ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জমিদার বাড়ির পথে...

প্রকাশিত: ০৭:৩৫, ২৮ জুন ২০১৯

জমিদার বাড়ির পথে...

কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলছে আমাদের তিস্তা এক্সপ্রেস। সেই কাক ডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠেছি তাই নিদ্রা দেবী মাঝে মধ্যেই ভর করছেন। তারপরও ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য অবলোকনের চেষ্টা। ট্রেন তার ছন্দে এগিয়ে চলছে। প্রায় চল্লিশ মিনিট পর আমরা এসে পৌঁছালাম বিমানবন্দর স্টেশনে। সেখানে আমাদের যাত্রাপথে যুক্ত হলেনÑ আরও অনেকেই। ও বলা হলো না আমরা যাচ্ছি ময়মনসিংহ ভ্রমণে। আমার ছোট ভাই পিকু পড়াশোনার সূত্রে সেখানকার বাসিন্দা। অনেকদিন ধরেই বলছিল ওর বাসায় যাবার জন্য, কিন্তু সময়ের অভাবে যাওয়া হয় না। শেষ পর্যন্ত আমি আর আমার সব সময়ের ভ্রমণসঙ্গী মা রওনা দিয়েছি ময়মনসিংহের দিকে। এর আগেও একবার গিয়েছিলাম ময়মনসিংহে। তবে তখন খুব কম সময় ছিল বিধায় তেমন একটা ঘুরতে পাড়িনি। চলতি পথে অনুভব করলাম পেটে কিছু দেয়ার সময় হয়ে গেছে। কিন্তু কি খাব অপেক্ষা করছি কখন কিছু নিয়ে আসবে খাবার। শুধু একটু পরপর চা, পান, সিগারেট নিয়ে আসছে। যার কিচ্ছুই আমি খাই না। মেজাজটা খারাপই লাগছিল শেষ পর্যন্ত একজন আবির্ভূত হলেন গরম গরম সিঙ্গারা আর সমুচা নিয়ে। দেখেই জিভে জল আসার জোগাড়। হকারের কাছ থেকে সিঙ্গারা, সমুচা দুটোই নিলাম বিটলবণ, সালাদ দিয়ে পরিবেশন করা হলো, যা বেশ সুস্বাদু। পথের দূরত্ব ঘুচিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম ময়মনসিংহে। স্টেশনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল পিকু। স্টেশন থেকে আমরা গেলাম পিকুর আকুয়া ওয়ারলেসের বাসায়। সেখানে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম নতুন গন্তব্যের দিকে। প্রথমে গেলাম টাঙ্গাইল বাসস্ট্যান্ডে সেখান থেকে সিএনজি অটোরিক্সাতে চেপে বসলাম মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ির দিকে। যাত্রাপথের প্রাকৃতিক দৃশ্য আমাদের মোহিত করল। আমরা এসে পৌঁছলাম জমিদার বাড়ির প্রবেশ দ্বারে। পুরনো দিনের স্থাপত্য কর্ম দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। আমরা পদব্রজে সামনের দিকে এগিয়ে চললাম। প্রায় ১০০ একর জায়গার ওপর নির্মিত এই রাজবাড়ীটি প্রাচীন স্থাপনাশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন। রাজবাড়ীর প্রবেশমুখের কাছেই দেখা পেলাম রাজ রাজেশ্বরী মন্দির। এখানে নিয়মমতো পূজা করা হয়। দুপুর বেলায় মন্দিরের দ্বার বন্ধ ছিল তাই দেবী দর্শন হলো না। জানা গেল এখানকার কষ্টিপাথরের বিগ্রহ চুরি হয়ে গেছে। পূজামণ্ডপের মেঝে মূল্যবান মার্বেল টাইলস বিছানো ছিল, লোপাট হয়েছে সেগুলোও। এমনকি বাদ যায়নি দরজা-জানালার কপাটও। কথিত আছে, মন্দির থেকে হাতের ডান পাশেই ছিল ফাঁসির ঘর। এখানে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো অপরাধী এবং অবাধ্য প্রজাদের। এই ঘরের সামনে ছিল একটি বড় গর্ত, যা এখন ভরাট অবস্থায় আছে। এই গর্তেই ফেলে দেয়া হতো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া লাশগুলো। গর্তের সঙ্গে ছিল ব্রহ্মপুত্র নদের যোগসূত্র। জোয়ারের পানিতে ভেসে যেত ওইসব লাশ। একটু পরই দেখা পেলাম লোহার পাত আর কাঠের পাটাতন দিয়ে করা চমৎকার ছাদ। তাছাড়া লোহার পাতের নানা রকম নক্সা এ বাড়ির চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। পিকু মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ির ইতিহাস সম্পর্কে বলল, জমিদার আচার্য চৌধুরী বংশ মুক্তাগাছা শহরের গোড়াপত্তন করেন। আচার্য চৌধুরী বংশ শহরের গোড়াপত্তন করে এখানেই বসতি স্থাপন করেন। আচার্য চৌধুরী বংশের প্রথম পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরী ছিলেন বগুড়ার বাসিন্দা। তিনি মুর্শিদাবাদের দরবারে রাজস্ব বিভাগে কর্মরত ছিলেন। তিনি ছিলেন নবাবের খুবই আস্থাভাজন। নবাবের দরবারে রাজস্ব বিভাগে কর্মরত থাকা অবস্থায় ১১৩২ সালে তিনি সেই সময়ের আলাপসিং পরগনার বন্দোবস্ত নিয়েছিলেন। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর নানা কারণে শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরীর ৪ ছেলে বগুড়া থেকে আলাপসিং-এ এসে বসবাসের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরীর এই ৪ ছেলে হচ্ছে রামরাম, হররাম, বিষ্ণুরাম ও শিবরাম। বসতি স্থাপনের আগে তারা এ পরগনার বিভিন্ন স্থান ঘুরেফিরে দেখেন এবং বর্তমান মুক্তাগাছা এলাকায় বসতি স্থাপনের জন্য মনোস্থির করেন। সে সময়ে আলাপসিং পরগনায় খুব একটা জনবসতি ছিল না। চারদিকে ছিল অরণ্য আর জলাভূমি। শ্রীকৃষ্ণ আচার্যের ৪ ছেলে ব্রহ্মপুত্র নদের শাখা নদী আয়মানের তীরবর্তী স্থানে নৌকা ভিড়িয়েছিলেন। এই বাড়িতে ১৯৪৫ সালে উপমহাদেশের প্রথম ঘূর্ণায়মান নাট্যমঞ্চ স্থাপন করেছিলেন নাট্যপ্রেমী জমিদার জীবন্দ্র কিশোর আচার্য চৌধুরী, যা তাদের আভিজাত্যের পরিচয় বহন করে। আমরা ভগ্ন অবস্থায় দোতালা একটি ঘর দেখাতে পেলাম। পিকু বলল শোনা যায়, গরমের দিনে প্রাকৃতিকভাবেই বাইরে দিয়ে ঘামিয়ে ভেতরে ঘরকে রাখত ঠাণ্ডা। আমরা এগিয়ে চলছি এই রাজবাড়ির ভেতরে আরও আছে জমিদারের মায়ের ঘর, অতিথি ঘর, সিন্দুক ঘর। এ সিন্দুকের ঘরেই জমিদারের সোনাদানা, টাকা-পয়সাসহ অন্যান্য মূল্যবান জিনিস জমা থাকত। জমিদার আর তাঁর স্ত্রী থাকতেন দ্বিতল ধরনের একটি বাংলোতে। জমিদার জগৎ কিশোর আচার্য চৌধুরী বেশ জ্ঞানচর্চা করতেন। তাঁর ছিল একটি ব্যক্তিগত লাইব্রেরি, নাম ‘জিতেন্দ্র কিশোর গ্রন্থাগার’। ধারণা করা হয়, তৎকালীন পূর্ববঙ্গের সবচেয়ে বৃহৎ লাইব্রেরি ছিল এটি, বইয়ের সংগ্রহ ছিল প্রায় ১০ হাজারের মতো। তালপাতায় লিখিত পুঁথি থেকে শুরু“করে এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকার মতো বহু দুর্লভ বইয়ের সংগ্রহ ছিল এখানে। কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন সময়ে বইগুলো নষ্ট গেছে, তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মুক্তিযুদ্ধের সময়। পরবর্তীকালে এই বইগুলো মুক্তাগাছা সংগ্রহ নামে বাংলা একাডেমিতে স্থানান্তর করা হয়। জমিদারের ছোট ছেলে ভূপেন্দ্র ছিল একজন নাট্যপ্রিয় মানুষ। তারই নামানুসারে জমিদার নির্মাণ করেন ‘ভূপেন্দ্র রঙ্গ পীঠ’। এটি একটি ঘূর্ণায়মান মঞ্চ ছিল, তবে বর্তমানে তার কোন অস্তিত্ব নেই। এত বছর আগে ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চের মতো টেকনোলজিক্যাল স্টেজ, যা সত্যিই আমাদের অবাক করে। রাজবাড়ির শেষের দিকের ভেতরবাড়ি পার হলেই একটি ছোট পুকুর ছিল। এখন তা ভরাট হয়ে গেছে। এর পরেই আছে রাজবাড়ির সীমানাপ্রাচীর। রাজবাড়ির মূল ফটকের সামনেই রয়েছে সাত ঘাটের বিশাল পুকুর। প্রতিটি ঘাটই বাঁধানো। পুকুরের পাশেই দুর্লভ প্রজাতির নাগলিঙ্গম বৃক্ষ রয়েছে। সেই গাছে এখনও ফুল ফোটে, আগন্তুকদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। আমরা পুকুর ঘাঁটে গিয়ে বসি, সেখানে কিছু সময় বসে আমরা ফিরে চলার প্রস্তুতি নিচ্ছি এর মাঝে পিকু বলল এতদূরে এলে কিন্তু এখানের বিখ্যাত মণ্ডা না খেলে কি হয়। আমরা পাশের গোপাল মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে গেলাম সেখানে মণ্ডার স্বাদ গ্রহণ করে এগিয়ে চললাম শহরপানে। কিভাবে যাবেন : ঢাকার মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে ভোর ৫টা থেকে প্রতি আধা ঘণ্টা পরপর ময়মনসিংহের উদ্দেশে সৌখিন, এনা, নিরাপদ বাস ছেড়ে আসে। টিকেটের মূল্য ২২০ টাকা। সময় লাগবে ২ ঘণ্টা অথবা সকাল ৭টা ৩০ মিনিটের তিস্তা এক্সপ্রেস করে ময়মনসিংহে ঘুরে আবার ৫টা ২০ মিনিটের ট্রেনে ফিরে যেতে পারেন ঢাকাতে। ট্রেনের ভাড়া ১২০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা। এরপর যেতে হবে টাঙ্গাইল বাসস্ট্যান্ডে সেখান থেকে সিএনজিতে যেতে পারবেন মুক্তাগাছা জমিদারবাড়ি। [email protected]
×