ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ আমার আব্বা

প্রকাশিত: ০৮:৪৩, ২৮ জুন ২০১৯

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ আমার আব্বা

আমার আব্বা ছিলেন ফুরফুরা শরীফের মুজাদ্দেদে যামান মাওলানা আবু বকর সিদ্দিকী রহমাতুল্লাহি আলায়হির অন্যতম প্রধান খলিফা। তিনি ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুন অসুস্থ অবস্থায় ঢাকায় আসার পথে মানিকগঞ্জের নিকটে আমার একমাত্র পুত্র আরিফ বিল্লাহ মিঠুর কোলে মাথা রেখে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তার ইন্তেকালের খবর ছড়িয়ে পড়লে রীতিমতো শোকের ছায়া পড়ে যায়। পত্রপত্রিকায় বহু শোকবার্তা প্রকাশিত হয়। সৈয়দ আলী আহসান লিখেছিলেন আমরা প্রথমে ফরিদপুরের গিরদায় ছিলাম এবং পরে মাগুরার আলোকদিয়া অঞ্চলে স্থায়ীভাবে চলে আসি। যশোরে আরও দুটি নামকরা পীর আছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে খড়কী আর অপরটি মাগুরার দ্বারিয়াপুর। খড়কীর পীর সাহেব যথার্থ সুফী ছিলেন এবং এ বিষয়ে তার গ্রন্থাদিও আছে। দ্বারিয়াপুরের পীর সাহেবকে আমি দেখি ১৯৭৮ সালে নড়াইলে। নড়াইলের হবাখালী গ্রামে আমার এক ফুফাত ভাই বাস করতেন, তার নাম ছিল সৈয়দ নুরুল হক। আমি যখন রাষ্ট্রপতি জিয়ার মন্ত্রিসভায় তখন একবার নড়াইলে গিয়েছিলাম। সেখানে সার্কিট হাউসে স্থানীয় বাসিন্দারা আমার সঙ্গে সাক্ষাত করতে এসেছিল। সেখানে আমার ভাই সৈয়দ নুরুল হকও ছিলেন। তার সঙ্গে আমি একজন সৌম্য ভদ্রলোককে দেখি। তিনি শুভ্র বেশধারী ছিলেন। মাথায় সাদা টুপি ছিল। শুভ্র শ্মশ্রুম-িত এই সৌম্য ভদ্রলোককে দেখে আমি চমকে উঠেছিলাম আমার মনে আছে। ‘ইনি দ্বারিয়াপুরের পীর সাহেব মাওলানা শাহ সুফী তোয়াজ উদ্দীন আহম্মদ। আমি তার সঙ্গে হাত মেলাতে চেষ্টা করলাম কিন্তু তিনি হাত ধরার সুযোগ না দিয়ে আমাকে বুকে জরিয়ে ধরলেন এবং থর থর করে কাঁপতে লাগলেন, আমার শরীরে যেন বিদ্যুত প্রবাহিত হলো। পরে আমাকে ছেড়ে দিয়ে তিনি বললেন, আমি অনেকদিন ধরে আপনার অপেক্ষায় ছিলাম। ভালই হলো দেখা হয়ে গেল। আমি যে দিন নড়াইলে সকলের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করে দ্বারিয়াপুরের পীর সাহেবের বাড়িতে গিয়েছিলাম মনে আছে এবং সেখানে দুপুরে অথবা রাতের খাবার খেয়েছিলাম। যখন বিদায় নেই তখন আমি পীর সাহেবকে বলেছিলাম আমাকে কিছু উপদেশ দিন তিনি উত্তরে বলেছিলেন ‘আপনি আওলাদে রাসুল আপনাকে আমি কি উপদেশ দেব। আপনিই তো আমাকে উপদেশ দিলেন। এই বলে তিনি হাসলেন। এটাই তাঁর সঙ্গে আমার শেষ কথা ও দেখা। শাহ সুফী তোয়াজ উদ্দীনের জন্ম ১৯০৯ সালে। তিনি মাদ্রাসা শিক্ষালাভ করে আধ্যাত্মিক সাধনায় নিমগ্ন হন। ফুরফুরার পীর সাহেব শাহ সুফী আবু বকর সিদ্দিকী তার দীক্ষা গুরু বা পীর ছিলেন। সাধনার একাগ্রতা দ্বারা তোয়াজ উদ্দীন সাহেব খিলাফতের উপযুক্ত হন এবং ১৯৩৩ সালে খিলাফত লাভ করেন। নিরলস সাধনার মধ্য দিয়ে তিনি আল্লাহর নৈকট্য লাভ করেন। তিনি আল্লাহর ওপর নির্ভরতা এবং সর্বক্ষণ আল্লাহর জিকিরে মগ্ন থেকে তাসাউফে খুবই উন্নতি লাভ করেন। জীবনভর তাকওয়া এবং জিকিরের মধ্যে থেকে তিনি আল্লাহর মধ্যে নিমগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন। তার মুরিদানের সংখ্যা অনেক। যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, ঢাকা, পাবনা, খুলনা এবং ভারতের চব্বিশ পরগনায় ছড়িয়ে আছে। এদের সংখ্যা নয় লক্ষাধিক হবে। তিনি দ্বিনী শিক্ষার সঙ্গে ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন, তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আধুনিক। আমার আব্বা হুজুর কিরায়ক ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ সুফী। তিনি বিশাল জমিদারির মালিক ছিলেন। ঢাকায় সিদ্ধেশ্বরীতে বাড়ি করেছিলেন। এখন সেখানে ১০ তলা ভবন, এই ভবনে তার নাম সংযুক্ত হয়েছে এবং ভবনের ছাদে খানকায়ে তোয়াজিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতি ইংরেজী মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার খানকায়ে তোয়াজিয়ায় যিকির মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অজ¯্র মুরিদ মুতাকীর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। গারাগঞ্জ থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত বিশাল অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ক ছিলেন আমার আব্বার খাস মুরিদ আলহাজ আকবার হোসেন মিয়া। মুক্তিযোদ্ধারা কোন অভিযানে যাওয়ার আগে আমার আব্বার কাছে এসে দোয়া নিয়ে যেতেন। আমরাও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। ১৯৩৩ সালে আমার আব্বার তার পীরের নির্দেশে ৪ মাস দ্বারিয়াপুর শরীফে যে ইছালে সওয়াব কায়েম করেছিলেন তা আজও অব্যাহত রয়েছে। তিনি হাসপাতাল, কলেজ, মাদ্রাসা ও হাই স্কুল প্রভৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এক প্রবন্ধে মাওলানা মুহাম্মদ রেজাউল করিম ইসলামবাদী লিখেছেন- দ্বারিয়াপুরের পীর সাহেব রহমাতুল্লাহ আলাইহির সহবতে যারাই গেছেন তারাই বিমহিত হয়েছেন। ছোট-বড় সকলের সঙ্গে তিনি অত্যন্ত মধুর ব্যবহার করতেন। প্রত্যেকের মনে হতো হুজুর আমাকেই বেশি ভালবাসেন। তিনি সত্যিকার অর্থে কামেল পীর ছিলেন। তাঁর সহবতে সর্বক্ষণিক সময় অতিবাহিত করে বহুত ফায়দা হাসিল করা যেত। হযরত মাওলানা জালালুদ্দীন রুমী রহমাতুল্লাহি আলাইহির ভাষায় বলা যায় : এক সামান্য সহবতে বা আওলিয়া বেহতর আজ সাদ সাল তা’ আত বেরীয়া। আমার আব্বা লেখাপড়া করেছিলেন ইংরেজী স্কুলে। পরে ফুরফুরা শরীফে যাওয়ার পর তার পীর মাওলানা আবু বকর সিদ্দিকী রহমাতুল্লাহি আলাইহির নির্দেশে মাদ্রাসায় ভর্তি হলেন। তিনি পীরের সান্নিধ্যে ফুরফুরা শরীফে প্রায় আট বছর থাকেন এবং ইলমে তাসউফের সব তরিকায় তাসীন গ্রহণ করেন। তিনি অল্প সময়ের মধ্যে কামালিয়াত হাসিল করেন। পীর তাকে খেলাফত নামা প্রদান করেন। আমার আব্বা ছিলেন অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের মানুষ। তার কথা মনে পড়লে আমার মন বিরহ বেদনায় কেঁপে ওঠে। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর দরবার শরীফ
×