ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দাবাড়ু খুশবুর সৌরভ ছড়ানো সাফল্য

প্রকাশিত: ১২:৩৭, ২৬ জুন ২০১৯

দাবাড়ু খুশবুর সৌরভ ছড়ানো সাফল্য

বিশ্বখ্যাত বাঙালী চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের একমাত্র হিন্দী সিনেমার নাম ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি।’ শতরঞ্জের অর্থ হচ্ছে দাবা খেলা। যুদ্ধংদেহী বোর্ড ক্রীড়া হিসেবে দাবা খেলার সুনাম রয়েছে। খেলার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছেÑ প্রতিপক্ষের ঘুঁটি আয়ত্তে আনার মাধ্যমে নত স্বীকারে বাধ্য করা। এ খেলার জন্ম ভারতবর্ষে বলে সর্বাধিক প্রচলিত মতবাদ। এছাড়া পারস্য (বর্তমান ইরান) দেশে তৃতীয় শতাব্দীতে প্রচলিত শতরঞ্জ এবং চীনে দ্বিতীয় শতাব্দীতে প্রচলিত শিয়াংছী নামক খেলাকে দাবার পূর্বসূরী হিসেবে গণ্য করার পক্ষেও মতামত আছে। কথিত আছেÑ রাবণের স্ত্রী চিত্রাঙ্গদা যুদ্ধে নিবৃত্ত করার জন্য রাবণের সঙ্গে দাবা খেলতেন। প্রাচীন ভারতীয় খেলা হিসেবে দাবার সংস্কৃত শব্দ শতরঞ্জ খেলাটি পরিবর্তিতরূপে পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপে পরিমার্জিত হয়ে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। ক্রীড়াবিদরা দাবার কৌশল এবং বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগে খেলাটির ধারাই পরিবর্তন করে দিয়েছেন। বিশ্বব্যাপী দাবা একটি জনপ্রিয় খেলা। এ খেলায় জিততে হলে বোর্ডের ওপর ঘুঁটি সরিয়ে বা চাল দিয়ে বিপক্ষের রাজাকে ফাঁদে ফেলে বা নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়, দাবার পরিভাষায় যাকে বলে ‘কিস্তিমাত।’ ইতিহাস বলে, বুদ্ধির এ খেলাটির উৎপত্তিস্থল ভারতে। তবে উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার কিন্তু ভারতের নয়! ১৯৮৭ সালে উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টারের খেতাব লাভ করেন বাংলাদেশের নিয়াজ মোরশেদ। তাঁর পরে আরও চারজন এ খেতাবের অধিকারী হন। তাঁরা হলেনÑ জিয়াউর রহমান, রিফাত বিন সাত্তার, এনামুল হোসেন রাজীব এবং আবদুল্লাহ আল রাকিব। শেষের দু’জন বর্তমানে ঢাকার এলিগেন্ট চেস ইন্টারন্যাশনাল একডেমিতে কোচ হিসেবে কাজ করছেন। সেখানে অন্য খুদে দাবাড়–দের মধ্যে একজন ওয়ারসিয়া খুশবু। সম্প্রতি সে উজবেকিস্তানে গিয়ে চোখ ধাঁধানো ও সৌরভ ছড়ানো সাফল্য পেয়েছে। আজকের লেখার মূল চরিত্রই হচ্ছে খুশবু। এশিয়ান স্কুল র‌্যাাপিড চেস চ্যাম্পিয়নশিপ অনুর্ধ-৭ বালিকা বিভাগে বাংলাদেশের এলিগেন্ট ইন্টারন্যাশনাল চেস একাডেমির ওয়ারসিয়া খুশবু অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। উজবেকিস্তানের তাসখন্দে ২০ জুন অনুষ্ঠিত এ আসরে ৭ ম্যাচে সাড়ে ৬ পয়েন্ট পেয়ে দেশসেরা এই খুদে দাবাড়ু এ কৃতিত্ব দেখায়। এ আসরে ৭ দেশের ১৭ দাবাড়ু অংশ নেয়। এর মধ্যে ৪ রেটেড ও ১৩ নন-রেটেড দাবাড়– ছিল। খুশবু এই ইভেন্টে শীর্ষ বাছাই দাবাড়ু ছিল। সে বাংলাদেশের একটি সফটওয়্যাার কোম্পানি বিট মাসকট প্রাইভেট লিমিটেডের পৃষ্ঠপোষকতায় এ আসরে অংশ নেয়। উজবেকিস্তানে ২১ জুন থেকে শুরু হওয়া স্ট্যান্ডার্ড টুর্নামেন্টেও অংশ নিয়েছে খুশবু। এছাড়া একই দেশে ২৭ জুন অনুষ্ঠেয় ব্লিটজ ইভেন্টেও অংশ নেবে। মাত্র ৭ বছর বয়সী খুশবু খুশবু গত বছর উজবেকিস্তানে অনুষ্ঠেয় এই আসরের অনুর্ধ ৬ গ্রুপ অংশ নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। সে বর্তমানে বাংলাদেশে যুব দাবা প্রতিযোগিতার অনুর্ধ-৮ (বালিকা) বিভাগের শীর্ষ দাবাড়–। এর আগে দেশী-বিদেশী সব ধরনের টুর্নামেন্ট মিলিয়ে সে ৯টিতে চ্যাম্পিয়ন, ৬টিতে রানারআপ এবং ১টিতে তাম্রপদক পেয়েছে। এর মধ্যে আছে তিনটি আন্তর্জাতিক শিরোপা। অথচ কদিন আগেও একটি মাত্র বিমান টিকেট এবং নিবন্ধন ফির অর্থের অভাবে খুশবুর উজবেকিস্তানে যাওয়া হয়ে পড়েছিল অনিশ্চিত। এ নিয়ে গত ২৮ মে দৈনিক জনকণ্ঠে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ‘খুদে দাবাড়– খুশবুর আহাজারি’ শিরোনামে। এই রিপোর্টটি প্রকাশের প্রেক্ষিতেই খুশবুর পাশে দাঁড়ায় বিট মাসকট প্রাইভেট লিমিটেড। এর আগে খুদে দাবা প্রতিভাময়ী ওয়ারসিয়া খুশবু এশিয়ান চেস চ্যাম্পিয়নশিপ টুর্নামেন্টে অংশ নিতে গত ১৮ জুন উজবেকিস্তান যায়। নয় দিনব্যাপী এই আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে খুশবুকে এক লাখ ষাট হাজার টাকা দিয়ে স্পন্সর করেছে সফটওয়্যার কোম্পানি বিট মাসকট প্রাইভেট লিমিটেড। বয়স মাত্র ৭। চেহারাটা ভারী মিষ্টি। এত আস্তে কথা বলে, শোনাই যায় না! স্বভাবেও ভীষণ লাজুক মেয়েটি। অথচ ৬৪ ঘরের দাবা বোর্ডে বসলেই সে একেবারে পাল্টে যায়। প্রতিপক্ষ যতই সিনিয়র-অভিজ্ঞ হোক, মোটেও ঘাবড়ায় না। বরং জেতার জন্য চেষ্টা করে সর্বাত্মক। এই বয়সেই অভাবনীয় সাফল্য। বেশ কদিন ধরেই মন ভাল ছিল না খুশবুর। কেননা একটি মাত্র বিমান টিকেট এবং নিবদ্ধন ফির অর্থের অভাবে তার উজবেকিস্তানে যাওয়া হয়ে পড়েছিল অনিশ্চিত। ওখানে তার এশিয়ান ইয়ুথ চেস চ্যাম্পিয়নশিপে খেলার কথা, যা অনুষ্ঠিত হবে ১৯-২৯ জুন পর্যন্ত (গত বছর এই চ্যাম্পিয়নশিপের অনুর্ধ-৬ বিভাগে খুশবু স্বর্ণপদক জয় করেছিল)। তবে আবার হাসি ফিরে আসে খুশবুর মুখে। কেননা তার উজবেকিস্তান যাওয়া নিশ্চিত হয় তার। সেটা সম্ভব হয় জনকণ্ঠে খুশবুর রিপোর্টটি প্রকাশের প্রেক্ষিতেই। খুশবুর পাশে দাঁড়ায়ে বিট মাসকট প্রাইভেট লিমিটেড। তারা উজবেকিস্তানে দাবা টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের জন্য এন্ট্রি ফি ও এয়ার টিকেট বাবদ এক লাখ ষাট হাজার টাকার চেক দেয়। মহাখালীর নিউ ডিওএইচএসে নিজেদের অফিসে খুশবুর হাতে সেটা তুলে দেন প্রতিষ্ঠানটির জেনারেল ম্যানেজার আবু বকর সিদ্দিক, ফিন্যান্স ম্যানেজার অসীম কুমার ঘোষ। সেখানে উপস্থিত ছিলেন গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীবও, যিনি খুশবুকে কোচিং করান এলিগেন্ট চেস একাডেমিতে। চেক পেয়ে খুশবুর প্রতিক্রিয়া, ‘আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। দোয়া চাইবেন আমি যেন ভাল খেলতে পারি।’ গ্র্যান্ডমাস্টার রাজীব বলেন, ‘বিট মাসকটকে ধন্যবাদ খুশবুর পাশে দাঁড়ানোর জন্য।’ ভবিষতেও প্রতিষ্ঠানটি দাবায় সহায়তা থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে। তারা বিশ্বাস করে উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ এবং নারী দাবার কিংবদন্তি রানী হামিদের মতো এখনও অনেক মেধাবী বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে। তারাও সুযোগ পেলে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে ভবিষ্যতে আরও বেশি সাফল্য ও সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যাবার যোগ্যতা রাখে। চেক প্রদান অনুষ্ঠানে সেখানে আরও উপস্থিত ছিলেন খুশবুর বাবা মেহেদী কায়সার এবং তার মা এশা কায়সার। এখন দেখার বিষয়, আগামীতে খুশবু কতদূর যায়।
×