ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শুভেন্দু এস ভট্টাচার্য শঙ্কর

ইন্দোনেশিয়ায় কয়েকদিন

প্রকাশিত: ০৭:৩৩, ২৮ জুন ২০১৯

ইন্দোনেশিয়ায় কয়েকদিন

কিছুদিন আগে ইন্দোনেশিয়া গিয়েছিলাম। সফরের প্রথম পর্যায়ে যে বিষয়গুলো আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল তারই এক সংক্ষিপ্ত বর্ণনা এই লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে। জাকার্তা সুকর্ণ-হাত্তা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার পর থেকে প্রথম যে জিনিসটা আমার মনে ছোঁয়া দিল, তা হলো- এদের বিনয় ও ভদ্রতা। যে দেশেই গেছি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখেছি ইমিগ্রেশন পুলিশের পাথরে বাঁধানো মুখ, নির্বিকার চাহনি, কেমনে ফাঁক-ফোকর বের করে আটকানো যায়। আর বাংলাদেশী সবুজ পাসপোর্ট দেখলে তো পাথরও লোহা হয়ে যায়। কিন্তু এখানে দেখলাম ভিন্ন চিত্র। আমাকে চোখে পড়া মাত্রই একটা স্মাইল ও কিছুটা নড করার ভঙ্গিতে পুলিশ কাউন্টার থেকে সাগ্রহে আমার পাসপোর্ট নিল। ইন্দোনেশিয়ায় সাধারণত এয়ারপোর্টে অন এরাইভাল ভিসায়ই বেশির ভাগ পর্যটকরা আসে। কিন্তু আমি দেশ থেকে ভিসা নিয়ে আসায় একটু সমীহের দৃষ্টিতে কোন বাক্য ব্যয় না করে কাজ সেরে পুনরায় দাঁড়িয়ে অবনত মস্তকে পাসপোর্ট ফেরত দিল। আমার মনে হলো, এই বিনয় প্রকাশ একদিকে যেমন এদের সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়েছে অন্যদিকে সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ সরকারের কর্মকাণ্ডে দেশের ভাবমূর্তি পরিবর্তনেরও প্রতিফলন ঘটেছে। ইমিগ্রেশন থেকে বের হয়ে লাগেজ নিতে যাওয়ার পথে স্থানীয় যে স্টাফের সঙ্গেই দৃষ্টি বিনিময় হয় সেই দেখি এই একই অধোমুখী স্মাইল দিয়ে সম্ভাষণ জানাচ্ছে। এয়ারপোর্ট থেকে বাহির হওয়ার পর ট্যাক্সি ড্রাইভারেরও একই কায়দায় শুভেচ্ছা জ্ঞাপন। ট্যাক্সিতে যেতে যেতে মনে হলো, এই হাসিমাখা অবনত মস্তকে বরণের মধ্যে কোন কৃত্রিমতার ছাপ নেই। এটা তাদের মজ্জাগত আচরণ, হৃদয়ের উষ্ণতার প্রকাশ, সংস্কৃতিরই অংশ। এয়ারপোর্টের বাহিরে দেখি পুরো গরম, আমাদের বৈশাখ মাসের ভরা দুপুরের অবস্থা। শীতের আগমনী আবহের মধ্যেই আগের রাতে আমাদের বিমান ঢাকা থেকে উড়ান দিয়েছিল। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশ হওয়ায় ইন্দোনেশিয়ায় সারা বছরই গরম। অবশ্য কাঠফাটা বা শরীরের চামড়া জ্বলা গরম নয়; গরমে কোন লু হাওয়া নেই। আর গরমের ঘামে শার্ট-গেঞ্জি ভিজে চপচপা হওয়ারও আশঙ্কা কম। একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, এখানে বিনা নোটিসে হঠাৎ বৃষ্টি। কোন আগাম আলামত নেই। জাকার্তায় সকালের আকাশ সারাবেলার পুর্বাভাস দেয় না। এই রোদ, এই বৃষ্টি। কাজেই গরমের অস্বস্তি শুরু হওয়ার আগেই বৃষ্টির শীতল আমেজে শরীর মন জুড়িয়ে যায়। সঙ্গে বাইরের গাছপালা প্রকৃতিও মনে হয় সদ্যস্নাত, ধুয়ে মুছে ঝলমল করছে। দূর থেকে জাকার্তা মেগাসিটিকে গাছ-গাছালির সবুজ আচ্ছাদনে ঢাকা এক গ্রামের মতো মনে হয়। সবুজ আচ্ছাদন ভেদ করে মাঝে মধ্যে গগনচুম্বী দৃষ্টিনন্দন অট্টালিকা কোনভাবে নগরায়নের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতির স্নিগ্ধতাকে ম্লান করতে পারছে না; প্রকৃতির কোলে পরম নির্ভরতায় আশ্রয় নিয়েছে নগর। জাকার্তা এসেছি আমার মেয়ের বাসায়। জামাই ও মেয়ে দুজনই ইঞ্জিনিয়ার। এ সুযোগে জাকার্তায় কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে আমার অভিজ্ঞতার ঝুড়িতে যে সামান্য সঞ্চয় হয়েছে তারই কিছু তুলে ধরছি। আগেই বলেছি ইন্দোনেশিয়ায় চেনা-অচেনা প্রায় সকলেই দৃষ্টি বিনিমিয় হলে আপনাকে স্মাইল দিয়ে বো ডাউন করে শুভেচ্ছা জানায়। তবে এর সঙ্গে কিন্তু মুখেও কিছু বলে তাঁর সৌজন্যের ভাব পূর্ণ করে। লক্ষ্য করে বুঝলাম দিনের সময়ের তারতম্য অনুযায়ী এই সম্ভাষণের ভাষারও পরিবর্তন হয়। যেমন, সকালে দেখা হলে বলবে, ‘সেলামত পাগি’ আবার দুপুরে বলবে, ‘সেলামত সিয়াং’ অপরাহ্ণ হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত, ‘সেলামত সোরে’, সন্ধ্যা হতে পরদিন ভোর অবধি ‘সেলামত মালাম’ বলে অন্তরের উষ্ণতা প্রকাশ করে। তবে ইন্দোনেশিয়ায় বিদেশীদের মধ্যে একটা কথা প্রচলিত আছে যে, ‘Asmiling Indonesian is not always a happy Indonesian’. এর মানে এ হাসি সবসময় বিনয় ও আন্তরিকতার বহির্প্রকাশ নাও হতে পারে। অনেক সময় হাসি দিয়ে তারা সংশয় ও বিস্ময়েরও প্রকাশ ঘটাতে পারে। একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি আশা করি স্পষ্ট হবে। যেমন, একদিন সকালে হাঁটতে গিয়ে দেখলাম এক মহিলা বিভিন্ন বৈয়াম থেকে নানাধরনের পাউডার বা ডাস্ট মিশিয়ে ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী গ্লাসে গরম পানির সঙ্গে মিক্স করে খাওয়াচ্ছে। আমি একটা গ্লাসে চা-এর মতো একটা পানীয় দেখে ওটা চা কি-না জিজ্ঞাসা করায় মহিলা তাঁর ভাষায় আমাকে দু’এক কথা বলে অনবরত হাসতে লাগল। গ্লাসের মাঝে গোলাপি রঙের চা টলমল করছে দেখে আমার চা খাওয়ার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল। কিন্তু তাদের এই হাসির জোয়ারে আমিও বেয়াক্কেলের মতো হেসে হেসে ফেটে পড়লাম। অবশ্য যাওয়ার সময় আমাকে ‘তেরিমা কাসি’ বলে বিদায়কালের ধন্যবাদ জানাতে ভুলল না। আমাদের পরস্পরের communication gap- ই এ হাসির অর্থ। এটাকে কোনভাবেই তাঁর নেতিবাচক মনোভাবের বহির্প্রকাশ মনে করার কোন কারণ নেই। একজন বিদেশীকে স্থানীয়রা ‘বুলে’ বলে। রাস্তায় হাঁটার পথে বার বার এই বুলে ডাক শুনে আপনার বিরক্তির উদ্রেক হতে পারে। কিন্তু বিরক্তি প্রকাশ না করে একটা সুন্দর হাসি অথবা স্মিত হয়ে নড করে এই বুলে ডাকের প্রতিক্রিয়া জানালেই শোভনীয় হয়। আপনার চলার পথে দেখবেন স্থানীয়দের অনেকে কৌতূহলবশে আপনাকে জিজ্ঞাসা করছে, ‘মাউ কেমানা’ অর্থাৎ আপনি কোথায় যাচ্ছেন? কয়েকদিনের হাঁটা চলায় মনে হল এ কথাটি নিছক কোন জিজ্ঞাসা নয়, বরং এটাও বিদেশীর প্রতি একটা সৌজন্যমূলক প্রশ্ন যা প্রশ্নকর্তা আপনার কোন সাহায্যে আসতে পারে কি-না তারও ইঙ্গিতবাহি। এ রকম প্রশ্নে খুব সংক্ষেপে ‘জালান, জালান’ মানে ঘোরতে যাচ্ছি বলেই সৌজন্যের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা যায়। বারংবার একই প্রশ্নের সম্মুখীন হলেও আপনার আচরণে কেউ যাতে মানসিকভাবে আহত না হয় সেদিকে সচেতন থাকতে হবে। ইন্দোনেশিয়ানরা বয়স্ক মহিলাদের ‘বু’ আর বয়স্ক পুরুষদের সম্মান সূচক ‘পাক’ বলে সম্বোধন করে। অন্যরা একে অন্যকে যার যার টাইটেল ধরে ডাকে, যেমন একজনের নাম নামা সায়া ত্রি, তখন তাকে ত্রি বলে ডাকতে হবে। স্থানীয়দের সঙ্গে পরিচয়ের সময় হাতে মৃদু চাপ দিয়ে পরিচিত হওয়াই সঙ্গত। হ্যান্ড সেইকের পর বুকে হার্টের অংশে হাত দিয়ে স্পর্শ করা বিনয় প্রকাশের সংকেতবাহী। সম্মিলিতভাবে একসঙ্গে পরিচিত হতে হলে বলতে হবে, ‘আপা কাবার’ মানে আপনাদের কেমন চলছে? তখন উত্তর পাবেন, ‘কাবার বাইক’ অর্থাৎ আমরা ভাল। লক্ষ্য করেছি ইন্দোনেশিয়ানরা কাউকেই নিরাশ করে না। সহযোগিতার হাত এদের উদার ও প্রশস্ত। আপনি হয়ত বাসস্টপে নেমে কাউকে জিজ্ঞাসা করলেন মিউজিয়াম কোনদিকে? তখন সে সঠিক জানুক না জানুক আপনাকে পথের একটা নিশানা দেখিয়ে দেবে। এখন ২/৩ জনের কাছে জিজ্ঞাসা করে যদি প্রায় একই ধরনের দিক নির্দেশনা পান তখনই আপনার গন্তব্য স্থলের দিকে এগোতে পারেন। এতে কোন বিভ্রান্তি সৃষ্টি হলেও নির্দেশকের প্রতি কোন নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টির কোন কারণ নেই। কারণ, তাঁর আচরণের মধ্যে আপনাকে সাহায্য করার আগ্রহই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। এখানে কোন জায়গা দূর হলে বলবে ‘জাউহ’ এবং কাছে হলে বলবে ‘ডেকাত।‘ মাঝে মাঝে শহরতলি অথবা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় গেলে এদের কিছু অভ্যাস বা আচরণ একজন বিদেশীর কাছে অশোভনীয় মনে হবে। যেমন পথের মধ্যে জটলা করে এমনভাবে আড্ডা মারছে যেন চলাচলের পথই বন্ধ হয়ে গেছে। অথবা আপনার সামনেই মুখ হতে অবিরত ধোঁয়া ছাড়ছে বা নাক দিয়ে শব্দ করে শ্বাস টানছে, রাস্তার ওপর সবার সামনে খেক করে থুতু ফেলছে ইত্যাদি। এ সমস্ত ঘটনা অবশ্য আবার সব সময় দেখা যায় না। আর চোখে পড়লেও সহজে বিরক্ত হওয়ার কারণ নেই। আপনাকে দেখলে তারা সচেতন হয়ে যাবে এবং একজন অপরাধীর মতো পাংশু হাসি দেবে। স্থানীয়দের মাঝে pose দিয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ফটো তোলার আগ্রহ খুব বেশি। বিদেশী দেখলেই বিশেষ করে শহরতলীতে লোকজন ফটো তুলতে ভিড় জমায়। তবে ফটো সেশনের পর ওদের হাতে প্রিন্ট কপিটা তুলে দিলে আর খুশি হয়। কারণ, ওদের একটা ধারণা হয়েছে যে এই ফটো আর দেখতে পাওয়া যাবে না। পোশাকের ব্যাপারে রাস্তা-ঘাটে, মল, রেস্তরাঁয় সাধারণত লোকজনের মধ্যে একটা বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। মহিলাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক তরুণীরা স্কার্ট, জিন্স পরলেও মাথায় স্কার্ফ দেয়। স্কার্ফ ছাড়া পশ্চিমা ধাঁচের ড্রেস পরিহিত মহিলাদেরও অভাব নেই। আপাদমস্তক বোরকা পরা মহিলাও মাঝে মাঝে চোখে পড়েছে। পুরুষরা আমাদের মতোই শার্ট, প্যান্ট, লুঙ্গি ইত্যাদি পরে। ধর্মের প্রতি এদের একটা অনুরাগ লক্ষণীয়। অনেকেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। উল্লেখ্য, ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র। দেশটির ২৬ কোটি ৫০ লাখ জনসংখ্যার প্রায় ৯০% ভাগই মুসলিম। কিন্তু ধর্মীয় নির্দেশনা পালনে বাহ্যিক তৎপরতা কম দৃশ্যমান হওয়ায় বাহির থেকে এতটুকু বোঝা যায় না। আর আমার তো মাত্র কয়েকদিনের দেখা। সব মিলিয়ে এই কয়েকদিনের আমার স্বল্পকালীন অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে, সাধারণভাবে ইন্দোনেশিয়ানরা খুব সরল, ভদ্র, বিনয়ী ও সহযোগিতাপরায়ন/পাশ্চাত্যের হাওয়ায় তারা এখনও সম্পূর্ণ গা ভাসিয়ে দেয়নি। চারদিকের এই ঝলসানো আগ্রাসনের মাঝেও তাদের সহজাত, অকৃত্রিম জাতীয় চরিত্র, রীতিনীতি, ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতি অনেকাংশেই অক্ষুণ্ণ রেখেই চলেছে। জাকার্তায় কয়েকদিনের অভিজ্ঞতায়, ধর্ম ও প্রাচীন সংস্কৃতির মধ্যে সমন্বয়ের এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত ইন্দোনেশিয়ানরা স্থাপন করে চলেছে বলে তাদের আচার আচরণে দৃশ্যমান হয়েছে। লেখক : সাবেক সরকারী কর্মকর্তা [email protected]
×