ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রথম সার্থক ঔপন্যাসিক

প্রকাশিত: ০৭:৪২, ২৮ জুন ২০১৯

প্রথম সার্থক ঔপন্যাসিক

পণ্ডিত ভবাণী চরণ বিদ্যাভূষণের দৌহিত্র ও যাদব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তৃতীয় পুত্র বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ঔপন্যাসিক বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পশ্চিম বাংলার চব্বিশ পরগনা জেলার নৈহাটি জংশন স্টেশনের নিকটবর্তী কাঁঠালপাড়া গ্রামে ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুন (বাংলা ১২৪৫ সালের ১৩ আষাঢ়) রাত ৯টায় জন্মগ্রহণ করেন। তার মা’ ছিলেন দুর্গা দেবী। বঙ্কিমের পিতা ইংরেজী ও ফারসী ভাষায় সুশিক্ষা লাভ করে ইংরেজ সরকারের অধীনে চাকরি লাভ করেন এবং স্বীয় কর্মদক্ষতার গুণে অবশেষে ডেপুটি কালেক্টরের পদ লাভ করেন। বঙ্কিম চন্দ্র যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন ভারতবর্ষের মাটিতে ইংরেজ কর্তৃত্ব দৃঢ় ভিত্তি পেতে শুরু করেছে। মহারানী ভিক্টোরিয়া ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসেছেন। ইংরেজ রাজত্বের আগ্রাসী প্রভাব জাতীয় জীবনের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিম-লে ছাপ ফেলেছে স্পস্টতর। পাশাপাশি ভারত বর্ষের মাটিতে ধীরে ধীরে আত্মজাগরণের প্রস্তুতি গড়ে উঠেছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক একগুচ্ছ ঘটনাবলীর দ্বন্দ্ব-সংঘাতে উত্তাল হয়ে উঠেছে স্বদেশভূমি। জাতীয় চিত্ত তার ফলে নানাদিক থেকে প্রভাবিত আলোড়িত হচ্ছে। ভবিষ্যতে ইংরেজবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে যা খুবই তাৎপর্য পূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে। ইতিহাসের গতি নির্ধারণে যা আজও স্মর্তব্য হয়ে আছে উজ্জ্বলভাবে। বঙ্কিম-জীবনের এক শতাব্দীর সময়কাল পরিধিতে ভারতবর্ষের মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছেন অসংখ্য যুগান্তকারী প্রতিভা। যারা সমাজ জীবনের বিভিন্ন দিক নিজস্ব জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সেবা ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে আলোকিত করে গেছেন। অতীত ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার নিয়েই উজ্জ্বল সরণি তৈরি করেছেন ভবিষ্যৎ পথ চলার। সমসাময়িক কালের সীমাবদ্ধতা নিয়েও অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন বহুক্ষেত্রে। শুধুমাত্র ব্যক্তি নয়- সমন্বিত জ্ঞানের আলোকে সেই সময় গড়ে উঠেছিল অনেক রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান- যাদের অবদান ও সভ্যতার অগ্রগমনে তাৎপর্যপূর্ণভাবেই উল্লেখযোগ্য। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বঙ্কিম চন্দ্রের জন্ম দশকেই যেসব ঘটনা তাঁর সময় প্রতিবেশকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছিল তার মধ্যে উল্লেখ্যÑ১৮৩১ খিস্টাব্দে ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকার প্রথম আত্মপ্রকাশ। ইয়ং বেঙ্গল মুভমেন্টের নেতা ঝড়ো হাওয়ার দামাল পুরুষ ডিরোজিওর মৃত্যু। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে ধর্মগুরু রামকৃষ্ণ পরম হংস দেবের জন্ম। রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী রাজা রাম মোহন রায়ের মৃত্যু। ডাঃ মহেন্দ্র সরকারের জন্ম। ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে উদার চেতা উইলিয়াম কেরীর মৃত্যু। ১৮৩৫ খিস্টাব্দে ইংরেজী ভাষার সাহায্যে উচ্চশিক্ষার প্রবর্তন এবং মেডিক্যাল কলেজের প্রতিষ্ঠা। স্যার চার্লস মেটকাফ কর্তৃক মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা প্রদান। কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর জন্ম। ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠা। এদেশে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটির পত্তন অন্যতম প্রধান ঘটনা। মাত্র ১২ বছর বয়সে গ্রামের ৫ বছরের একটি বালিকার সঙ্গে বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। অনেক ক্ষেত্রে পিতার মহত্ব ও বৈশিস্ট্যের ছাপ পড়ে সন্তানের উপর। অন্যদিকে পিতার চৌর্য বৃত্তি, পাপাচার, গোলামি ও দালালি করার ছাপ সন্তানের উপর পড়াও অস্বাভাবিক নয়। বঙ্কিম চন্দ্র সম্ভ্রান্ত বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা যাদব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ইংরেজ সরকারের ডেপুটি কালেক্টর পদে কীর্তিত্বের সঙ্গে বহাল ছিলেন। পরে ইংরেজ সরকার তাঁর কাজে খুশি হয়ে তাঁকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট করে দিয়েছিলেন। সেকালে ভারতীয়দের পক্ষে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদটি পাওয়া খুব সহজ ছিল না। সরকারের অত্যন্ত অনুগত ও বিশ্বস্ত না হলে এ পদ পাওয়া যেত না। বঙ্কিমরা ছিলেন ৪ ভাই। বঙ্কিম ছিলেন সেজ। বড় ভাইয়ের নাম শ্যামাচরণ, মেজ ভাই সঞ্জীব চন্দ্র ও ছোট ভাই ছিলেন পূর্ণ চন্দ্র। বঙ্কিমের বড় ভাই শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায় ও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হতে পেরেছিলেন। বঙ্কিমের মেজ ভাই সঞ্জীব চন্দ্র ও হন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। বঙ্কিম চন্দ্রের ছোট ভাই পূর্ণ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। সুনীল কুমার বসু তাঁর বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পুস্তকে লিখেছিলেন ‘একই পরিবারের এতগুলো ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সদস্য দেখা যায়না। সেদিনের বিদেশী শাসনের যুগে ভারতীয়রা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চেয়ে উচ্চতর পদ পাওয়ার আশা করতে পারতো না। উনিশ শতকে বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতকে হিরন্ময় দ্যুতিতে উজ্জ্বল করেন তিনজন মহারাথী- বঙ্কিম চন্দ্র (১৮৩৮-১৮৯৪খ্রি.), নবীন চন্দ্র (১৮৪৭-১৯০৯খ্রি.) ও দিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩খ্রি.)। পেশায় তাঁরা সবাই ছিলেন সে সময়েরই ইংরেজ শিক্ষিত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্কিম চন্দ্রের বয়স যখন ৬ বছর তখন তিনি মেদনীপুরে ইংরেজী স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে থেকে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ৫ বছর বঙ্কিম চন্দ্র মেদনীপুর ইংরেজী স্কুলের ছাত্র ছিলেন। মেদনীপুর থেকে কাঁঠালপাড়ায় ফিরে আসার কিছু দিনের মধ্যেই সেকালের বাল্যবিবাহের রীতি অনুযায়ী ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে কাঁঠালপাড়ারই কাছে নারায়ণপুর গ্রামের ৫ বছর বয়সের মেয়ে মোহিনী দেবীর সঙ্গে বঙ্কিম চন্দ্রের বিয়ে হয়। মোহিনী দেবী মারা যান মাত্র ১৬ বছর বয়সে। মোহিনী দেবীর পিতা ছিলেন কাঁঠালপাড়ার নিকটবর্তী নারায়ণপুর গ্রামের বাসিন্দা নব কুমার চক্রবর্তী। সাড়ে এগারো বছর বয়সে ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ অক্টোবর বঙ্কিম চন্দ্র হুগলী কলেজে (তখন হাজী মহম্মদ মহসিন কলেজ নামে ও পরিচিত) ভর্তি হন। তখনকার দিনে এখনকার মতো এসএসসি এইচএসসি ও বিএ পরীক্ষার প্রবর্তন হয়নি। ছাত্ররা জুনিয়র ও সিনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষা দিতো। বঙ্কিম চন্দ্রের সাহিত্য প্রতিভার উন্মেষের পেছনে যাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি হলেন- নৈহাটির নিকটবর্তী কাঁচড়াপাড়ার প্রসিদ্ধ স্বভাব কবি ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯খ্রি.)। ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত সংবাদ প্রভাকর (১৮৩১খ্রি.) নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। এই পত্রিকার প্রধান লেখকও ছিলেন বঙ্কিম চন্দ্র। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে বঙ্কিম চন্দ্র ‘সংবাদ প্রভাকর’ কবিতা প্রতিযোগিতায় যোগদান করে কুড়ি টাকা পুরস্কার পেয়েছিলেন। তাঁর এই কবিতাটির নাম ‘কামিনীর প্রতি উক্তি তোমাতে লো ষড় ঋতু’ প্রকাশ কাল ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দ। এই পুরস্কার প্রদান করেছিলেন আমাদের রংপুরের তুষ ভা-ারের জমিদার রমনী মোহন চৌধুরী ও গোপাল পুরের ‘রঙ্গপুর বার্তাবাহ পত্রিকার’ (১৮৪৭খ্রি.) সম্পাদক কালী চন্দ্র রায় চৌধুরী। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্কিম চন্দ্র জুনিয়র স্কলারশিপ ও ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে সিনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে প্রেসিডেন্সি কলেজে আইন পড়ার জন্য প্রবেশ করেন। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বপ্রথম এন্ট্রান্স বা প্রবেশিকা (বর্তমান এসএসসি) পরীক্ষার প্রবর্তন হয়। (তখন এন্ট্রান্স পরীক্ষা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল)। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে বঙ্কিম চন্দ্র প্রেসিডেন্সি কলেজের আইন বিভাগ থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেন। সর্বমোট ২৪৪ জন ছাত্র পরীক্ষা দিয়েছিল। তার ভেতর প্রথম বিভাগে ১১৫ জন ও দ্বিতীয় বিভাগে ৪৭ জন ছাত্র উত্তীর্ণ হন। বাকি ৮২ জন ছাত্র ফেল করে। কারণ তখন তৃতীয় বিভাগ বলে কিছু ছিল না। যারা শতকরা ৫০ বা তার বেশি নম্বর পেয়েছিলেন তারা প্রথম বিভাগে এবং যারা শতকরা ২৫ অথচ শতকরা ৫০ এর কম নম্বর পেয়েছিল তারা দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। বঙ্কিম চন্দ্র প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। সে বছর উত্তরপাড়া স্কুল থেকে কবি হেম চন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, কলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুল (বর্তমান হেয়ার স্কুল) থেকে কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য এবং হিন্দু স্কুল থেকে সতেন্দ্রনাথ ঠাকুর (বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ), গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও যোগেন্দ্রনাথ ঘোষ প্রমুখ ও এন্ট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরের বছর অর্থাৎ ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বপ্রথম বি এ পরীক্ষার প্রবর্তন হলো। তখনও এফ এ (ফার্স্ট আর্টস) বর্তমান আইএ বা এইচএসসি পরীক্ষার প্রচলন হয়নি। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে এর প্রবর্তন হয়। সুতরাং সে সময় এন্ট্রান্স পরীক্ষায় (বর্তমান এসএসসি) পাস করেই বি এ পরীক্ষা দিতে হতো। কাজেই বঙ্কিম চন্দ্রকে আর আই এ বা এইচএসসি পরীক্ষা দিতে হয় নাই। সে সময় সর্বমোট ১০ জন ছাত্র বি এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার মধ্যে কেবল ২ জন বঙ্কিম চন্দ্র ও যদুনাথ বসু দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। বঙ্কিম চন্দ্র প্রথম ও যুদনাথ বসু দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। দুজনেই এরা প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। বঙ্কিম চন্দ্র আইন বিভাগের ও যদুনাথ বস সাধারণ বিভাগের ছাত্র ছিলেন। বঙ্কিম চন্দ্র ও যদুনাথ ৬টি বিষয়ের মধ্যে ৫টিতে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। কিন্তু ষষ্ঠ বিষয়টি ছিল ‘মেন্টাল এ্যান্ড মোরাল সায়েন্স’ কিন্তু এই ষষ্ঠ বিষয়টিতে তারা কিছু কম নম্বর পেয়ে ফেল করেন। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ২৪ এপ্রিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় পরীক্ষকদের সুপারিশ অনুযায়ী ওই দুজনকে ৭ নম্বর গ্রেস দিয়ে বি.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বলে বিবেচিত করার প্রস্তাব নেয়া হয়। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় বঙ্কিম চন্দ্র ও যদুনাথ বসুর উপস্থিতিতে তাদের বি এ ডিগ্রী প্রদান করা হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেটি একটি বিশেষ মুহূর্ত। কারণ এঁরা দুজনেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্র্যাজুয়েট। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ২০ বছর বয়সে বঙ্কিম চন্দ্র যশোরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। এই যশোরে অবস্থান কালেই বিখ্যাত ‘নীলদর্পণ’ নাটক রচিয়তা নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের সঙ্গে বঙ্কিম চন্দ্রের প্রথম পরিচয় হয়। এই পরিচয় ক্রমে ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হয়েছিল। যশোরে থাকা কালে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে বঙ্কিম চন্দ্রের স্ত্রী মোহনী দেবী মারা যান। মৃত্যুকালে তাঁর স্ত্রীর বয়স হয়েছিল মাত্র ১৫ বছর। বঙ্কিমের বয়স তখন ও ২১ বছর পেরোয়নি। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে হালি শহরের বিখ্যাত চৌধুরী বাড়ির মেয়ে রাজলক্ষ্মী দেবীর সঙ্গে বঙ্কিম চন্দ্রের বিয়ে হয়। বিয়ের পর ১২ বছর বয়সের রাজলক্ষ্মীকে নিয়ে তার কর্মস্থল নেগুয়ায় আসেন। এই চাকরি জীবনে মেদিনীপুরের নেগুয়াতে অবস্থান কালেই সমুদ্র্র ও অরণ্যের সৌন্দর্য দর্শনে তাঁর মনে বিখ্যাত রোমান্টিক উপন্যাস ‘কপাল কু-লা’ রচনার অনুপ্রেরণা জন্মায়। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্কিম চন্দ্রের প্রথম কাব্য গ্রন্থ ‘ললতিা’ ও ‘মানস’ প্রকাশিত হয়। ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রথম সার্থক উপন্যাস ‘দুর্গেশ নন্দীনী’ প্রকাশিত হলে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। তাঁর সম্পাদনায় ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ‘বঙ্গ দর্শন’ নামে একখানা উন্নত মানের সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। বঙ্কিম চন্দ্রের উপন্যাসগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑদুর্গেশ নন্দনী, কপাল কু-লা, মৃণালীনি, বিষবৃক্ষ, ইন্দিরা, যুগলাঙ্গুরীয়, চন্দ্রশেখর, রাধারানী, কৃষ্ণকান্তের উইল, রাজসিংহ, আনন্দ মঠ, দেবী চৌধুরানী, সীতারাম প্রভৃতি। উপন্যাস ছাড়াও ললিতা, লোক রহস্য, বিজ্ঞান রহস্য, কমলা কান্তের দফতর, বিবিধ সমালোচনা, দীনবন্ধু মিত্রের জীবনী, কবিতা পুস্তক, প্রবন্ধ পুস্তক, মুচিরাম গুড়ের জীবন চরিত, বিবিধ প্রবন্ধ, ধর্মতত্ত্ব, কৃষ্ণ চরিত্র, সহজ রচনা শিক্ষা, সংখ্যা দর্শন, বঙ্গ দেশের কৃষক, শ্রী ভগবদ্গীতা প্রভৃতি অজস্র বিচিত্র সাহিত্যম-িত জ্ঞানগর্ভ সাহিত্য সম্ভারে বাংলা সাহিত্য ভা-ারকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন। বঙ্কিম চন্দ্রের এ যাবত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩৪। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে বঙ্কিম চন্দ্র মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে বদলি হন। বহরমপুরে তিনি প্রায় ৪ বছর অবস্থান করেন। বঙ্কিম চন্দ্রের সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু দীনবন্ধু মিত্রের মৃত্যু ঘটেছিল ১৮৭৩ সালের ১ নবেম্বর। ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মাত্র ৪৩ বছর বয়সে এই অকাল মৃত্যুতে বঙ্কিম চন্দ্র খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন। ডাক বিভাগের একজন দক্ষ দায়িত্বশীল কর্মী হয়েও কর্তৃপক্ষের অবিচারের ফলে দীনবন্ধুর চাকরিতে পদন্নতি হয় নাই। সে কারণেই দীন বন্ধুকে অকালে মৃত্যুবরণ করতে হয়। বঙ্কিম চন্দ্র ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে বিভাগীয় কমিশনারের পিএ এবং ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে অস্থায়ীভাবে আলিপুরে বদলি হন। এ সময়ে তার প্রথম শ্রেণীর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর পদে প্রমোশন হয়। কর্মময় জীবনে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্কিম চন্দ্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের সভ্য হন। তাঁর মতো একজন প্রতিভাবান, দক্ষ, নীতিবান ব্যক্তিকে ৩৩ বছর চাকরি করার পরও সেই ম্যাজিস্ট্রেটের একই পদমর্যাদা নিয়ে কর্মজীবন শেষ করতে হয়েছে। চাকরি করার পর ও সেই ম্যাজিস্ট্রেটের একই পদ মর্যাদা নিয়ে কর্মজীবন শেষ করতে হয়েছে। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চাকরি করে অত্যন্ত অসুস্থ শরীর নিয়ে বঙ্কিম চন্দ্র অবসর নেন। ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে বঙ্কিম চন্দ্র তার দীর্ঘ একনিষ্ঠ কর্মজীবনের স্বীকৃতি হিসেবে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক রায় বাহাদুর ও সিআইই (কোম্পানিয়ান অব দি ইন্ডিয়ান এম্পায়ার) উপাধি প্রাপ্ত হন। সমগ্র জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সব ঘটনাই তাঁর মানস পরিম-ল গঠনে সাহায্য করে। সুদীর্ঘ ৩৩ বছরে তিনি অখ- বাংলার বহুস্থানে যেমন- যশোহর, কাঁথি, মজিলপুর, বারুইপুর, বারাসত, বহরমপুর, লালগোলা, হাওড়ায় কর্মরত ছিলেন। কর্মসূত্রে নিজস্ব জীবনের অভিজ্ঞতায় সর্বস্তরের মানুষের পরিচয় খুব কাছের থেকে পেয়েছিলেন, যা’ তার সাহিত্য সৃষ্টির প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। বঙ্কিম চন্দ্র ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে ডায়বেটিক রোগে আক্রান্ত হয়ে ৮ এপ্রিল (বাংলা ১৩০০ সালের ২৬ চৈত্র) বেলা ৩টা ২৫ মিনিটের সময় পঞ্চান্ন বছর ন’মাস বয়সে মারা যান। এভাবে বাংলা সাহিত্যাকাশের এক অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন ঘটল। বঙ্কিম চন্দ্রের কোন ছেলে ছিলনা। তাঁর ছিল ৩ মেয়ে শরৎ কুমারী, নীলাব্জ কুমারী ও উৎপল কুমারী। শরৎ কুমারীর স্বামী ছিলেন হালি শহরের ঐতিহাসিক রাখাল চন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, উত্তর পাড়ার বিখ্যাত জমিদার বংশের সুরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন নীলাব্জ কুমারীর বর। আর কলকাতার বাঁশ তলা গলির যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন উৎপল কুমারীর স্বামী। বড় জামাই রাখাল চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় স্ত্রীসহ শ্বশুর বাড়িতেই থাকতেন। বঙ্কিম চন্দ্রের ছোট মেয়ে উৎপল কুমারী অকাল মৃত্যু হয় বিষ পানে স্বামী গৃহে। বড়দা শ্যামা চরণের ছেলে কৃষ্ণ চন্দ্র তাঁর মুখাগ্নি করেন। বঙ্কিম চন্দ্রের বিধবা স্ত্রী রাজলক্ষী দেবী বঙ্কিমের মৃত্যুর পরেও দীর্ঘদিন বেঁচে ছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী বঙ্কিম চন্দ্র দেশাত্মবোধ ও স্বাজাত্যে বোধের পুরোধা ছিলেন। তাঁর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে নব চেতনায় উদ্দীপ্ত বাঙালী সমাজ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। তাই ‘ঋষি বঙ্কিম’ বাঙালীদের দেয়া তাঁর সার্থক উপাধি। সঙ্গত কারণেই বলা চলে বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা নবজাগরণ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরুষ। শুধুমাত্র সাহিত্য স্রষ্টা নন, জাতীয়তাবাদ এবং আত্মশক্তি উদ্বোধনের উৎস-ব্যক্তিত্ব। স্বাতন্ত্র্যবাদী আন্দোলনের অন্যতম প্রেরণা ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্রের উদগাতা।
×