ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ক্রিকেট ॥ এগিয়ে চলার গল্প

প্রকাশিত: ০৭:৪০, ২৮ জুন ২০১৯

ক্রিকেট ॥ এগিয়ে চলার গল্প

রাজার খেলা নামে খ্যাত ক্রিকেট আজ যে জায়গায় এসে পৌঁছেছে তার পেছনে দর্শকের ভূমিকা অনেক বড়। ক্রিকেটের আদি পর্বে খেলোয়াড় হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন না করতে পারলেও সমঝদার হিসেবে ঠিকই খ্যাতি অর্জন করেছিল এই ভূখ-ের জনগণ। বাংলাদেশে ক্রিকেট জনপ্রিয় হওয়ার বীজ অনেক আগেই বপন হয়েছিল। অন্যসব সহযোগী দেশের তুলনায় এই দিক থেকে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে ছিল। বড় বড় ক্রিকেট প্লেয়ারদের পায়ের ছাপ পড়েছে ঢাকায় স্বাধীনতার আগেই। বাংলাদেশ টেস্ট খেলার আগেই ছিল টেস্ট ভেন্যু। ঢাকা স্টেডিয়াম (বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) ১৯৫৩ সালে টেস্ট ভেন্যুর মর্যাদা পায়। ১৯৫৩-৬৯ পর্যন্ত পাকিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দল ঢাকা স্টেডিয়ামে ৭টি টেস্ট খেলেছিল। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ দিয়েই এই স্টেডিয়ামের যাত্রা শুরু হয়। মার ছক্কা, মার ছক্কা রবে গ্যালারি উদ্ভাসিত হয়েছিল সে আমলেই। আনন্দ দিয়েছিল আমাদের এ বাংলার জনগণই। তাই এদেশে ক্রিকেট একটা জায়গা করে নেবে এটাই স্বাভাবিক। বাস্তবেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। আজ ক্রিকেট দুনিয়ায় আমরা পরাশক্তিতে পরিণত হয়েছি। আজ ক্রিকেটে অর্জন অনেক। ২০১৯ বিশ্বকাপে আমাদের অবস্থান বেশ শক্তিশালী। দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দলকে অবলীলায় হারানো কোন মামুলি বিষয় নয়। আফগানিস্তানের সঙ্গে নিজেদের আধিপত্য ঠিকই প্রমাণ করেছে। আজ পৃথিবীর সমস্ত ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের নাম উচ্চারণ করেন সমীহ করে। সমীকরণজুড়ে থাকে আমাদের উপস্থিতি। এ আমাদের অনেক বড় প্রাপ্তি। উপমহাদেশের অন্য সব ক্রিকেট খেলুড়ে দেশের মত বাংলাদেশেও ক্রিকেটের শুরু ইংরেজদের হাত ধরে। এখানে কর্মরত ব্রিটিশদের হাত ধরে এই অঞ্চলে ক্রিকেটের প্রসার ঘটে। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ঢাবির ছাত্রদের সঙ্গে ব্রিটিশদের সৌখিন ক্রিকেটের কিছু কিছু ইতিহাস পাওয়া যায়। ১৯৩০ সালের দিকে ঢাবির একটা ক্রিকেট দল ছিল। অবিভক্ত বাংলায় ১৯৩৫ সালের রঞ্জি ট্রফিতে প্রথম ‘বাংলা’ নামে একটা ক্রিকেট দল অংশ নেয়। ওই দলে বর্তমান বাংলাদেশের কিছু ক্রিকেটার ছিলেন। ইতিহাসে আমাদের কোন সুগঠিত ক্রিকেট দল বললে এই দলকেই প্রথমে স্থান দিতে হয়। দেশ বিভাজনের পর বাংলা ভেঙ্গে ‘পশ্চিম বঙ্গ’ দল হয়ে যায় এবং সেই নামেই এখনও খেলছে। ১৯৫৪-৫৫ মৌসুমে পূর্ব বাংলা’ নামে একটা নতুন দল গঠন করা হয়। সে দল তৎকালীন পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের আসর কায়েদ-এ-আজম ট্রফিতে অংশ নেয়। ঠিক এক বছর পর দলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান ক্রিকেট দল’ এবং এই নামেই ১৯৬৭-৬৮ পর্যন্ত প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অংশ নিত। মূলত আজকের বাংলাদেশের জাতীয় দল পূর্ব পাকিস্তান ক্রিকেট দলেরই উত্তরসূরি। স্বাধীনতার আগে বাঙালীদের মাঝে সফল ক্রিকেটার ছিলেন রকিবুল হাসান। বাঙালীদের ভেতর কেউ টেস্ট খেলার সুযোগ পাননি। তবে স্কোয়াডে ছিলেন রকিবুল হাসান। তিনবার তিনি টেস্টে দ্বাদশ প্লেয়ার ছিলেন। মেধার ভিত্তিতে হোক আর একজন বাঙালীকে টেস্ট দলে রাখার কারণেই হোক রকিবুলের টেস্ট খেলার জোরালো সম্ভাবনা ছিল ১৯৭১ সালে। ১৯৭০-এর নির্বাচনের পর পাকিস্তান দলের সবার ব্যাটে জুলফিকার আলি ভুট্টোর নির্বাচনী প্রতীক তলোয়ারের স্টিকার লাগানো ছিল। শুধু রকিবুলের ব্যাটে ছিল ব্যতিক্রম। তার ব্যাটে লাল রং দিয়ে ‘জয় বাংলা’ লিখে মাঠে নামলেন। ফলাফল যা হওয়ার তাই হলো। রকিবুলের আর কোন দিন টেস্ট তো দূরের কথা দলেই তার আর ফেরা হয়নি। বাদ পড়েছিলেন পরের ম্যাচেই। ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ সালের এই আনঅফিসিয়াল টেস্টে রকিবুল ছিলেন ওপেনার, এই ম্যাচ অবশ্য শেষ হয়নি। উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ম্যাচ বাতিল হয়েছিল। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলে খেলেছেন এমন কয়েক খেলোয়াড় হলেন রকিবুল হাসান, আশরাফুল হক এবং শফিউল হক। শহীদ জুয়েল এবং শহীদ মুস্তাক ছিলেন ক্রিকেটের অন্য দুই তারকা। শহীদ জুয়েল একজন মারকুটে উইকেট কিপার ব্যাটসম্যান ছিলেন, বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ের জন্য সুনাম ছিল তার। কিন্তু মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি এবং আরও অনেক ক্রিকেটার যুদ্ধে অংশ নেন, যার ভেতর পপসম্রাট আজম খান অন্যতম। শহীদ জুয়েলের স্বপ্ন ছিল তিনি বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলে খেলবেন। ২৯ আগস্ট ১৯৭১ সালে আলবদর বাহিনীর দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে জুয়েল পাকিস্তানী আর্মির হাতে ধরা পড়েন। পরবর্তীতে ক্যান্টনমেন্টের কাছাকাছি কোন এক হোস্টেলের ছোট এক রুমে নির্যাতনের শিকার হয়ে শহীদ হন। তার মৃতদেহও উদ্ধার করা যায়নি। স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে মৌলিক চাহিদা মেটানোই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। খেলাধুলা নিয়ে ভাবার সময় কোথায়। কিন্তু এর মাঝেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রকিবুল হাসানকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন দল গোছাতে। যথনই দেশ কিছুটা স্থিতিশীল হতে শুরু করল তখনই নেমে এলো বাংলার আকাশে কালো ছায়া। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সেই ভয়াবহ রাত। বাঙালী জাতীকে আবার পেছনে নিয়ে গেল। দেশ পুনরায় ভাঙ্গার পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট গুটি গুটি পায়ে এগোতে শুরু করে ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে। এমসিসির একটা দল বাংলাদেশ সফরে আসে। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল রাজশাহীতে তাদের সঙ্গে দুই দিনের একটা ম্যাচ খেলে। প্রচুর দর্শক হয়েছিল মাঠে। এবারেও দর্শকের উপস্থিতি জানান দেয় ক্রিকেট আমরাই খেলব। এদেশ একদিন বিশ্ব ক্রিকেটে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। এরপর ১৯৭৭ সালে এমসিসির একটা দল পুনরায় বাংলাদেশে সফর করে। ক্রিকেটের তৎকালীন নিয়ন্ত্রক এমসিসি ১৯৭৯ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফিতে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করে। এখানেই বাংলাদেশ প্রথম জয় পায় ক্রিকেটে, ফিজিকে ৭৯ রানে অলআউট করে। ১৯৮৬ সালে সাউথ এশিয়ান ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশিপে হংকংকে হারিয়ে এশিয়া কাপে খেলার সুযোগ পায় বাংলাদেশ। সেখানেই পাকিস্তানের সঙ্গে নিজেদের প্রথম এক দিনের ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ। ’৮৬-এর এশিয়া কাপের পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি বাংলাদেশকে। ’৮৮ এশিয়া কাপ বসল বাংলাদেশে, ঘরের মাটিতে প্রথম বহুজাতিক টুর্নামেন্ট, দেশের মাটিতে প্রথম ওয়ানডে ক্রিকেট। এ ছাড়া এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল আয়োজিত এশিয়া কাপ ছিল বাংলাদেশের সর্বোচ্চ টুর্নামেন্ট। বাংলাদেশ ১৯৮৬, ১৯৮৮, ১৯৯০-৯১, ১৯৯৫ এবং ১৯৯৭ সালের এশিয়া কাপে অংশ নেয়। সহযোগী দেশ হলেও সে সময় এমন বড় আসরে অংশ নেয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ ক্রিকেট একটা বড় গ্রহণযোগ্যতা পায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনে। সে সময় এশিয়া কাপ চার দলের হতো। তিন টেস্ট খেলুড়ে দেশ এবং বাংলাদেশ। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ১৯৭৯, ‘৮২, ‘৮৬, ‘৯০, ‘৯৪ সালের আইসিসি ট্রফিতে অংশ নেয় এবং ১৯৯৭ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়। বাংলাদেশ কেনিয়াকে পরাজিত করে আইসিসি ট্রফি জেতে এবং ওয়ানডে স্ট্যাটাস পায়। পাশাপাশি হাতে আসে বিশ্বকাপে খেলার টিকেট। সেদিন ছিল ক্রিকেটে বাঙালী জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন। সারাদেশ উৎসবমুখর হয়ে উঠেছিল। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই নেমে এসেছিল রাস্তায়। এ যেন আরেক স্বাধীনতা। বাঙালী জাতির দেশপ্রেম সেদিন দেখা দিয়েছিল আরেকবার। রঙের মাখামাখিতে আর মিছিলে রঙিন হয়েছিল বাংলাদেশ। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের কিলাপ কিলাপ স্টেডিয়ামে ইউনিভার্সিটি অব কুয়ালালামপুর মালয়েশিয়ার প্রবাসী বাঙালী ছাত্ররা জয়ের পর ব্যানার উঁচিয়ে ধরেছিল, ‘বাংলাদেশ নেক্সট টেস্ট প্লেয়িং নেশন।’ আইসিসি ট্রফি উঁচিয়ে ধরেছিলেন বিজয়ী বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক আকরাম খান। তুমিসহ তোমাদের দল হয়ে রইলে আমাদের নয়নের মণি, তৈরি করলে ইতিহাস। এর নেপথ্যে কিছু মানুষ কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্রিকেটকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। তিনি একজন যোগ্য মানুষ খুঁজছিলেন যার হাতে ক্রিকেটের উন্নয়ন সাধিত হবে। দায়িত্ব দিলেন সাবের হোসেন চৌধুরীকে। তিনিও দায়িত্ব শতভাগ পালন করলেন নিষ্ঠার সঙ্গে। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পরে প্রথম বোর্ড মিটিংয়ে তিনি তার ইচ্ছার কথা জানিয়ে একটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার কথা জানান সবাইকে। টেস্ট স্ট্যাটাসের জন্য প্রথম প্রকাশ্যে নিজের পরিকল্পনার কথা বলেন। তখন কোচ হিসেবে আনা হয় গর্ডন গ্রিনিজকে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের অকৃত্রিম বন্ধু বলা হয় জগমোহন ডালমিয়াকে। তিনি সেই সময় ছিলেন আইসিসি প্রেসিডেন্ট। তিনি বাংলাদেশের ব্যাপারে অত্যন্ত আশাবাদী ছিলেন। স্বাধীনতার ২৫ বছর উপলক্ষে বাংলাদেশে আয়োজন করা হয় ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান অংশ নেয়। তারপর বাংলাদেশে আয়োজন করা হয় প্রথম আইসিসি নকআউট বা মিনি বিশ্বকাপ। আট দলের টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ খেলেনি। এই টুর্নামেন্টে আবারও প্রমাণ করে দেয় বাংলাদেশে ক্রিকেট কতটা জনপ্রিয়। মাঠভর্তি দর্শক খেলার আর্থিক বিষয়গুলা ফুটিয়ে তোলে। বাংলাদেশ সেদিন আয়োজনের দায়িত্ব পেয়ে নিজেদের প্রমাণ করেছিল আমরা বৈশ্বিক ক্রিকেটের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। ক্রিকেটকে অনেক সাহিত্যক সাহিত্য হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ক্রিকেট অনেক লম্বা সময়ের খেলা বলে অনেকে এর বিপক্ষে অবস্থান নেয়। আবার ক্রিকেটকে সে অর্থে বৈশ্বিক খেলাও বলা যায় না। কেননা বিশ্বে হাতেগোনা কয়েকটি দেশই ক্রিকেট খেলে। তবুও ক্রিকেট নিয়ে যত সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে অন্য খেলায় তার চেয়ে অনেক কম। ক্রিকেটের পর সাহিত্য সৃষ্টিতে বক্সিং খেলা দ্বিতীয়। ক্রিকেট সাহিত্যের জনক বলা হয় নেভিল কার্ডাসকে। সঙ্গীত আর ক্রিকেট এই দুই-ই ছিল এই ইংরেজ লেখকের ধ্যান-জ্ঞান। তৎকালীন সামাজিক রীতি অনুযায়ী তিনি ছিলেন মায়ের অবৈধ সন্তান। নিজের জনকের পরিচয় জানা না গেলেও নিজে অমর হয়ে আছেন ‘ক্রিকেট সাহিত্যের জনক’ হিসেবে। ক্রিকেটের অমর ধারা ভাষ্যকার জন আর্লট বলেন, ‘কার্ডাসের আগে ক্রিকেট শুধু রিপোর্ট করা হতো। তিনিই প্রথম এটিকে অনুভব করে, ভালোবেসে, কল্পনাশক্তিযোগে তা বর্ণনা করেছেন।’ ক্রিকেট সাহিত্যের জনক নেভিল কার্ডাসের উল্লেখযোগ্য বইসমূহ হচ্ছে সেকেন্ড ইনিংস, গুড ডেইজ, ক্রিকেট অল দ্য ইয়ার, ডেইজ ইন দ্য সান, ক্লোজ অব পে, অস্ট্রেলিয়ান সামার। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার সেরা ক্রিকেট লেখক হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত রবিনসন ছিলেন খুঁটিনাটি সব বিষয়ে অসম্ভব রকম খুঁতখুঁতে। রবিনসনের কলমে চিত্রিত ক্রিকেটাররা যেন রক্তমাংসের মানুষ হয়ে হাজির হয় পাঠকের চোখের সামনে। রে রবিনসনের ‘ম্যাগনাস ওপাস’ বলে মানা হয় যে বইটিকে, সেই অন টপ ডাউন আন্ডার-এর চমৎকার উদাহরণ। বইয়ের বিষয় এমন অভিনব কিছু নয়, অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট অধিনায়কদের পরিচিতি। কিন্তু সেটিই অন্য মাত্রা পেয়ে গেছে রবিনসনের কল্যাণে। বছরের পর বছর পরিশ্রম করে তাদের সম্পর্কে এমন সব খুঁটিনাটি তথ্য জোগাড় করেছেন যে চেনা ক্রিকেটাররাও নতুন রূপে চোখের সামনে নেচে বেড়ায়। অন টপ ডাউন আন্ডার অবশ্যই রবিনসনের সবচেয়ে বিখ্যাত বই, তবে তার সেরা বই বিটুইন উইকেটস। ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত এই বই, অথচ এখনও যুগোপযোগী। কাব্যরসের বিবেচনায় নেভিল কার্ডাসের পরই হয়ত আসবে এ্যালান রসের নাম। রসের লেখায় কাব্যরস থাকাটাই স্বাভাবিক, কারণ তিনি ছিলেন জাত কবি। ক্রিকেট বিষয়ক বইয়ের আগেই প্রকাশিত হয়েছে তার কাব্যগ্রন্থ। অস্ট্রেলিয়া ফিফটি ফাইভ ও অস্ট্রেলিয়া সিক্সটি থ্রি নামে এ্যালান রসের বই দুটি ক্রিকেট সফর নিয়ে লেখা বই। বলা হয়ে থাকে, এ্যালান রস অবসর নেয়ার পরই আসলে ক্রিকেট সাহিত্যের মৃত্যু হয়েছে। ইংলিশ ক্রিকেট লেখকদের মধ্যে রয়েছেন ফ্র্যাঙ্ক কিটিং ও মার্টিন জনসন। এবার উপমহাদেশের লেখকদের কথায় আসি। ভারতীয় ক্রিকেট লেখকদের মধ্যে কেএন প্রভুর বেশ সুনাম ছিল। মুদার পাথেরিয়া লেখনীর গুণে আজও বেঁচে আছেন ক্রিকেটপ্রেমীদের নিকট। শঙ্করীপ্রসাদ বসুই প্রথম লেখেন বাংলাভাষাতে। ক্রিকেট যে শুধু ৩০ গজের পিচ, রান আর উইকেটেই শেষ নয়, আরও বেশি কিছু তা শঙ্করীপ্রসাদ বসুর রমণীয় ক্রিকেট, ইডেনে শীতের দুপুর, ক্রিকেট সুন্দর ক্রিকেট ইত্যাদি বইতে পাওয়া যায়। ক্রিকেট লেখায় দারুণ সব পরিভাষা ব্যবহার করে তিনি ক্রিকেটকে অনন্য এক সাহিত্যে পরিণত করেছেন। পরবর্তীকালে মতি নন্দীর সংস্পর্শে আরও আধুনিক হয়েছে। বাংলাদেশের লেখকদের মধ্যে রয়েছেন বদরুল হুদা চৌধুরী। ‘তবু ক্রিকেট ভালবাসি’ নামক বইটি ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত প্রথম সাহিত্য। এরপর ‘দুটি ব্যাট একটি বল’ ও ‘রূপে রসে ক্রিকেট’ নামে আরও দুটি বই লিখেন। জালাল আহমেদ চৌধুরী কিছুটা সময় লিখে গেছেন। তবে তার লেখনীতে শঙ্করীপ্রসাদ বসুর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তারপর আসেন রঞ্জিত বিশ্বাস। তবে ওনারা ফরমায়েশি লেখালিখে গেছেন। সবাই লিখেছেন খবরের কাগজে। কেউ বই লেখার দায়িত্বটা নিতে চাননি। সে জন্য ইতিহাসেও হয়ত তাদের খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে। যাহোক সময় বদলাচ্ছে। সেই সঙ্গে পরিবর্তন হচ্ছে ক্রিকেটেরও। আজ টি টুয়েন্টি ক্রিকেট সময়ের চাহিদা। একটা সময় ছিল যখন ক্রিকেট খেলতে এক দেশের খেলোয়ার অন্য দেশে যেতেন জাহাজে করে। সফরে যুক্ত হতেন ক্রিড়া সাংবাদিকেরা। খেলোয়ারদের সঙ্গে গল্প করতে করতেই পেয়ে যেতেন সমস্ত খবর। আজ একবিংশ শতাব্দিতে এসে এত সময় কারো নেই। ক্রিকেটাররাও আজ এ দেশের ভেন্যুতে খেলা তো কাল অন্য দেশে টি টুয়েন্টির একটি ম্যাচ। ক্রিকেট পরিণত হয়েছে প্রচ- রকমের গাণিতিক খেলায়। আবহাওয়ার কন্ডিশন দেখে স্কোয়াড গঠন। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তি। প্রতিটি বলারের মুভমেন্ট, বলিং স্টাইল নিয়ে রীতিমত ক্লাস করতে হয়। এই পরিবর্তিত সময়ে চলছে ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসর বিশ্বকাপ ক্রিকেট। ইংল্যান্ডের মাটিতে দশটি দেশকে নিয়ে এবারের আসর সেজেছে একটু ভিন্নভাবে। তথাকথিত গ্রুপ পর্ব বাদ দিয়ে প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের খেলা দিয়ে প্রথম রাউন্ড সাজানো হয়েছে। এতে করে ক্রিকেট উৎসবটাও মনে হচ্ছে জমেছে বেশ। যদিও বৃষ্টি এবারের আসরে একটা শক্ত অবস্থানে রয়েছে। চারটি ম্যাচে বৃষ্টি জিতেছে। অনেকগুলো ম্যাচে নানাভাবে আক্রমণ করার চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশও এ আক্রমন তেকে রেহাই পায়নি। শ্রীলংকার সঙ্গে বাংলাদেশের ম্যাচটি হলে আজ সেমিফাইনালে যাওয়ার পথটুকু হয়তো আরও একটু সহজ হতো। এখন আমাদের তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে ইংল্যান্ডের হারের দিকে। তবে সব থেকে বড় অর্জন হচ্ছে সাকিবের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের অবস্থান ধরে রাখা। এ ছাড়া সব থেকে বেশি রান করা ব্যাটসম্যানদের কাতারেও তিনি। বিশ্বক্রিকেটে আজ আমাদের জয়জয়কার। পৃথিবীর যে প্রান্তেই খেলা হোক না কেন খেলোয়াড়দের সমর্থন করার জন্য গ্যালারিতে আমাদের উপস্থিতি থাকে চোখে পড়ার মতো। এই যে আবেগ, ভালবাসায় সিক্ত হয়েছে আমাদের ক্রিকেট, সে ভালবাসার প্রতিদানও দিয়েছে মাশরাফির টাইগার বাহিনী। আমরা এখনও আশাবাদী। জয়তু টিম বাংলাদেশ।
×