ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কবিতা অন্ধকারের ভেতর এক হীরণ্ময় দ্যুতি

প্রকাশিত: ০৭:৪৭, ২৮ জুন ২০১৯

কবিতা অন্ধকারের ভেতর এক হীরণ্ময় দ্যুতি

কবিতা কি শুধুই সুন্দরের উৎপ্রেক্ষা ? কী এই সুন্দর ? এ সুন্দরের পরিসীমা কতদূর ? ‘অতি দূর সমুদ্রের পর’ কি ? শুধুই কি প্রিজমে নিক্ষিপ্ত আলো শতধা বিচ্ছুরিত হয়ে এ সুন্দরকে প্রকটিত করে তোলে ? আঁধারের কি কোন সৌন্দর্র্য আছে ? সে সুন্দর কি দেখা যায় নাকি অনুভবের উৎপ্রেক্ষা ? সুন্দরের আরাধনা শুধু আলোর কাছেই নয়, আঁধারের নিকষ নগরীর গভীরেও লুকিয়ে থাকাও এক অনুভব। আর সে অনুভবের দ্যুতিমালা আত্মাকে, চিত্তকে করে তোলে বিমোহিত, মনকে রাঙিয়ে দেয় সন্ন্যাস এক উরু উরু সমীরণের হিল্লোলে। কবিতার বিশুদ্ধবাদীরা এভাবে কবিতাকে নিয়ে যান এক অন্তর্লীন গভীর মহাসাগরের নীলে। সেখানে কবি ও কবিতা এক হয়ে মনোজগতের প্রবল ঘর্ষণে জাগিয়ে তোলে এক হীরন্ময় দ্যুতী অশোকের বিম্বিসার ধুসর নগরে, দূর সাগরের কুলহারা নাবিকের মনে, গভীর রাতের নীরবতায়। সেখানে নাগরিকতার ব্যস্ত যানজট, বৈহাসিকের রথযাত্রা, প্রেমিকার নিত্যদিনের নীলচিঠি না থাকলেও মরুময় এক সাম্রাজ্যের তোরণ খুলে দেয় অনুভবের ব্রহ্মান্ডের নীলে। ভিক্টোরীয় যুগ পরবর্তী কবিরা ওয়ার্ডস্ওয়ার্থের মতো প্রকৃতির সুন্দর নিয়ে কবিতা লেখা শুরু করলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা ও তার পরবর্তী বস্তুবাদী ও ভোগবাদী বিশে^র অসারতা কবিদের এক ধরণের offers a philosophical meditation in relation to the imagery of death and views of self-denial in juxtaposition চেতনা এনে দেয় যার অব্যর্থ পেরেক গেঁথে দেন টি এস এলিয়ট তাঁর The Waste Land-য়ে। জীবনানন্দ দাশ যুগ সচেতন ও ইংরেজি সাহিত্যে অবগাহন করেও চিরসবুজ বাংলাকে নিয়ে গোলাপজল ছিটিয়ে দিয়েছেন। এ বোধন, সংবেদন, অনুরণন মনকে গভীর অন্তস্থল থেকে নাড়া দেয় ষাটের স্বাক্ষর গোষ্ঠীর কবি সিকদার আমিনুল হককে। এঁরা নিজেদের যুদ্ধের মাঠে নিয়ে যেতে প্রস্তুত, কিন্তু কবিতাকে শুদ্ধতম বলয় থেকে তিল পরিমাণ স্থানান্তর করতে আগ্রহী নন (এ কথা কবি তাঁর এলিফেন্ট রোডের বাসায় জীবৎকালে ‘দূরের কার্নিশ’ কাব্যগ্রন্থের আলোচনায় আমাকে বলেছিলেন)। আর এদের সাথে এসে যোগ হলেন সত্তর দশকের কবি মেহরাব হোসেন যাঁর একটি কাব্যগ্রন্থ ‘নীল বিষ নীল অজগর’ বাইশটি কবিতা, চারটি ধ্রুপদ, বাংলা শায়ের দু’টি ও একচল্লিশটি অনুকাব্য নিয়ে এবারের বইমেলাতে এসেছে। কাব্যগ্রন্থটিতে দেড় শ’ চরণ থেকে শুরু করে দু’চরণেরও কবিতা রয়েছে। ‘অস্থির অজগর গিলে খাচ্ছে সভ্যতা। /নষ্ট পোকামাকড়, ভ্রষ্ট সময়/ কুরে খাচ্ছে প্রযুক্তির মগজ।/ পুড়ছে শহর, নগর, বন্দর।/ সুন্দরী পৃথিবীর বন্ধনির হুক ছিঁড়ে ফেলে/ উত্তেজিত সূর্যপুরুষ;/ শাড়ির আঁচল পোড়ায় নির্লজ্জ রোদ্দুরে’ (কাঁদে বিস্তীর্ণ বনভূম : পৃ-১৭)। কবি এ বিশে^র, এ শতকের সম্ভ্রান্ত সভ্যতার নখড়ে আবদ্ধ হয়েও তাঁর কবিতায় এ বাস্তবতা দেখতে পান। কবি মেহরাব রহমান মৃত্যুকে মৃত্যু বরণ করেন, ‘ওহে পরমাত্মীয় প্রভু/ সৃজন যদি করে থাক/ অনবদ্য এই মানব জীবন/ ঠিক আছে/ ঠিক আছে/ আরাধ্য তুমি/ সকাল-সন্ধ্যা রাত্রিদিন।/ একটি নিমগ্ন প্রার্থনা/ শক্ত পায়ে হেঁটে যেতে চাই/ পশ্চিমের পড়ন্ত সূর্যের দিকে/ যেতে যেতে/ ফিরে ফিরে দেখে নেব/ মৃৎগন্ধের এই মুগ্ধ পৃথিবী . . . ‘তোমাকে বলছি;/ আমাকে তুমি খর্ব কোরো না/ অন্ধ কোরো না/ বন্ধ কোরো না/ বার্তা পাঠিও চলে যাব’ . . . ‘হিংস্র পশুর মতো খুবলে খেতে চাই না/ সত্যের অপমৃত্যু চাই না/ মানুষ থাকতেই যবনিকা চাই . . . বার্তা পাঠিও চলে যাব’ . . . ‘অনেক দীর্ঘ/ পথ পাড়ি দিয়ে/ মানুষের পদচিহ্ন খুঁজে খুঁজে/ অমানিশা থেকে এসেছি এইখানে/ আলোর ভুবনে/ জেনেছি/ মৃত্যুই শেষ কথা নয়/ কেবল ঠিকানা বদল/ খুঁজতে খুঁজতে/ আমার আমির সন্ধানে/ হেঁটে যাবো অগণন পথ ধরে’ (বার্তা পাঠিও : পৃ-৩৪-৩৭)। কবি মেহরাব রহমানের কোন কথা শেষ কথা নয়, তিনি চিরসত্য, ‘যতই সময়ের ভেলা ভাঁটির টানে যেতে চায় কল্প অন্ধকারে/ নতুন জোয়ারে ফিরে আসি বারে বারে বর্ণাঢ্য ভূবনে’ (দ্বিপদী ধ্রুপদ-২ : পৃ-৬৩), ‘জমতে জমতে/ অফুরান জ্যোসনা প্রপাত/ এভাবেই আলোকবর্তিকার/ অঝর ধারার সাথে/ শেষহীন ছুটে চলা, (অনুর ভিতর পরমানু-৩ : পৃ-৭২)। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কবির কথা, ‘সব সরঞ্জাম, সকল রসদ/ আগামীর জন্য জমা থাকবে/ রসুই ঘরের বন্ধ দেরাজে’ (অনুর ভিতর পরমানু-৪০, পৃ-১১১)। কবিতাগুলোতে একটা অসম্ভব সুন্দর নির্লোভ আকাক্সক্ষা বা কবির সযত্নে পরিচর্যা থেকে গেছে যে, কবির এতোগুলো কবিতা বই প্রকাশের পর এ কাব্যগ্রন্থে কবি কবিতায় থেকেছেন, বাইরের বিশ্বকে দেখেছেন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেগুলোর চিত্রও তাঁর কবিতায় উঁকি মেরেছে কিন্তু তিনি নিরেট তাঁর কবিতায় নতজানু থেকেছেন। কাব্যে তিনি তাঁর ক্রোধ, জন্ম. মৃত্যু, জীবন, সবই দেখেছেন কিন্তু কবিতাকে বস্তুজগতের ভেতর নিয়ে আসেননি। এটিই কবির একটা দুর্লঙ্ঘ শুদ্ধতা। (নীল বিষ নীল অজগর/ প্রকাশক : শওকত হোসেন লিটু, পারিজাত প্রকাশনী, ঢাকা।)
×