ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পুরস্কারে সিক্ত উদ্যোক্তা উরসী

প্রকাশিত: ০৭:৩৮, ২৮ জুন ২০১৯

পুরস্কারে সিক্ত উদ্যোক্তা উরসী

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই দেশের শহুরে জনগোষ্ঠী ভাগ্যের কিছুটা উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু এখনও অনেক জায়গার গ্রামীণ জনগোষ্ঠী দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে। সরকারের পাশাপাশি কিছু মানুষ সেই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের একজন উরসী মাহফিলা ফাতেহা। যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর লেখাপড়ার পাশাপাশি পরিবারের কাছ থেকে সামান্য পুঁজি নিয়ে একটি ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করেন। সমান তালে চালিয়ে যান লেখাপড়া ও ব্যবসা। ধীরে ধীরে হয়ে উঠেন একজন উদ্যোক্তা। সাফল্যের সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। সঙ্গে গড়ে তুলেন শী’জ নামে একটি হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠান, যার মাধ্যমে এখন দেড় হাজারের অধিক গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান তৈরি করেছেন তিনি। তার দৃষ্টিতে, একটি দেশের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য সে দেশের সকল জনগোষ্ঠীর, বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়ন জরুরী। সে লক্ষ্যেই নিরলসভাবে দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। উরসীর উদ্যোক্তা হিসেবে পথচলা শুরু হয় ২০০৬ সালে। পরিবার থেকে মাত্র ২০০০ টাকা নিয়ে তার মায়ের সহযোগিতায় একটি ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করেন। তখন থেকেই তিনি চিন্তা করতেন নিজে কিছু করবেন, সঙ্গে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সহযোগিতা করবেন। সেই চিন্তা থেকেই হস্তশিল্পের কাজ শুরু“করেন। শুরু“করেন জীবনের নতুন যুদ্ধ। প্রথমে হ্যান্ডপ্রিন্টের শাড়ি তৈরি করেন। এরপরে তা নিজেদের মধ্যে বিক্রয় করেন। প্রথম দিকে নিজেই শাড়ির কাজ করতেন। পরবর্তীতে কয়েকজন নারীকর্মী সঙ্গী হিসেবে নেন। প্রাথমিক পর্যায়ে তাকে নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। তার অদম্য ইচ্ছা ও একনিষ্ঠ কর্মম্পৃহার কারণে কোন প্রতিকূলতাই তাকে থামাতে পারেনি। ধীরে ধীরে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অর্ডার আসতে শুরু“করে। বাড়তে থাকে কাজের পরিধি। সঙ্গে বাড়াতে থাকেন লোকবল। আস্তে আস্তে এগিয়ে চলেন স্বপ্নের পথে। এরপর তিনি চিন্তা করে তার স্বপ্নের একটা নাম দেয়া দরকার। অনেক ভেবে সেই স্বপ্নের নাম দিলেন শী’জ। উরসীর গড়ে তোলা শী’জ বাংলাদেশের একটি হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানে সূচীকর্মের পাশাপাশি শাড়ি, থ্রি-পিস, কুর্তি, ফতুয়া, পাঞ্জাবি, ওড়না, লেডিসকটি, শাল, বাচ্চাদের পোশাক, নকশীকাঁথা, উপহার সামগ্রী, গৃহসজ্জা, কাঠের সামগ্রী, অলঙ্কার ও পাটের বিভিন্ন নান্দনিক পণ্য তৈরি হয়। এখানকার প্রতিটি পণ্যে দেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নানা উপাদান ব্যবহার করে শতভাগ বাঙালীয়ানা ফুটিয়ে তোলা হয়। প্রতিষ্ঠানটি দাঁড় করার পরে উরসী চিন্তা করেন কর্মীদের দক্ষতা নিয়ে। সেই চিন্তার ধারাবাহিকতায় উদ্যোক্তা গ্রামীণ তৃণমূল নারীদের সংগঠিত করে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষতা বৃদ্ধি করে স্বাবলম্বী হতে সহযোগিতা করেন। শী’জ-এর মাধ্যমে কর্মীদের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। প্রশিক্ষণগুলোর মধ্যে সূচীকর্মের কাজ, হ্যান্ডপ্রিন্ট, ব্লক বাটিক, ভেজিটেবল ডাইং, স্কিন প্রিন্ট, টেইলারিং, নকশীকাঁথা সেলাই অন্যতম। শী’জ-এর মাধ্যমে যে সকল পণ্য তৈরি হয়, তা দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নানা স্থানে বিক্রয় করা হয়। পাশাপাশি নেপাল, ভারত, চীন, জাপান, আমেরিকা, কানাডাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও এগুলো রফতানি করা হয়। এ লক্ষ্যে উদ্যোক্তা স্বীয় উদ্যোগে দেশের তৈরি পণ্য দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন মেলাতে প্রদর্শন ও বিক্রয় করছেন। বিশেষ করে বাংলাদেশ, নেপাল, ভারত, চীনসহ বিভিন্ন দেশের হস্তশিল্পের মেলাগুলোতে অংশগ্রহণ করেন তিনি। প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে ২৫ জন স্থায়ী নিয়োজিত আছেন। আর ২০ জন সুদক্ষ সুপারভাইজার প্রান্তিক পর্যায়ে নারী কর্মীদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের কাজগুলো সুনিপুণভাবে করিয়ে নেন। এসব সুপারভাইজারদের অধীনে কর্মরত কর্মীসহ সব মিলিয়ে বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির অধীনে দেড় হাজারের অধিক কর্মী নিয়োজিত রয়েছে, যাদের সিংহভাগই গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠী। এদের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে প্রতি মুহূর্ত উরসী কাজ করে যাচ্ছেন। তার মাধ্যমে বিভিন্ন দুস্থ অসহায় স্বামী পরিত্যক্ত, গ্রামের দরিদ্র নারীরা কর্মের সন্ধান পেয়েছে। মিলেছে তাদের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং হয়েছে সচেতন। পরিবারে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। এতে করে নিজেদের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন। তার এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নারীদের অর্থনৈতিক উন্নতির ফলে বিভিন্ন এলাকায় নারী শিক্ষার অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে সর্বদা গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন উরসী। ১৩ বছর যাবত গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান তৈরি ও তাদের সঞ্চয়ী করে তোলার লক্ষ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছেন তিনি। এসব কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ইতোমধ্যেই উরসী ২০১৬ সালে জেলা পর্যায়ে এবং ২০১৭ সালে বিভাগীয় পর্যায়ে ‘শ্রেষ্ঠ জয়িতা’ সম্মাননা পেয়েছেন। শেরে বাংলা একে ফজলুল হক রিসার্চ সেন্টার থেকে নারী ক্ষমতায়নে অবদান রাখার জন্য ‘ওমেন্স শাইনিং পারসোনালিটি এ্যাওয়ার্ড-২০১৯ পেয়েছেন। আনন্দ ভুবন পুরস্কার (ফ্যাশন ডিজাইনার)-২০১৯ পেয়েছেন।
×