ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মিয়ানমারে সীমান্তরক্ষী ও সেনা সদস্যরা ইয়াবা মজুদ করছে কক্সবাজার সীমান্তে

মানব পাচার কমলেও ইয়াবার চালান থামানো যাচ্ছে না

প্রকাশিত: ০৭:৫৬, ২৮ জুন ২০১৯

মানব পাচার কমলেও ইয়াবার চালান থামানো যাচ্ছে না

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মানবপাচার ও ভয়ঙ্কর মাদক ইয়াবা নিয়ে দেশজুড়ে আলোচিত টেকনাফ। ফলে মাদক ও মানবপাচার রোধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে বর্তমান সরকার। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আইনবিরোধী ও অবৈধ এ দুই কাজের জন্য কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত হয়েছে। ফলে দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পাশাপাশি মানব পাচারবিরোধী অভিযানও চলছে। এতে প্রতিনিয়ত টেকনাফের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে পাচারকারীদের বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটছে। এর ফলে ইতোমধ্যে শীর্ষ মাদক পাচারকারী তথা মিয়ানমার থকে ইয়াবার চালান এনে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেয়ার সঙ্গে জড়িত সাইফুল করিমসহ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পাচারকারী প্রাণ হারিয়েছে। এরমধ্যে দুদফায় প্রাণ হারিয়েছে মাদক পাচারকারী দলের কয়েক সদস্য। এদের মধ্যে রয়েছে ৭২ ইয়াবা পাচারকারী ও ৭ মানব পাচারকারী। জেলার সরকারী সূত্রগুলোর দাবি- বর্তমানে টেকনাফ হয়ে সমুদ্র পথে মানবপাচারের বিষয়টি অনেকাংশে থমকে গেলেও মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান আসা রোধ কঠিন অবস্থায় রয়েছে। সীমান্ত গলিয়ে মিয়ানমারের ওপার থেকে কোন না কোনভাবে ফাঁকফোঁকরে ইয়াবার চালান চলে আসছে। তবে ইতোপূর্বেকার মতো অস্বাভাবিক পরিবেশ থেকে অতি গোপনীয়তার প্রক্রিয়ায় এ কারবার চলছে। ইতোপূর্বেই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য জুড়ে ৩৭ ইয়াবা উৎপাদন কারখানার কথা সুনির্দিষ্টভাবে সে দেশের সরকারকে জানিয়ে এগুলোর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য দফায় দফায় আহ্বান জানানো হলেও তা কোন কাজে আসেনি। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী, সেনা ও পুলিশ সদস্যরাও তাদের এলাকা থেকে ইয়াবার চালান সীমান্ত এলাকা থেকে বহন করে নিয়ে আসছে। সেখান থেকে এপারে চালান করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে এদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের। আবার এরমধ্যে মিয়ানমারে সেনা অভিযানে নিহত পুরুষদের স্ত্রীদের বড় একটি অংশ এ কাজে লিপ্ত হয়েছে। এসব মহিলারা উখিয়া-টেকনাফের ত্রাণ শিবিরে আশ্রিত হিসাবে থাকলেও এখন বেপরোয়া গতিতে ইয়াবার চালান নিয়ে আসার সঙ্গে জড়িয়ে থেকে রুজি রোজগারের পথ বেছে নিয়েছে। কক্সবাজারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সূত্রে স্বীকার করা হয়েছে, টেকনাফে মানবপাচারের গতি এখন একেবারেই শ্লথ। কিন্তু ইয়াবার চালান আসা কোনভাবেই যেন থামানো যাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা সরকারী চাপের মুখে এখন অতীতের যে কোন সময়ের চাইতে এ অপকর্মের বিরুদ্ধে রয়েছে। কিন্তু সীমান্ত এলাকার ইয়াবা কারবারি ও শিবিরে আশ্রিত যেসব রোহিঙ্গা এ অপকর্মে লিপ্ত তাদের আইনের আওতায় আনতে না পারার জের হিসাবে ইয়াবার চালান আসা রোধ করা যাচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, মূলত রাখাইন রাজ্যজুড়ে যে ৩৭ ইয়াবার উৎপাদন কারখানা রয়েছে সেগুলো সে দেশের সরকার বন্ধ করার ব্যাপারে উদ্যোগ না নিলে এসব চালান আসতেই থাকবে। বর্তমানে বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, সে দেশের সীমান্তরক্ষী ও সেনা বাহিনীর সদস্যরা ইয়াবা উৎপাদন কারখানা থেকে চালান এনে সে দেশের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় মজুদ করছে। এরপর তারা এদেশের ক্যারিয়ারদের ও তাদের গডফাদারদের মোবাইল ফোনে ইঙ্গিত দিয়ে কোথা থেকে এবং কোনপথে চালান নিয়ে আসবে তা দেখিয়ে দিচ্ছে। সীমান্ত এলাকার সূত্রগুলো জানিয়েছে, ইয়াবার চালান নিয়ে নাফ নদীর মোহনা থেকে উখিয়ার থাইনখালি খাল পর্যন্ত চোরাচালান সিন্ডিকেট সদস্যরা তৎপর। এ কাজে এখন জড়িত হিসাবে রহমতের বিলের কলিমুল্লাহ ওরফে লাদেন, মোঃ ইউনুস ওরফে সোহেল ও মোঃ আক্তার মিয়ানমার থেকে ইয়াবার বড় বড় চালান এদেশে নিয়ে আসছে বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। সীমান্ত এলাকার বহু ইয়াবা কারবারি পুলিশ ও র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারালেও বর্তমানে সিন্ডিকেটের হাল ধরেছে লাদেন, সোহেল ও আক্তার। রহমতের বিল বরাবর সীমান্তের ওপারের চাকমাকাটা এলাকায় এসব সিন্ডিকেট সদস্যদের যাওয়া-আসা রয়েছে। বর্তমানে রহমতের বিল হয়ে ইয়াবার চালান ঢুকছে বলে জোরালো তথ্য রয়েছে। আরও জানা গেছে, মাছের ব্যবসার আড়ালে মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান আনা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় প্রথমে আশ্রিত রোহিঙ্গা সদস্যদের অনেকে চোরাপথে মিয়ানমারে চলে যায়। এরপর সাধারণ পোশাকে নদী পেরিয়ে চালান নিয়ে তারা সীমান্তের ওপারে চলে আসছে। এরপর মাছের ঝুড়িতে করে চিংড়ি ঘেরের বেড়িবাঁধ দিয়ে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন রুট নিয়ে যতই কঠোর অবস্থান নিচ্ছে চোরাকারবারিরা নতুন নতুন রুট বেছে নিচ্ছে। এদিকে, গেল রমজান মাসে মালয়েশিয়ায় মানব পাচারের হার বেড়ে গেলে কক্সবাজার জেলা টাস্কফোর্স এ পাচার রোধে কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বঙ্গোপসাগর, নাফ নদী, মহেশখালী, সমিতি পাড়া, সোনার পাড়া ও টেকনাফে দিনে-রাতে সমানে উদ্ধার হয় মালয়েশিয়াগামীরা। ইতোমধ্যে যেসব মানবপাচারকারী দলের সদস্য বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে এদের বেশিরভাগই রোহিঙ্গা দালাল। বর্তমানে টেকনাফ পুলিশ ইয়াবা পাচার ও মানবপাচার রোধে যে ভূমিকা চালিয়ে যাচ্ছে তা প্রশংসা কুড়াচ্ছে সত্য, কিন্তু ইয়াবা পাচার রোধ করা না যাওয়ায় সমালোচনাও চলছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর শুধু টেকনাফে বন্দুকযুদ্ধে শীর্ষসহ ৭৯ ইয়াবা কারবারি ও মানব পাচারকারী নিহত হয়েছে। তবে ২০১৮ সালের মার্চ থেকে দেশব্যাপী প্রাণ হারিয়েছে ৩২১ জন। এছাড়া ইয়াবার চালান উদ্ধার হয়েছে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি পিস।
×