীছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান বাবুল চৌধুরী।
×